ওকে বললাম, দেওয়ালটা বড্ড স্যাঁতসেঁতে, কিন্তু উপায় নেই। আমি অবশ্য তোমাকে ফিরে যাবার জন্যে শেষ অনুরোধ করব। কী, ফিরবেনা? তাহলে তোমাকে এখানে ফেলে যাওয়া ছাড়া আমার গত্যন্তর নেই।
বন্ধুর বিস্ময়ের ঘোর তখনো কাটেনি। সে মোহগ্রস্তের মত উচ্চারণ করল, এমোনটিল্লাডো!
–হ্যাঁ, এমোনটিল্লাডো।
কথা বলতে বলতে আমি কঙ্কালগুলো সরিয়ে ওর তলা থেকে কয়েকখানা পাথর আর কিছু মশলা বার করে ফেললাম। এর পর কর্ণিকটার সাহায্যে পাথর আর মশলা দিয়ে এই ছোট্ট কক্ষটার প্রবেশ-পথ বন্ধ করে ফেললাম।
একপ্রস্থ পাথর বসানো শেষ করার পূর্বেই বুঝতে পারলাম ফর্চুনাটোর মদের নেশা অনেকখানি কেটে গেছে। এর প্রথম প্রমাণ পেলাম ওর মৃদু আর্তনাদ থেকে। কক্ষের গহ্বর থেকে সে আর্তনাদ শুনে বুঝতে পারলাম যে তা মাতালের কণ্ঠস্বর নয়। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতায় কেটে গেল এরপর। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ স্তর পাথর বসানোর পরই শেকলের প্রবল ঝন্ ঝন্ শব্দের অনুরণন অনুভব করলাম। বেশ কয়েক মিনিট ধরে খুব তৃপ্তির সঙ্গে আমি তা উপভোগ করলাম। এরপর একটু সময় কঙ্কালস্কৃপের ওপর বসে রইলাম আমি। শেকলের শেষ ধ্বনিটুকু মিলিয়ে যাবার সঙ্গে আবার উঠে তৎপরতার সঙ্গে পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম স্তর পাথর বসিয়ে আমার কাজ নিপুণভাবে শেষ করে ফেললাম। নতুন দেওয়ালটা তখন প্রায় আমার বুক-সমান উঁচু হয়ে উঠেছে। মশালটা উঁচু করে ধরে ওপাশের মূর্তিটাকে একবার দেখে নিতে চাইলাম আমি।
শৃঙ্খলাবদ্ধ মানুষটার গলা থেকে এমন একটা তীব্র আর তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বেরিয়ে এলো যে আমি কয়েক পা পিছিয়ে এলাম নিজেরই অজান্তে। একটু সঙ্কোচ, একটা শিহরণ অনুভব করলাম যেন। একটা তলোয়ার খাপ থেকে বার করে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালাম খানিকক্ষণ। একটু পরেই কিন্তু স্বাভাবিকতা ফিরে এলো আমার মধ্যে। যে দেওয়াল আমি গড়ে তুলছিলাম হাত দিয়ে তার দুর্ভেদ্যতা অনুভব করে বড় তৃপ্ত হলাম আমি। এরপর আবার আমার কাজ শুরু করলাম। ওদিকের আর্তনাদের প্রত্যুত্তরে আমিও চীৎকার করতে থাকলাম–আরও বেশী করে, তীব্রতর ভাবেই। ওর আর্তনাদ আমার চীৎকারের প্রচণ্ডতার মধ্যে সম্পূর্ণভাবেই ডুবে গেল । সব কিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেল এর পর।
তখন প্রায় রাত দুপুর। আমার কাজও শেষ হয়ে আসছিল। অষ্টম, নবম আর দশম স্তরের গাঁথনীও শেষ হয়ে গিয়েছিল। এর পরের একটা স্তর শেষ করে তার ওপর একটা মাত্র পাথর বসিয়ে দিয়ে পলস্তারা লাগানোটুকু মাত্র তখন বাকী। পাথরটা বেশ ভারী। ওটা নিয়ে আমি টানাহ্যাঁচড়া করছিলাম। ওটাকে তার জায়গায় যখন প্রায় এনে বসিয়েছি ঠিক তখনই ভেতর থেকে মৃদু কণ্ঠের হাসির শব্দে আমার শরীর শিউরে উঠল। মাথার চুলগুলো সবই যেন খাড়া হয়ে উঠল আমার। তার পরমুহূর্তেই করুণ কণ্ঠস্বরে কিছু কথা শুনতে পেলাম আমি। ওটা ফর্চুনাটোর গলার স্বর বলে চিনে নিতে অবশ্য একটু বিলম্ব হয়েছিল আমার। শুনলাম, হাঃ হাঃ হাঃ, এ রসিকতাটা কিন্তু মন্দ নয় ।-বেশ উচ্চস্তরের রসিকতাই বলতে হবে। ও-বাড়ীতে এ নিয়ে রসিকতার অনেক বেশী সুযোগ এরপর পাওয়া যাবে। হেঃ হেঃ হেঃ, আমাদের এই মদ খাওয়া নিয়েই রসিকতা, হাঃ হাঃ, হাঃ।
আমি বলে উঠলাম, এমোনটিল্লাড়ো!
হাঃ হাঃ হাঃ, এমোনটিল্লাডোই বটে। কিন্তু আমরা কি যথেষ্ট দেরী করে ফেলিনি? ওদিকে লেডি ফর্চুনাটো আর অন্যেরা আমাদের জন্য নিশ্চয়ই অপেক্ষা করে আছেন। চল, এবার আমরা ফিরে যাই।
–হ্যাঁ, যাওয়া যাক্ এবার।
–ঈশ্বরের দোহাই।
–ঈশ্বরের দোহাই।
এরপর বেশ খানিক সময় অপেক্ষা করেও কোন কথা শুনতে পেলাম না। বেশ অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, ফর্চুনাটো! কোন উত্তর শোনা গেল না। আবার ডাক দিলাম, ফর্চুনাটো! কোন উত্তর নেই। যে একটুখানি ফাঁক ছিল গাথনীর মধ্যে তার ভেতর দিয়ে মশালটা গলিয়ে ওপাশে ফেলে দিলাম আমি। এর পরিবর্তে ও দিক থেকে শেকলের আর ঘণ্টার ঝন্ ঝন্ শব্দ ভেসে এলো শুধু। ভূগর্ভস্থ সে কক্ষটির স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে অসুস্থ বোধ করছিলাম। কাজ যেটুকু করার ছিল, সেটি তাই তাড়াতাড়ি শেষ করতে চাইলাম আমি। শেষ পাথরটিকে নির্দিষ্ট জায়গায় বসিয়ে আমি তার ওপর পুরু পলস্তারা লাগিয়ে দিলাম। এই নতুন গাথনীর গায়ে পুরোনো কঙ্কালের একটা প্রাচীর গড়ে তুললাম এরপর। অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে কোন মানবসন্তান ওদের স্থানচ্যুত করেনি। শান্তিতে থাকুক ওরা।
জনতার মানুষ
জার্মান ভাষায় রচিত কোন একটি গ্রন্থ সম্পর্কে বলা হয় যে ওটি পড়বার জন্য রচিত হয়নি। একই ভাবে বলা যায় যে কিছু গোপনীয় তথ্য আছে যেগুলি কোনদিনই প্রকাশযোগ্য নয়। এই ধরণের অত্যন্ত গোপনীয় তথ্যের ঘৃণ্য বোঝা বয়েই কিছু মানুষ রাত্রির নির্জনতার মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এরা মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে স্বীকারোক্তি করে আর করুণভাবে তাকিয়ে থাকে সবার মুখের দিকে। তারপর এক সময় হতাশার ভারে ওদের কণ্ঠরোধ হয়ে আসে আর সব ফুরিয়ে যায়। তবুও মানুষ মাঝে মধ্যে এই ধরণের ভয়ঙ্কর বোঝা বয়ে বেড়ায় আর শেষ পর্যন্ত সেইসব বোঝ নিয়েই কবরের মধ্যে চলে যায়। হয়ত এই জন্যেই অপরাধমূলক সব কাজের মৌলিক কারণগুলো অজ্ঞাতই থেকে যায়।