–ও সব কথা থাক। এ কফকাশি কিছুই নয়, এতে আমার কোন ক্ষতি হবে না। আমি কফকাশিতে মরবো না।
-হ্যাঁ সেতো ঠিকই আর তাই না হওয়া উচিত। দেখ, আমি তোমাকে ভয় পাইয়ে দিতে চাইনে কিন্তু স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্যে যে সব রকমের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, এটা তো আর অস্বীকার করা যায় না। এই নাও, এই ‘ম্যাডোক আমাদের ঠাণ্ডা-লাগা থেকে রক্ষা করবে।
কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাকে যেখানে অনেক বোতল রাখা ছিল সেখান থেকে একটা বোতল তাড়াতাড়ি নামিয়ে এনে খুলে ফেললাম। মদের বোতলটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, নাও, ধরো’। ও বাঁকা চোখে আমাকে একবার দেখে নিয়ে বোতলটা তুলে ধরল মুখের কাছে । ওর বহু-পরিচিত মাথা নাড়বার ভঙ্গীটিও দেখলাম যার ফলে টুপীর ঘণ্টাগুলো আবার বেজে উঠল।
সে বলল, আমার আশে পাশে যারা মাটির তলায় ঘুমিয়ে আছে আমি তাদের উদ্দেশে মদ্যপান করছি।
–আর আমি পান করছি তোমার দীর্ঘ জীবন কামনা করে।
এরপর সে আমার হাত ধরে এগিয়ে চলতে চলতে বলল, এই ভাড়ারগুলো বেশ বড়।
আমি বললাম, আমাদের পরিবারটাও এককালে বেশ বড় ছিল। সংখ্যায় অনেক লোকজন।
–তোমাদের প্রতীক চিহ্ন যে কী ছিল ভুলে গেলাম।
–খোলা মাঠে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে, তার পায়ের তলায় পিষ্ট হচ্ছে একটা বিষধর সাপ আর সাপটার দাঁত মানুষটির পায়ের গোড়ালীতে আটকে আছে।
-কী যেন বক্তব্য একটা ছিল ওর সঙ্গে?
–অপরাধ করলে কোন মানুষই শাস্তির হাত থেকে রেহাই পায় না।
-বাঃ, বেশ ভালো।
ওর চোখে তখন মদের ফেনা চক্ চক্ করে উঠল আর মাথার ঘণ্টাগুলো বেজে উঠল ঝন্ ঝন করে। মদ আমার ওপরও কাজ করছিল। কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠছিলাম আমি। আমরা যে দিক দিয়ে এগিয়ে চলেছিলাম সেদিকে দেয়ালের পাশে অজস্র কঙ্কাল আর মদের কিছু পিপে। আমি ওর হাত ধরে এগিয়ে চলেছিলাম।
আমি হঠাৎ বলে উঠলাম, এই যে নাইট্রিক অ্যাসিড দেখছ, এগুলো কিন্তু বেশ বেড়ে ওঠে। এই ভাড়ারগুলোতে শ্যাওলার মতো এগুলো জমে যায়। আমরা তো নদীর তলায় দাঁড়িয়ে আছি। ওপর থেকে জল চুঁইয়ে পড়ে কঙ্কালগুলোর ওপর। যাক, খুব দেরী হয়ে গেছে। চল ফিরে যাই, তোমার আবার কফকাশি–
–ও কিছু নয়। কী বলছিলে বল, কিন্তু তার আগে আর একবার ‘ম্যাডোক’ হয়ে যাক।
আমি এবার ওর হাতের কাছে এক বোতল ‘দ্য গ্রাভে’ এগিয়ে দিলাম। এক নিশ্বাসে ও বোতলটা খালি করে ফেলল। ওর চোখে তখন আগুনের জ্যোতি। হেসে ও এমন একটা ভঙ্গী করে বোতলটা ওপরের দিকে ছুঁড়ে ফেলল যার সঠিক অর্থবোধ আমার পক্ষে সহজ হোল না। আমি ওর দিকে জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকালাম, ও সেই অদ্ভুত ভঙ্গীটির পুনরাবৃত্তি করল।
সে বলল, বুঝলে কিছু?—না, বুঝলাম না।
–তাহলে তুমি সংঘের সদস্য নও।
–কেন?
–তুমি ভ্রাতৃসঙ্ঘের সদস্য নও।
–অবশ্যই, অবশ্যই আমি ওদের একজন।
–তুমি? অসম্ভব। ভ্রাতৃসঙ্ঘের সদস্য?
–হ্যাঁ, ভ্রাতৃসঙ্ঘের সদস্য।
–কোন চিহ্ন দেখাতে পারে?
আমি পোষাকের ভাজের ভেতর থেকে একটা কর্ণিক বার করে ওকে দেখালাম। তুমি ঠাট্টা করছ–বলল সে, যাই হোক, চল তোমায় এমোনটিল্লাডোর কাছে যাই।
-তাই চল, বলে আমি ওকে নিয়ে এগিয়ে চললাম। কর্ণিকটা ততক্ষণে পোষাকের মধ্যে পুরে ফেলেছি আমি। ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। ও আমার ওপর ভর দিয়েই হাঁটছিল । আমরা এমোনটিল্লাডোর খোঁজে চললাম। কতকগুলো নীচু খিলানের তলা দিয়ে গিয়ে আমরা একটু তলায় নেমে গেলাম। কিছুদূর এগিয়ে আবার একটু তলায় নামলাম। আমরা গিয়ে পৌঁছলাম একটা গুপ্ত কক্ষের মধ্যে। ওখানকার বাতাস দুর্গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছিল। সে বাতাসে আমাদের মশালগুলো চক্ করে উঠল।
গুপ্ত কক্ষের এক প্রান্তে আরও ক্ষুদ্র একটা কক্ষ দেখা যাচ্ছিল। ওর দেওয়ালগুলোর গায়ে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত নরকঙ্কালের স্তূপ। তিনটে দেওয়ালের গায়েই এই দৃশ্য। চতুর্থ দেওয়ালের গা থেকে কঙ্কালগুলো মেঝের মাঝখানে ছড়িয়ে পড়েছিল। এক জায়গায় অবশ্য ওগুলো মেঝের উপরেই একরকম স্কুপ হয়ে গিয়েছিল। যে দেওয়ালটার গা থেকে কঙ্কালগুলো ছড়িয়ে পড়েছিল তারই গায়ে তিন ফুট চওড়া, চার ফুট গভীর, ছ’সাত ফুট লম্বা একটা তাকের মত দেখা যাচ্ছিল। ওটা কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরী হয়েছিল বলে মনে হোল না। দুটো থামের মাঝখানে পেছনের গ্রানাইট দেওয়ালের গায়ে ওই রকম একটা তাক হয়ে গিয়ে থাকবে।
ফর্চুনাটো তার মৃদু আলোর মশালটা তুলে ধরে বৃথাই ওখানে খোঁজ করছিল। আলোর মৃদু রেখা কক্ষটার শেষ প্রান্তে মোটেই পৌঁছচ্ছিল না।
আমি বললাম, আর একটু এগিয়ে চল। এমোনটিল্লাডো ঐখানেই আছে। সুচেসি বলে—
–ওটা একটা মূর্খ। বলে উঠল বন্ধুটি। টলতে টলতে সে চলল এগিয়ে আর আমি চললাম তার পেছনে। পর মুহূর্তে সে গিয়ে পৌঁছল কক্ষের শেষ প্রান্তে, পাথরের দেওয়ালের কাছে। ওখানে গিয়ে ও বোকার মত দাঁড়িয়ে পড়ল। পর মুহূর্তে আমি ওকে গ্রানাইট পাথরের সঙ্গে বেঁধে ফেললাম । পাথরের গায়ে দু’ফুট তফাতে পাশাপাশি দুটো লোহার গজাল লাগানো ছিল। একটা থেকে একটা ছোট শেকল আর অন্যটাতে একটা চাবি ঝোলানো ছিল। ওর কোমরের ওপর দিয়ে শেকলটা ঘুরিয়ে নিয়ে তালা লাগিয়ে দিতে কয়েক সেকেণ্ড লাগল মাত্র। ও এতই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল যে বাধা দেবার মত শক্তিও তার ছিল না। তালা থেকে চাবিটা বার করে নিয়ে আমি সে কক্ষ থেকে সরে এলাম।