কথায় বা কাজে ফর্চুনাটোকে আমি এমন কোন সুযোগ কোন দিনই দিই নি যাতে আমার শুভেচ্ছা সম্পর্কে তার সন্দেহ জাগতে পারে। চিরাচরিত অভ্যাসমততই তার মুখের কথায় হেসেছি আমি। সে বুঝতেও পারেনি যে সে হাসির উৎসমুখ আমার প্রতিশোধস্পৃহার মধ্যেই নিহিত ছিল।
সাধারণভাবে বলতে গেলে ফর্চুনাটোর যে সব গুণাবলী ছিল তার জন্য সে সকলের শ্রদ্ধার এমন কি ভীতির পাত্র হলেও তার একটা দুর্বল দিক ছিল। সে নিজেকে মদ্যরসিক বলে জাহির করত। উচ্চতর দক্ষতা সম্পর্কে এ ধরণের দাবী কম ইতালীয়ই করতে পারেন। ওদের সমস্ত উৎসাহ সময় আর সুযোগ লক্ষ্য করে ব্যয়িত হোত, বিশেষ করে ব্রিটিশ আর অষ্ট্রিয়ান লক্ষপতিদের
প্রতারণা করার বেলায় খুব বেশী পরিমাণে। চিত্রাঙ্কন বা মণি মাণিক্য সম্পর্কে ফর্চুনাটোর ধারণা নিম্নশ্রেণীর হলেও পুরোনো মদ সম্পর্কে সে ছিল একেবারে রসপণ্ডিত। এ ক্ষেত্রে তার সততা একেবারে প্রশ্নাতীত। আমার কিন্তু এই বিশেষ ব্যাপারে ওর সঙ্গে মতপার্থক্য ছিলনা, কেননা ইতালীয় মদে আসক্তি আমারও ছিল। সুযোগ পেলেই ও মদ আমি প্রচুর পরিমাণে কিনে ফেলতাম।
যে সময়টায় মেলা আর নানা রকমের উৎসব নিয়ে হৈ হুল্লোড় শুরু হয় তেমনি সময় এক দিন সন্ধ্যেবেলায় আমি বন্ধুর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ালাম। অনেকক্ষণ ধরেই ও মদ গিলছিল। আমাকে দেখে ভীষণ অান্তরিক ভাবে স্বাগত জানালো সে। নোংরা পোষাক পরে বসেছিল সে, আঁটসাট ডোরাকাটা জামাপ্যান্ট আর ঘণ্টা ঝুলোনো লম্বা টুপী পরা ওকে দেখে মনে হয়েছিল ওর সঙ্গে করমর্দন করাই আমার উচিত নয়।
আমি ওকে বললাম, দেখ ফর্চুনাটো, বড় ভাগ্যের কথা যে তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তোমাকে আজ কিন্তু দেখতে খুব ভালো লাগছে। আমি এক পিপে মদ কিনেছি। ওরা বলছে ওটা এমোনটিল্লাডো। আমার কিন্তু বেশ সন্দেহ হচ্ছে।
ও বলল, এমোনটিলাভো? এই মেলার সময়? তাও আবার এক পিপে? অসম্ভব।
আমি বললাম, সন্দেহ আমারও আছে। আমি কিন্তু এমোনটিল্লাডোর দামই পুরোপুরি দিয়েছি তাও তোমার সঙ্গে পরামর্শ না করে। তোমার দেখা পাওয়া গেলনা অথচ এদিকে দেরী করলে জিনিসটাই হাতছাড়া হয়ে যায়।
–এমোনটিল্লাডো!
–আমার কিন্তু সন্দেহ আছে।
–এমোনটিল্লাডো।
–পুরো দামটা কিন্তু দিতে হল ওদের
–এমোনটিল্লাডো
–তুমি ব্যস্ত ছিলে। আমি তাই গেলাম সুচেসির কাছে। কেউ এসব জিনিস ঠিক মত চিনতে যদি পারে তাহলে সে। সেই আমাকে বলে দেবে
-লুচেসি শেরী আর এমোনটিল্লাডোর পার্থক্য কখনোই ধরতে পারেনা।
-বোকারাও কিন্তু বলবে যে মদ চেনার ব্যাপারে তারা তোমার সমকক্ষ।
–ঠিক আছে। চল যাই।
–কোথায়?
–তোমার মাটির তলাকার মদের ভাঁড়ারে।
-না, বন্ধু না, তুমি ভালো মানুষ বলে চিরদিনই তোমার ওপর আমি জবরদস্তি করব এ কোন কাজের কথা নয়। তা ছাড়া তোমার জরুরী কাজও আছে আমি জানি। সুচেসি–
-না, আমার কোন জরুরী কাজ নেই। চল যাই।
-না, তা হয় না। আমি ঠিক জরুরী কাজের কথা বলছিনে। তোমার ভীষণ ঠাণ্ডা লেগেছে দেখছি। আমার মাটির তলাকার মদের ভাড়ারটা মারাত্মক রকমের সঁতসেঁতে আর তা ছাড়া ওখানকার পরিবেশ রীতিমতো অস্বাস্থ্যকর।
-তা হোক গে। তবু চল আমরা যাই। এমন কিছু ঠাণ্ডা লাগেনি আমাকে। এমোনটিল্লাডো! আমি জানি কেউ ওটা তোমাকে জোর করে গছিয়েছে, আর লুচেসি? শেরী আর এমোনটিল্লাডো বোঝবার শক্তিই তার নেই।
কথা বলতে বলতে ফর্চুনাটো ততক্ষণে আমার হাত ধরে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। কিছু জামাকাপড় চাপিয়ে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওর সঙ্গে বাড়ীর দিকে রওনা হলাম। বাড়ীতে চাকর বাকর কেউ ছিল না। মেলা দেখবার জন্যে সবাই পালিয়েছিল। আমি বলেছিলাম ওদের যে পরদিন সকাল বেলা বাড়ী আসব। ওরা যেন কিছুতেই বাড়ীর বাইরে না যায়, সে নির্দেশ বিশেষভাবেই দেওয়া ছিল। কিন্তু আমি একথাও জানতাম যে আমি পিছন ফিরতে না ফিরতেই ওরা সবাই হাওয়া হয়ে যাবে।
দুটো মশাল নিয়ে ফর্চুনাটোর হাতে তার একটা গুঁজে কামরাগুলো পেরিয়ে আমরা রওনা হলাম মদের ভাঁড়ারের দিকে। ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় ওকে বার বার সাবধান করে দিলাম আমি। শেষ পর্যন্ত আমার মাটির তলার ভাঁড়ারের স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে নেমে এলাম ।
বন্ধু তখন স্থির হয়ে হাঁটতে পারছিলেন না আর মাথার টুপীর ঘন্টাগুলো ঝুম্ ঝুম্ করে বেজে চলেছিল।
ও জানতে চাইল, কই, পিপেটা কোথায়? আমি বললাম, ওই যে ওখানে। কিন্তু দেওয়ালের গায়ে মাকড়শার সাদা রঙের জালগুলো দেখছ : বন্ধু আমার দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে মদের ঘরে ঝিমিয়ে আসা চোখ দুটো দিয়ে তাকিয়ে রইল। একটু পরে সে বলল, নাইট্রিক এ্যাসিডের গন্ধ পাচ্ছি?
নাইট্রিক এ্যাসিড! কিন্তু তোমার এই কাশিটা কতদিন ধরে হচ্ছে?
খুক, খু, খু– । বন্ধু অনেকক্ষণ কোন কথাই বলতে পারল না। বেশ কিছু সময় পরে সে বলল, না এমন কিছু নয় এটা।
আমি মন স্থির করে নিয়ে বললাম, চল আমরা ফিরে যাই। তোমার শরীর অনেক মূল্যবান। তুমি ধনী, সম্মানিত, প্রশংসিত, বহু মানুষের স্নেহ ভালোবাসায় তোমার জীবন পরিপূর্ণ আর তুমি এজন্যে পরম সুখীও বটে। অবশ্য এককালে এ সবের অনেক কিছুই আমার ছিল। তোমার কোন প্রকার ক্ষতি অসহনীয়। আমার কথা বাদ দাও। তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে পুরো দায়িত্ব আমার ওপর এসে পড়বে। সেটা ভালো নয়। চল আমরা ফিরে যাই। তাছাড়া সুচেসি যখন রয়েইছে–