লেইপসিকের ‘সার্জিক্যাল জার্নাল’ একটি বিখ্যাত পত্রিকা। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি সংখ্যায় এই পত্রিকা এই ধরণের আর একটি ঘটনার খবর দিয়েছে।
গোলন্দাজ বাহিনীর একজন বেশ লম্বা চওড়া চেহারার অফিসার একটা দুষ্টু ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় বেশ আঘাত পান। মাথার খুলি একটুখানি জখম হওয়া সত্ত্বেও ওঁর সম্পর্কে বিপদের কোন আশঙ্কা চিকিৎসকেরা করেন নি। যাই হোক শেষ পর্যন্ত মাথায় অপারেশন করা হল, রক্তমোণ আর অন্যান্য সমস্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করা হল, কিন্তু রোগী ধীরে ধীরে গভীর সুপ্তির মধ্যে তলিয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত সকলেই ধরে নিলেন তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
আবহাওয়া তখন ছিল উষ্ণ আর অস্বাভাবিক ব্যস্ততার মধ্যে তাঁকে একটা সাধারণ কবরখানায় সমাহিত করা হয় এক বৃহস্পতিবার। পরের রোববার স্বাভাবিকভাবেই সেখানে বহুলোকের সমাগম ঘটে। সেদিন দুপুরে হঠাৎ কবরখানায় প্রবল উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। একটি চাষী বলে যে সে যখন অফিসারটির কবরের কাছে বসেছিল তখন মাটির ভেতর থেকে একটা সাড়া পেয়েছে। তার দৃঢ় ধারণা যে তলা থেকে কেউ বাইরে আসার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। প্রথমটা বড় কেউ একটা ওর কথায় কান দেয়নি। সে কিন্তু ছেড়ে কথা কইবার পাত্র নয়। সে যে সত্যি কথাই বলছে এটা প্রমাণ করার জন্য সে ভীষণ চেঁচামেচি করে। ফলে উপস্থিত লোকজনদের মনের পরিবর্তন হয়। তাড়াতাড়ি কোদাল গাইতি এনে খোঁড়াখুড়ি শুরু হোল। কবরটা মোটেই গভীর ছিল
তাই একটুখানি খোড়বার পরই ওর ভেতর থেকে একটা মাথা বেরিয়ে এলো। ওকে দেখে মৃত বলেই মনে হচ্ছিল। বেচারা কবরের মধ্যে কফিনের ভেতর উঠে বসেছিল আর ওর প্রাণপণ চেষ্টায় কফিনটা ভেঙেও গিয়েছিল।
তাড়াতাড়ি ওকে পাশের একটা হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর ওখানে মানুটিকে জীবিত বলেই ঘোষণা করা হয়। অবশ্য চিকিৎসকরা একথা বলেন যে সাময়িকভাবে ওর হৃদস্পন্দনের বিরতি ঘটেছে। কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় সে সেরে ওঠে, পরিচিতদের ঠিকমত চিনতে পারে আর কবরের মধ্যেকার দুঃখময় ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেয়। অবশ্য তখনো তার বাচনভঙ্গীর মধ্যে জড়তা ছিল।
ওর বর্ণনা থেকেই এইটি প্রতিপন্ন হয় যে ওকে যখন সমাহিত করা হয় তখন ওর চেতনা ছিল। পরে অবশ্য সে চেতনা হারায়। অত্যন্ত ব্যস্ততার সঙ্গে হালকা রন্ধ্রবহুল মাটি দিয়ে অল্প নীচে কফিনটি চাপা দেওয়া হয়, ফলে ওর মধ্যে বাতাস অনায়াসে যেতে পেরেছে। কবরের ওপরে মানুষের চলাফেরার শব্দ পেয়ে সে প্রাণপণে তার খবর পৌঁছে দিতে চেয়েছে। আসলে ঐ চলাফেরার শব্দই ওর ঘুম ভাঙিয়েছিল কিন্তু তার পরমুহূর্তেই নিজের অবস্থা বুঝতে পেরে সে ভীষণ ভয় পেয়ে যায়।
পত্রিকায় বলা হয়েছে যে রোগী বেশ স্বাভাবিকভাবেই সেরে উঠছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাতুড়ে বৈদ্যগিরিতেই বেচারা মারা যায়। কৃত্রিম উপায়ে বৈদ্যুতিক শক্তির সাহায্যে তাকে তাড়াতাড়ি সারিয়ে তোলবার চেষ্টা করার ফলে তারই আকস্মিক প্রচণ্ড ক্রিয়ায় রোগীর মৃত্যু হয়।
বৈদ্যুতিক শক্তির সাহায্য নেবার প্রসঙ্গে আমার আর একটা কাহিনী মনে পড়ছে। কাহিনীটি অদ্ভুত ধরণের হলেও বহুপরিচিত। ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দে লণ্ডনে এক আইনজীবী যুবককে দু’দিন পরে কবর থেকে বার করে এই প্রক্রিয়ায় বাঁচিয়ে তোলা হয়। ঘটনাটা এমন ভাবে প্রচারিত হয়েছিল যে লণ্ডনে যে কোন আলোচনার বিষয়বস্তুই ছিল তখন এই জীবনদান প্রসঙ্গ।
মিঃ এডওয়ার্ড স্টেপলটন টাইফয়েড আর তার আনুষঙ্গিক কতকগুলো উপসর্গের কবলে পড়ে মারা যান। মৃত্যুর সময় তার ঐ বিশেষ উপসর্গগুলো সম্পর্কে চিকিৎসকেরা অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠেন, তাই মৃত্যুর পর দেহের ওপর অপারেশন করে পরীক্ষা করার জন্যে তার বন্ধুবান্ধবদের অনুমতি চাওয়া হয়। সে অনুমতি কিন্তু পাওয়া গেল না। এ সব ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা কবর থেকে শবদেহ বার করে এনে পরে সময়মতো অপারেশনের সাহায্যে ওঁদের পরীক্ষার কাজ করেন। লণ্ডনে মৃতদেহ বার করে দেবার লোকের অভাব নেই। ওদেরই কারো সাহায্যে মৃত্যুর তিনদিন পরে আটফুট গভীর কবর থেকে স্টেপলটনের মৃতদেহ বার করে একটা বেসরকারী হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে আসা হয়।
মৃতদেহের পেটের ওপর ছুরি দিয়ে একটুখানি কাটার পর দেখা যায় যে দেহের বিন্দুমাত্র বিকৃতি ঘটেনি। সেই মুহূর্তে ব্যাটারী লাগিয়ে বৈদ্যুতিক শক্তি সঞ্চারের চেষ্টা করেন চিকিৎসকেরা। বার বার চেষ্টা করে দেখা গেল দেহের মধ্যে কয়েকবার আক্ষেপ সৃষ্টি করা ছাড়া এই প্রক্রিয়াগুলিতে অন্য ফলোদয় হচ্ছে না।
নানারকম পরীক্ষায় অনেক সময় অতিবাহিত হয়েছিল। তখন প্রায় ভোর হয় হয়। স্থির করা হল যে আর কালবিলম্ব না করে শবব্যবচ্ছেদের কাজ শুরু করা দরকার। একটি ছাত্র কিন্তু এই পরীক্ষায় খুব উৎসাহী ছিল। তার এ সম্বন্ধে কতকগুলো নিজস্ব ধারণা ছিল। সে আর একবার বুকের পেশীগুলিতে বৈদ্যুতিক শক্তি সঞ্চার করে ফলাফল পরীক্ষা করে দেখতে চাইল। তাড়াতাড়ি বৈদ্যুতিক ক্রিয়া সঞ্চারিত করাও হল। মৃতব্যক্তি সেই মুহূর্তে টেবিলের ওপর থেকে নেমে মেঝেতে পায়চারী আরম্ভ করলেন, আর এদিক ওদিকে দেখার পর কথাও বললেন। ওঁর কথা বোঝা যাচ্ছিল না, তবে উচ্চারণে কোন জড়তা ছিল না। কিছুক্ষণ এইভাবে কথা বলার পর উনি মেঝের ওপর আছড়ে পড়লেন।