তালিকায় দেখলাম উনি নিজের, স্ত্রীর অর দুই বোনের টিকিট কেটেছেন। ওঁর নাম তিনখানা কামরার গায়ে লাগানো আছে দেখা গেল। কামরাগুলো বেশ বড়, প্রত্যেকটাতে একটার ওপর আর একটা এই ভাবে দুটো করে শোবার জায়গা আছে। শোবার জায়গাগুলো এত ছোট নয় যাতে একজন শুতে পারেনা, তবুও চার জনের জন্য তিনখানা কামরা ভাড়া যে কেন করা হয়েছিল বুঝতে পারলাম না। ঐ সময়টাতে নিতান্ত ছোটখাট জিনিস নিয়েও আমি বড় বেশী কৌতূহলী হয়ে উঠতাম। আমার স্বীকার করতে লজ্জা হচ্ছে যে জাহাজের কামরার সংখ্যা নিয়ে আমি অযৌক্তিক আর বিশ্রী কতকগুলো অনুমান করতে শুরু করেছিলাম। এ নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন প্রয়োজনীয়তাই আমার ছিলনা তবু এই
সমস্যার সমাধান খুঁজে বার করবার জন্যে আমি তৎপর হয়ে উঠলাম। শেষে যখন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম তখন মনে হোল এই সমাধানে আমার অনেক আগেই পৌঁছনো উচিত ছিল। একটা কামরা নিশ্চয় চাকরের জন্য নেওয়া হয়েছে, বোকার মত এই সাধারণ কথাটা আমি আগে ভাবিনি। যাত্রীদের তালিকাটি আবার খুঁটিয়ে দেখলাম কিন্তু তাতে চাকরের উল্লেখ দেখলাম না। কিন্তু এটাও ঠিক যে ওঁরা সঙ্গে চাকর আনার সিদ্ধান্ত গোড়ায় নিয়েছিলেন। তালিকায় চাকরের নাম লিখে পরে তা কেটে দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই সঙ্গে কিছু বেশী মালপত্র আছে। আমার মনে হোল, ওঁর সঙ্গে এমন কিছু জিনিস অবশ্যই আছে যেগুলোকে উনি নিজের নজরে রাখতে চান। হতে পারে কিছু মূল্যবান ছবিই সঙ্গে আছে, ইতালীয় ইহুদী নিকোলিনোর সঙ্গে এই ছবি নিয়েই দরদস্তুর চলেছে হয়ত। যাই হোক এই কথাগুলো মনে হবার পর আমার সমস্ত কৌতূহল তিরোহিত হোল।
ওয়াটের দু’টি বোনকেই আমি জানতাম। ওরা বেশ বুদ্ধিমতী আর ভদ্র। ওয়াট সম্প্রতি বিয়ে করেছিলেন তাই তার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয়ের কোন সুযোগ আমার হয়নি। ওঁকে অবশ্য ওঁর স্ত্রী সম্বন্ধে খুব উৎসাহিত ভাবেই আমার সামনে আলোচনা করতে দেখেছি। উনি নাকি খুবই সুন্দরী, বুদ্ধিমতী আর মার্জিতরুচিসম্পন্ন। ওঁর সঙ্গে তাই পরিচয়ের জন্যে আমার খুব আগ্রহ ছিল।
যে চোদ্দ তারিখে আমি জাহাজে সব বিলিব্যবস্থা দেখতে গিয়ে ছিলাম সেদিন মিঃ ওয়াটদেরও আসার কথা বলে ক্যাপ্টেনের কাছে শুনলাম। আমার তাড়াতাড়ি ফিরে আসার কথা ছিল কিন্তু মিসেস ওয়াটের সঙ্গে পরিচয় হবে এই আশায় এক ঘণ্টারও বেশী সময় ওখানে অপেক্ষা করলাম। শেষ পর্যন্ত তিনি এলেন না। কৈফিয়ৎ শোনা গেল, তার শরীর সুস্থ নয়। আগামী কাল জাহাজ ছাড়ার সময় তিনি এসে পৌঁছবেন।
পরের দিন হোটেল থেকে জাহাজ ঘাটে যাবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছি এমন সময় ক্যাপ্টেন হার্ডি এসে হাজির। তিনি বললেন, ‘বিশেষ কারণে’ ( কথাগুলো একদম বাজে। লোকে সুবিধেমত ব্যবহার করে এগুলোকে!) ইণ্ডিপেণ্ডেল’ দিন দুই যাত্রা স্থগিত রাখছে। সব ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেলে ওঁরা আমাদের খবর দিয়ে যাবেন। বিশেষ কারণ’ কথাটায় আমার ভীষণ বিরক্তি বোধ হোল। দক্ষিণের বাতাস বইছিল। আবহাওয়া সুন্দরই ছিল। তবু আমার কিন্তু কিছুই করার ছিল না তাই বাড়ী ফিরে বিরক্তি আর অধৈর্য মানসিক অবস্থাটাকে একান্তে শান্ত করে তুললাম।
প্রায় এক সপ্তাহ ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে কোন খবর এলো না। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত খবর এসে পৌঁছল আর সঙ্গে সঙ্গেই আমি রওনা হয়ে গেলাম। জাহাজের ওপর তখন বেশ ভীড়। জাহাজ ছাড়বে তার জন্য সব দিকেই ব্যস্ততা। আমার পৌঁছনোর প্রায় মিনিট দশেক পরে মিঃ ওয়াট তার লোকজন নিয়ে পৌঁছলেন। সঙ্গে ছিল দু’ বোন আর স্ত্রী। তার কিন্তু মেজাজের মধ্যে সেই অসামাজিক ভঙ্গীটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যাকে আমি মানবদ্বেষি বলেই অভিহিত করেছি। এ সব অবস্থার সঙ্গে আমার পরিচয় কম ছিল না তাই আমিও মোটেই মনোযোগ দিলাম না। উনি তার স্ত্রীর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন না। ওঁর বোন মেরিয়ান বেশ বুদ্ধিমতী আর মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে। দায়িত্বটা শেষ পর্যন্ত ওই গ্রহণ করল। অল্প কয়েকটা কথা বলে তাড়াতাড়ি পরিচয়ের পর্ব চুকিয়ে ফেলল সে।
মিসেস ওয়াট ওড়নায় মুখ ঢেকে রেখেছিলেন। আমার স্বীকার করতে বাধা নেই যে আমার নমস্কারের প্রতি-নমস্কার জানাতে গিয়ে উনি ওড়নাটা তুলতেই আমি ভীষণ বিস্মিত হলাম। বন্ধুর আগ্রহের অতিশয্যে চিত্রকর-সুলভ বর্ণনার অতিরঞ্জন সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতাই ছিল আমার তাই এ ক্ষেত্রে আমার বিস্ময়ের পরিমাণ বরং কমই হয়েছিল বলা চলে। বিষয় বস্তু যদি সৌন্দর্যসম্পর্কিত হয় তাহলে কল্পনার আবেগে তিনি কতখানি তাকে আদর্শায়িত করতে পারেন তা আমার জানা ছিল।
সত্যি কথা বলতে কি মিসেস ওয়াটকে আমি সুন্দরী ভাবতেই পারলাম না। তিনি কুৎসিত না হলেও তারই কাছাকাছি বলা যায় তাঁর রূপকে। পোষাক পরিচ্ছদ ছিল অবশ্য অত্যন্ত উঁচু স্তরের। আমার এই ধারণাই হল যে এই মহিলাটি তাঁর সদ্গুণাবলী আর বুদ্ধিমত্তার সাহায্যেই আমার বন্ধুর হৃদয় জয় করে থাকবেন। অল্প কয়েকটা কথা বলে উনি মিঃ ওয়াটের সঙ্গে তাঁর কামরায় চলে গেলেন।
আমার সেই চিরন্তন কৌতূহল ততক্ষণে ফিরে এসেছে। আমি নিশ্চিত হলাম যে ওঁদের সঙ্গে চাকর নেই। এবার তার বাড়তি জিনিস পত্রের খোঁজ নিলাম। কিছুক্ষণ পরে একটা ঠেলা গাড়ীতে কাঠের একটা চারকোনা বাক্সএলো। বেশ বুঝলাম ঐটি ছাড়া ওঁদের আর কোন জিনিস আসার ছিল না। যাই হোক এর পরই জাহাজ ছেড়ে দিল আর অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা বারদরিয়ায় গিয়ে পৌঁছলাম।