‘এ ভীতি নতুন কিছু নয় কিন্তু তারই সঙ্গে হঠাৎ একটা নতুন আশার আলোও যেন দেখলাম আমি। এই মুহূর্তে যে সব ঘটনা খুঁটিয়ে দেখছিলাম সেগুলো আর আমার পূর্বস্মৃতি এই আশা গড়ে তুলছিল। লোফোডেন দ্বীপের উপকূলে যে সব ভেসে থাকার উপযোগী বস্তুকে ছড়িয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি, সেগুলোই আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলে যে মস্কো-আবর্ত বহু জিনিস টেনে নেয় ঠিকই কিন্তু পরে সেগুলোকে তীরভূমিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। জিনিস গুলোর অধিকাংশই অস্বাভাবিক ভাবে ভাঙাচোরা অবস্থায় ফিরে আসে কিন্তু কিছু জিনিস দেখেছি, যেগুলির গায়ে আঁচড়ের দাগও পড়েনি। এর অর্থ আমি ঠিক ঠিক বুঝতে পারিনি। ভেবেছি, এমন হতে পারে যে কিছু জিনিস এত ধীরে ধীরে আবর্তের ভেতর দিয়ে নেমেছে যে শেষ পর্যন্ত সেগুলো তলায় পৌঁছয়নি অথচ ইতিমধ্যে জোয়ার এসে গেছে। হয়ত এগুলো আবর্তের মধ্যে এসেছে কিছু পরে। অন্যদিকে যে জিনিসগুলো প্রথমেই ওর ভয়ঙ্কর আবর্তের মধ্যে এসে পড়েছে সেগুলো একেবারে তলিয়ে গিয়েছিল, তাই ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গিয়েছে। ব্যাখ্যা যাই হোক না কেন এ কথাও আমার মনে হয়েছে যে সেই আবর্ত সব জিনিসই আবার সমুদ্রের ওপর টেনে তুলেছে। আরও তিনটি মূল্যবান বিষয় আমি সাবধানতার সঙ্গেই লক্ষ্য করেছিলাম। প্রথমত বড় জিনিসগুলো ঘণাবর্তের তলায় নামে সবচাইতে তাড়াতাড়ি, দ্বিতীয়ত একই ওজনের জিনিস হলেও গোলাকার বস্তু অধিকতর দ্রুতবেগে তলদেশে নেমে যায় আর তৃতীয়ত লম্বা বা বেলনাকার জিনিস নামে সব চাইতে মন্থরগতিতে।
‘বেঁচে ফিরে আসার পর আমি এখানকার একজন স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে বেশ কয়েকবার আলোচনায় বসেছি। প্রকৃতপক্ষে গোলাকার’ ‘বেলনাকার’ এ শব্দগুলো আমি ওঁর কাছ থেকেই পেয়েছিলাম। যদিও আমি ব্যাখ্যাগুলো সবই ভুলে গিয়েছি, উনি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, আকৃতি স্বাভাবিকভাবেই গতি নিয়ন্ত্রিত করে। উনিই বলেছিলেন যে লম্বা বা বেলনের মত জিনিস যদি আবর্তের মধ্যে পড়ে তাহলে সেটাই চোষণের পথে সবচাইতে বেশী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। অন্য যে কোন আকারের বস্তু অনেক সহজে চোষণের বলি হয়ে যায়।
‘একটা বিস্ময়কর পরিবেশই মূলত আমাকে এইসব খুটিনাটি জিনিসগুলোকে সযত্নে লক্ষ্য করতে উৎসাহিত করেছিল। আমরা যখন আমাদের নৌকো নিয়ে পাক খেয়ে চলেছিলাম তখন প্রত্যেকবার আবর্তনের সময় আমি পিপে, নৌকোর ভগ্নাংশ ইত্যাদি নানাধরণের জিনিস আমাদের পাশে পাশে দেখছিলাম। একটু পরে দেখেছি ওগুলো অনেক ওপরে থেকেই গিয়েছে। এত ওপরে যে মনে হয়েছে ওগুলো আদপে নামেইনি।
‘সেই সঙ্কটজনক মুহূর্তে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে আমি একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম। স্থির করলাম নৌকোর বাঁধন থেকে পিপেটাকে আলগা করে দিয়ে ওটাকে অবলম্বন করেই ভেসে যাব। পাশ দিয়ে একটা পিপে ভেসে চলেছিল। দাদার দৃষ্টি ওটার দিকে আকর্ষণ করে ওঁকে নানারকম ইঙ্গিত করে বোঝাতে চাইলাম যে আমি পিপেটাকে নিয়ে ভেসে পড়তে চাইছি। অনেক চেষ্টার পর মনে হল তিনি ব্যাপারটা বুঝলেন। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক নৌকোর লোহার অংশটা ছেড়ে উনি অন্য কোন অবলম্বন গ্রহণ করতে রাজী হলেন না। মাথা নেড়ে ওঁর অসম্মতি জানিয়ে দিলেন আমাকে। জোর করে তাকে দিয়ে কিছু করানোর প্রশ্নই ছিল না তখন। ব্যাপারটা এমনি গুরুতর যে বিন্দুমাত্র বিলম্বও তখন বিপজ্জনক। যে দড়িগুলো দিয়ে পিপেটা বাঁধা ছিল তাড়াতাড়ি সেইগুলো খুলে নিয়ে ওগুলো দিয়েই নিজেকে পিপের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে ফেললাম.। এরপর দাদাকে তার ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়ে পরমুহূর্তেই জলে গড়িয়ে পড়লাম।
‘আমি যা আশা করেছিলাম, ফলটা মোটামুটি দাঁড়ালো সেই রকমই। বুঝতেই পারছ যে আমি রক্ষা পেয়ে গেলাম আর সেই জন্যেই আজ এখানে বসে তোমাকে আমার অভিজ্ঞতার গল্প শোনাতে পারছি। কী ভাবে আমি রক্ষা পেলাম সেটা তুমি নিশ্চয় এখন অনুমান করতে পারছ। আর অল্প কয়েকটা কথা বলেই আমি কাহিনীটা শেষ করছি। মনে হয় নৌকো থেকে গড়িয়ে পড়ার পর ঘণ্টাখানেক পরে নৌকোটা হঠাৎ সোজা আবর্তের তলার দিকে দ্রুতবেগে নেমে গেল আর আমার দাদাকে নিয়ে ওর নিঃসীম গভীরতার মধ্যে তিন চারবার পাক খেয়ে চিরদিনের মত তলিয়ে গেল। এদিকে আমি যেখানটায় নৌকো থেকে লাফিয়ে পড়েছিলাম সেখান থেকে আবর্তের তলার যতখানি দূরত্ব, এই এক ঘণ্টার মধ্যে আমি তার বড় জোর অর্ধেকটা পাক খেয়ে এসেছি মাত্র। ইতিমধ্যে আবর্তের মধ্যে একটা বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম আমি। ফানেলের মত ঘূর্ণাবর্তের খাড়াই অংশটা ধীরে ধীরে ছোট হয়ে এলো আর সেই সঙ্গে যে উন্মত্ত গতিবেগে সমুদ্রের জল এতক্ষণ আবর্তিত হচ্ছিল তার গতিও যেন অনেকখানি স্তিমিত হয়ে এলো। সেই ঘন কুয়াশা, সেই রামধনু সবই কোথায় মিলিয়ে গেল আর আবর্তের নীচের অংশটা হু হু করে উঁচু হয়ে উঠতে লাগল। আকাশ তখন পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে আর বাতাস পুরোপুরি থেমে গেছে। পূর্ণিমার উজ্জ্বল চাঁদ পশ্চিম দিগন্তে তখনো কিন্তু অকৃপণ ভাবেই আলো ছড়িয়ে চলেছে। হঠাৎ মনে হোল আমি সমুদ্রের ওপর এসে পড়েছি আর একটু দূরেই দেখতে পাচ্ছি লোফোডেন দ্বীপটাকে। কিছুক্ষণ আগে অবধি মস্কো-ঘূর্ণাবর্তটা যেখানে ছিল সে জায়গাটাকেও আমি বেশ চিনতে পারছিলাম। তখন ভাটার সময়, তবু ঝড়ের দরুণ যে বিশাল ঢেউ তৈরী হয়েছিল তারই সাহায্যে খুব তাড়াতাড়ি আমি উপকুলে এসে পড়লাম। একটা নৌকো যখন আমাকে জল থেকে তুলে নেয় তখন কিন্তু আমি ক্লান্ত আর বাক্শূন্য। এর কারণ হয়ত বা পরিবেশের ভয়াবহতা। যারা আমাকে টেনে তুলেছিল তারা আমার চিরদিনের সঙ্গী, আমার পুরোনো বন্ধু। কিন্তু মৃত্যুর রাজ্য থেকে প্রত্যাবৃত আমাকে চেনা তাদের পক্ষে কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। একদিন আগে যে চুল দাঁড়কাকের মত মিশমিশে কালো ছিল সে সব চুল সাদা হয়ে গিয়েছিল। ওরা বলে যে আমার মুখের আকৃতিটাই নাকি পুরো বদলে গিয়েছে। ওদের আমি এ কাহিনী শুনিয়েছি কিন্তু ওরা এর একবর্ণও বিশ্বাস করতে পারেনি। আজ আমার কাছ থেকে এ কাহিনী শোনার পর তুমিও লোফোডেনের জেলেদের মত একে অবিশ্বাস্য ভাববে কিনা জানিনা।
চারকোণা বাক্স
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। আমি নিউইয়র্ক যাবার জন্য চার্লেস্টন থেকে ক্যাপ্টেন হার্ডির ‘ইণ্ডিপেন্সে’ জাহাজে টিকিট কেটেছি। আবহাওয়া ভালো থাকলে জুনের পনেরো তারিখে আমাদের রওনা হবার কথা তাই চোদ্দ তারিখেই আমি জাহাজে গেলাম কতকগুলো ব্যবস্থা পাকা করে নেবার জন্যে। গিয়ে দেখি জাহাজের যাত্রী অনেক আর মহিলা যাত্রীর সংখ্যা একটু অস্বাভাবিক রকমের বেশী । তালিকায় অনেকগুলি পরিচিত নাম দেখে খুশী হলাম। বিশেষ করে মিঃ কর্ণেলিয়াস ওয়াটের নাম দেখে খুব ভালো লাগল। এই তরুণ চিত্রকরটি ছিলেন আমার প্রিয় বন্ধু । একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একত্রে থেকেছি আর লেখাপড়া করেছি। উনি প্রতিভাবান ব্যক্তি, ওঁর চরিত্রের মধ্যে একই কালে কিন্তু উৎসাহ, সংবেদনশীলতা আর মনুষ্যদ্বেষিতা দেখেছি। এ সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তার গভীর আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার। এ ধরনের মানুষ খুব অল্পই দেখা যায়।