আংটাটা খুবই ছোট ছিল। দু’জনের পক্ষে ওটা ধরা সম্ভব ছিল না।’ দাদা ভয়ের তাড়নায় আমার হাতটা খুলে দিয়ে নিজেই রিংটা ধরতে চাইলেন। ও অবস্থায় মানুষ সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে যায়। দাদার ব্যবহারে সেই রকম বিচারবুদ্ধিহীন উন্মত্ততাই প্রকাশ পাচ্ছিল। অস্বীকার করব না, দাদার ওরকম আচরণ দেখে সে মুহূর্তে আমি খুবই দুঃখ পেয়েছিলাম। আত্মরক্ষার ঐ অবলম্বনটুকু নিয়ে দাদার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামার কোন প্রশ্ন আমার দিক থেকে ছিলই না। মনে হচ্ছিল, আমাদের মধ্যে যে কেউ একজন ওটা ধরে বাঁচার চেষ্টা করুক, তাতে ক্ষতি কী? দাদাকে আংটাটা ছেড়ে দিয়ে আমি পিপেটার দিকে চলে গেলাম। আবর্তের প্রচণ্ড ঘূর্ণির মধ্যে নৌকোটা যেন উড়ে চলেছিল। মাঝে মাঝে ভীষণভাবে দোল খেলেও পিপেটার দিকে চলে যেতে আমার খুব অসুবিধা হয়নি। ওখানে পৌঁছবার পরই হঠাৎ একটা প্রবল ঝাঁকুনি খেয়ে নৌকোটা ডানদিকে ঘুরে গেল আর তীব্র বেগে আবর্তের তলায় নেমে যেতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যেই মনে হল, এবার সব শেষ! নীরবে আমি শেষবারের মত ঈশ্বরকে স্মরণ করলাম।
‘পাতালে নেমে যাবার সেই সুতীব্ৰ গতি সহ্য করতে পারছিলাম না। আমি চোখ বন্ধ করে প্রাণপণ শক্তিতে পিপেটা আঁকড়ে পড়ে থাকলাম। চোখ খুলে কোন কিছু দেখবার মত সাহস আমার ছিল না। মৃত্যু যে অনিবার্য তা জেনেছিলাম। কিন্তু তখনো জলের তলায় গিয়ে পড়িনি আর মরণ-লড়াই শুরু হয়নি কেন সেইটেই বরং তখন আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। বেশ কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল কিন্তু তখনও আমি জীবিত। আমরা যে কোথাও ভীষণ বেগে নেমে যাচ্ছি, এই অনুভূতিটা চলে গিয়েছিল। নৌকোটা এখন আড়াআড়ি ভাবে পাক খেয়ে চলেছিল। একটুখানি সাহস সঞ্চয় করে দৃশ্যটাকে আর একবার আমি দেখে নেবার চেষ্টা করলাম।
‘আমার চারদিকের দৃশ্যাবলীকে কী পরিমাণ বিস্ময়, ভীতি আর শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে সেদিন দেখেছিলাম তা আমি জীবনে ভুলবো না। কালো রঙের একটা অবিশ্বাস্য আয়তনের ফানেলের মসৃন উজ্জ্বল ঘূর্ণায়মান দেহের মধ্যে আমরা দ্রুতবেগে পাক খাচ্ছিলাম। স্বল্পায়তন মেঘনিমুক্ত আকাশ থেকে পূর্ণচাঁদের আলো ঝরে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল অতলস্পর্শী গহ্বরের তলদেশ পর্যন্ত কালে দেয়ালের ওপর সোনালী আলোর বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
‘সব কিছু খুঁটিয়ে দেখবার মত শক্তি বোধহয় আমার প্রথমটা ছিল না। তার জন্য দায়ী আমার তদানীন্তন বিভ্রান্ত অবস্থা। ভয়াবহ সৌন্দর্যের মহৎ প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই তখন চোখে পড়েনি। একটু সামলে নেবার পর আমার দৃষ্টি পড়ল নীচের দিকে। নৌকোটা জলের দেয়ালে প্রায় ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল, তাই নীচের দিকে তাকাতে আমার সামনে কোন বাধাই ছিলনা। প্রায় পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী কোনে নৌকোটা ঝুলছিল আর পাক খাচ্ছিল প্রচণ্ড বেগে। তাই পিপেটাকে আঁকড়ে ধরে থাকতেও ভীষণ অসুবিধে হচ্ছিল আমার।
‘চাঁদ তার আলো পাঠিয়ে ঘূর্ণাবর্তের তলদেশ পর্যন্ত অনুসন্ধান করতে চাইছিল কিন্তু তা সম্ভব ছিল না। আমিও তলার দিকে একটা ঘন কুয়াশার আস্তরণের জন্যে কিছুই স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছিলাম না। এই কুয়াশা বা জলকণাবাহী বাতাস সম্পর্কে এইটুকুই বোধহয় বলা যায় যে ঘূর্ণাবর্তের প্রচণ্ড আঘাতে তার তলদেশেই এর সৃষ্টি হচ্ছিল। কিন্তু সেই গাঢ় কুয়াশার ভেতর থেকে স্বৰ্গমুখী যে বিপুল আর্তনাদ উত্থিত হচ্ছিল তার কোন বর্ণনা দেবার চেষ্টাই আমি করব না।
‘সমুদ্রের ফেনবহুল উপরিভাগ থেকে আবর্তের তলায় আমরা অনেকখানি দূরত্ব অতিক্রম করে এসেছি বটে, কিন্তু বাকী পথটুকু ঠিক ঐ হারে নামছিলাম না। দুলতে দুলতে, কাঁপতে কাঁপতে আমরা পাক খেয়ে তলায় নামছিলাম। এর ফলে কখনো চলেছিলাম কয়েকশ’ ফুট কখনও বা পুরো আবর্তটাকেই একবার প্রদক্ষিণ করে আসছিলাম। এখনকার গতি তুলনামূলক ভাবে ছিল মন্থর কিন্তু প্রতিটি মুহূর্তকে অনুভব করতে পারছিলাম নিবিড় ভাবে।
‘বিশাল পরিধির কালো জলাবর্তের মধ্যে যখন আমরা এইভাবে বাহিত হয়ে চলেছিলাম তখন আমার চারদিকে তাকিয়ে একসময় দেখলাম যে ঘূর্ণায়মান বস্তু শুধুমাত্র আমার নৌকোটাই নয়, ওপরে আর নীচে বহু ভাঙাচোরা বস্তুই দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার নজরের মধ্যে আসছিল নৌকোর বড় বড় কাঠ, গাছের গুঁড়ি আর সঙ্গে অনেক ছোট ঘোট জিনিস, যেমন ভাঙা আসবাব, বাক্স তোরঙ্গ, লাঠি, পিপে এমনি ধারা কত কি। ভয়ের পরিবর্তে তখন আমার মনে অস্বাভাবিক কৌতূহল। ভয়ঙ্কর মৃত্যুর সুনিশ্চিত মুহূর্তের দিকে যতই আমি অগ্রসর হচ্ছিলাম ততই যেন ক্রমশ বেশী পরিমাণে ঔৎসুক্য বেড়ে চলেছিল আমার। আমাদের সঙ্গে আর যে সব জিনিস ঘুর্ণাবর্তের তলায় নেমে চলেছিল সেগুলো অদ্ভুত জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিয়ে দেখছিলাম আমি। কোন কোন জিনিস ঠিক কতখানি বেগে নেমে চলছিল সেইটে লক্ষ্য করে বেশ আনন্দ হচ্ছিল। সম্ভবত আমি উন্মাদই হয়ে গিয়েছিলাম। এক সময় বোধহয় বলে উঠলাম, এ ফার গাছটা এইবার ঠিক ভীষণ একটা ডুব দিয়ে তলিয়ে যাবে–ওটাকে আর দেখাই যাবে না। আমি দেখলাম যে আমার হিসেব মিললো না। একটা জাহাজের ভাঙা অংশ কোত্থেকে হঠাৎ এসে পড়ল আর ফার গাছটার আগেই ওটা ছুটে গিয়ে ঘণাবর্তের তলায় চিরদিনের মত হারিয়ে গেল। অনুমানের পর অনুমান করে চলেছি আর আমারই হিসেবের ভুলে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আমি হেরে যাচ্ছি, ঠিক এমনি অবস্থায় আবার আমি ভয়ে প্রায় আড়ষ্ট হয়ে পড়লাম।