‘এতক্ষণ আমরা ঢেউয়ের মাথায় মাথায় দোল খেয়ে চলেছিলাম। বড় একটা অসুবিধে হয়নি, হঠাৎ এক সময় নৌকোটা যেন ঢেউয়ের মাথায় চেপে শূন্যে আকাশের দিকে উঠে গেল। সে উচ্চতা আমার কাছে অকল্পনীয় ছিল। ঠিক পর মুহূর্তেই আমরা যেন পিছলে নেমে চললাম অত্যন্ত দ্রুতবেগে বিরাট একটা গহ্বরের মধ্যে। স্বপ্নে উঁচু পাহাড় থেকে তলায় পড়বার সময় যেমন হয় আমার তেমন মাথা ঝিম্ ঝিম্ করছিল। কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করছিলাম দেহে মনে। নৌকোটা যখন উঁচুতে ছিল তখনই আমি এক পলক দেখে নিয়েছিলাম পুরো অবস্থাটা। আর তাতেই পরিস্থিতির গুরুত্ব আমি পরিষ্কার ভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। মস্কো আবর্ত থেকে আমরা তখন বড় জোর সিকিমাইল দূরে। সাধারণ আবর্ত সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা কম ছিল না। কিন্তু এটা যে তা ছিল তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। সে একটা অভূতপূর্ব আবর্ত। তার সর্বধ্বংসী স্বরূপ মানুষের স্বপ্নেরও অগোচর। আমরা কোথায় আর কীইবা আমাদের ভাগ্যে ঘটতে চলেছে, সব কিছু যেন আমি স্পষ্টই ভেবে নিতে পারছিলাম। ভীতির অস্বাভাবিক প্রচণ্ডতায় অনিচ্ছাকৃতভাবে আমার চোখগুলো বন্ধ হয়ে এলো। দৈহিক আক্ষেপের সময় যেমন হয়, অনেকটা প্রায় সেইরকম, আমার চোখের পাতাগুলো ভারী হয়ে চেপে বসে গেল।
‘মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ঢেউ শান্ত হয়ে এলো আর পুরো এলাকাটা ফেনায় ভরে গেল। আমাদের নৌকোটা হঠাৎ বাঁদিকে মোড় নিয়ে ভিন্ন একটা দিকে বিদ্যুতের মত ছুটে চলল। তীব্র আর তীক্ষ্ণ প্রচণ্ড একটা শব্দের মধ্যে সমুদ্রের গর্জন তলিয়ে গেল। ওরকম শব্দের কোন তুলনা নেই। হাজার হাজার জাহাজ যদি একই মুহূর্তে তাদের জলের পাইপগুলো খুলে দেয় আর সেই সঙ্গে ছেড়ে দেয় জমে ওঠা বাষ্প, তাহলে যে ধরণের শব্দ হতে পারে সেইটে ভেবে নাও। ঘূর্ণাবর্তের চারদিকে যে ডুবো পাহাড়ের অঞ্চল আমরা তখন সেইখানে। যে অবিশ্বাস্য গতিতে আমাদের নৌকো ছুটে চলেছে তাতে আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে যে আমরা আবর্তের তলায় তলিয়ে যাব, তা বুঝতে আর কোন অসুবিধেই ছিল না। নৌকোটা না ডুবে জলের ওপর বুদ্বুদের মত উঁচু ঢেউয়ের ওপর ভেসে চলেছিল। নৌকোটার সবদিকেই ছিল সেই ভয়ঙ্কর ঘূর্ণাবর্ত, তার বিরাট আকৃতির আড়ালে দিচক্র বালও হারিয়ে গিয়েছিল।
‘অসম্ভব মনে হলেও কথাটা ঠিক যে ঐ বিরাট আবর্তের মুখোমুখি এসেও আমি অনেকখানি মানসিক স্থৈর্য বজায় রাখতে পেরেছিলাম। যে ভীতি আমার বিচারবুদ্ধিকে সম্পূর্ণভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল, মৃত্যু অবধারিত জেনেও তার বোঝ যেন মনের ওপর থেকে নেবে গেল। হতে পারে যে চূড়ান্ত হতাশাই আমাকে কিছুটা মনোবল ফিরিয়ে দিয়েছিল।
‘অহঙ্কার নয়, সত্যিই মনে হোল যে এই বিরাট নৈসর্গিক ঘটনার মধ্যে মৃত্যুরও একটা গৌরব আছে। ঐশ্বরিক শক্তির এই অকল্পনীয় বিশালতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ক্ষুদ্র ব্যক্তিজীবনের নিরাপত্তা চিন্তা করাই মূর্খত। হঠাৎ ঐ ঘূর্ণিটার সম্পর্কেই ভীষণ কৌতূহলী হয়ে উঠলাম আমি। চরম ত্যাগের মূল্যেও ওর তলদেশে পৌঁছে সব কিছু আবিষ্কার করার একটা বাসনা মনের মধ্যে আকস্মিকভাবে জেগে উঠল। দুঃখ হচ্ছিল একটা কারণেই আমার এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার স্বরূপ কোনদিনই কাউকে বর্ণনা করে বোঝাতে পারব না। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এ ধরণের চিন্তা বোধহয় বাতুলেও করে না, তবু বারবার মনে হয় সেদিন আবর্তের চারদিকে নৌকোয় প্রদক্ষিণ করতে করতে আমি হালকা ভাবেই অনেক কিছু চিন্তা করতে পারছিলাম।
‘বাতাস পুরো থেমে গিয়েছিল। তা ছাড়া ঘূর্ণাবর্তের ভেতরে যে গভীরতার সৃষ্টি হয়, সমুদ্রের অত নীচে বাতাস গিয়ে পৌঁছতেও পারে না। হয়তো এর জন্যেও আমার চিন্তার মধ্যে কিছুটা স্থৈর্য এসেছিল। আমাদের চারদিকে আবর্তের বহিবৃত্তটি তখন কালো পাহাড়ের মত আকাশচুম্বী উচ্চতা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ঝড়ের সময় সমুদ্রের ভেতর ঢেউয়ের প্রচণ্ডতা আর ছড়িয়ে পড়া জলের অজস্রতা সাধারণ ভাবেই যে কোন মানুষকে বিহ্বল করে ফেলে। সে অবস্থা
অনুমান করাও সম্ভব নয়। ওরকম অবস্থা মানুষকে শুধু অন্ধ আর বধিরই করে তা নয়, মানুষের সে অবস্থায় শ্বাসরোধ হয়ে আসে, কর্ম আর চিন্তাশক্তিও নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের কিন্তু তা হয়নি। হয়ত বা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামীদের যেভাবে সেলের মধ্যে ওদের খুশী। মতো যে কোন কাজই করতে দেওয়া হয়, অন্য বন্দীদের মতে বাধা নিষেধ আরোপিত হয় না, আমাদেরও সেই সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।
‘আমরা আবর্তের মতো ক’টা পাক খাচ্ছিলাম তা মনে রাখা বা বলা সম্ভব ছিল না। ঠিক ভাসমান না বলে বরং বলা চলে উড়ন্ত অবস্থায় পাক খাচ্ছিলাম প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে। আর পাক খেতে
খেতে ঘূর্ণির ভীতিপ্রদ তলার দিকে নেবে চলেছিলাম। লোহার আংটাটা তখন আমি ছেড়ে দিইনি। আমার দাদা ছিলেন নৌকোর পেছনের দিকে। উনি জলরাখা একটা মস্ত বড় খালি পিপে আঁকড়ে পড়ে ছিলেন। নৌকোর পাটাতনের ওপর আর কোন বস্তুই ছিল না। পিপেটা খুব শক্ত করেই পাটাতনের সঙ্গে বাঁধা ছিল। ঝড়ের প্রথম ধাক্কায় ঐ পিপেটা ছাড়া অন্য সব জিনিসই সমুদ্রে ভেসে গিয়েছিল । আমরা যখন আরও তলায় নেমে যাচ্ছি হঠাৎ দাদা পিপেটা ছেড়ে দিয়ে আমি যে রিংটা ধরে ছিলাম সেইটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন।