‘হঠাৎ এক সময় বাতাস স্তব্ধ হয়ে গেল। আমরাও নির্দিষ্ট গতি হারিয়ে সমুদ্রের বুকে এদিক ওদিক ভেসে বেড়াতে লাগলাম। কিন্তু আমরা কোন অবস্থার মুখোমুখী হচ্ছি সে কথা ভাববার মত অবসরই পেলাম না। মিনিট খানেকের মধ্যেই ঝড় এসে পড়ল আর মিনিট দুয়েকের মধ্যে এমন ঘন কালো অন্ধকার নেমে এলো যে নৌকোর ভেতর আমরা পরস্পরের মুখও দেখতে পাচ্ছিলাম না।
‘সে ঝড়ের বর্ণনা দেবার শক্তি আমার নেই। নরওয়ের সবচেয়ে বৃদ্ধ নাবিকও নাকি এ ধরণের ঝড় দেখেননি জীবনে। আমাদের পালগুলো নামিয়ে ফেলার আগেই ঝড়ের প্রথম ধাক্কায় মাস্তুলগুলো এমনভাবে ভেঙে পড়ল যেন কেউ করাত দিয়ে ওগুলোকে কেটে ফেলেছে। ছোট ভাই বড় মাস্তুলটা আঁকড়ে ঝড় থেকে বাঁচতে চাইছিল। মাস্তুলের সঙ্গে সে সমুদ্রে ছিটকে পড়ল।
‘আমাদের নৌকোটা ছিল খুব হালকা। ওটা প্রায় পালকের মত জলের ওপর ভাসছিল। ওটার ওপর একটা পাটাতন ছিল আর ছিল তার মাথার দিকটায় একটুখানি ফাঁকা জায়গা। ঝড়ের মুখে পড়লে আমরা ঢেউয়ের আঘাত থেকে বাঁচবার জন্যে ওটা বন্ধই করে দিতাম। আমরা কিন্তু তখন এরকম একটা অবস্থার মধ্যে ছিলাম যে কোন কিছু করাই সম্ভব হচ্ছিল না। আমার বড় ভাই কী করে বেঁচে ছিলেন জানিনা, সে খোঁজ নেবার সুযোগই হয়নি আমার। পাল সহ মাস্তুল ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি পাটাতনের ওপর শুয়ে পড়েছিলাম আর সামনের মাস্তুলটার তলায় একটা লোহার আংটা ধরে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছিলাম। সহজাত প্রবৃত্তির বশেই আমি ওভাবে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু এ কথাও ঠিক যে ওই পদ্ধতিটা খুবই নির্ভরযোগ্য ছিল।
‘আমরা তখন পুরোপুরি জলের তলায়। প্রাণপণে দম আটকে রেখে লোহার আংটাটি আঁকড়ে ধরেছি আমি। ব্যাপারটা যখন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো তখন আমি ঐ অবস্থায় হাঁটুতে ভর দিয়ে মাথাটা তুলে দম নিতে চাইলাম। জল থেকে উঠে আসার সময় কুকুরগুলো যেভাবে শরীরটাকে নাড়া দেয়, আমাদের নৌকোটায় সেই রকম একটা প্রবল ঝাঁকি লাগল। আমার তখন কেমন যেন আচ্ছন্ন অবস্থা। তবু প্রাণপণ শক্তিতে ইন্দ্রিয়গুলোকে সজাগ রেখে অবস্থাটা বোঝবার চেষ্টা করছি আমি। হঠাৎ মনে হোল কে যেন আমার হাত ধরেছে। ভীষণ আনন্দ হোল আমার। আমি জানতাম আমার দাদা তখনো নৌকোয় আছেন। কিন্তু এ আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হোল না। দাদা কানের কাছে মুখ এনে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘মস্কো-আবর্ত’।
‘সেই মুহূর্তে আমার মানসিক অবস্থা কেমন হয়েছিল সে খবর আজ আর কারোর জানার কথা নয়। একটা দুঃসহ যন্ত্রণায় আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত থর থর করে কেঁপে উঠল। ঐ একটি শব্দ উচ্চারণ করে দাদা ঠিক কী বোঝাতে চাইছিলেন, মুহূর্তের মধ্যেই তা বুঝতে পেরেছিলাম আমি। বাতাসের পরিবর্তিত গতি তখন আমাদের টেনে নিয়ে চলেছিল সেই ঘূর্ণাবর্তেরই দিকে। কারোর শক্তি ছিল না যে আমাদের বাঁচায়।
‘তোমাকে বলেছি যে ঘূর্ণির এলাকা ছাড়িয়ে আমরা সাধারণত বেশ খানিকটা উজানে চলে গিয়ে ভাটার জন্যে অপেক্ষা করতাম। আবহাওয়া যখন শান্ত থাকত, আমাদের কাজের ধরণই ছিল ঐ রকম। এখন কিন্তু প্রচণ্ড ঝড়ের ধাক্কায় আমরা সোজাসুজি ঘণাবর্তের মধ্যে চলে যাচ্ছিলাম। একবার মনে হোল ভাটার টান শুরু হতে এখনো দেরী আছে। এই মুহূর্তে নিরাশ হবার মত কিছুই নেই। পরমুহূর্তে মনে হোল, আমি মূখের মতই আশা করছি । আমাদের সব শেষ হয়ে যেতে চলেছে, বিশাল আকৃতির যুদ্ধ জাহাজ থাকলেও এই মুহূর্তে রক্ষা পাওয়ার প্রশ্ন উঠত না।
‘মনে হোল ঝড়ের বেগ একটু কমেছে। হয়ত বা ঝড়ের আঘাতে অনুভূতি আর বিচারবুদ্ধিই লোপ পেয়ে গিয়েছিল। তবে সমুদ্রের চেহারা যে বদলে গিয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। অনেকখানি শান্ত আর ফেনবহুল সমুদ্র যেন বিরাট পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে উঠছিল। পরিবর্তন এসেছিল ওপরের আকাশেও। সেখানে ঘন কালো মেঘের মাঝখানে ছোট্ট একটা গোলাকার জায়গা থেকে মেঘ সরে গিয়ে গাঢ় নীলাকাশ আর পূর্ণিমার উজ্জ্বল চাঁদ বেরিয়ে পড়ল। চাঁদের এত আলো আমি বোধ হয় এর আগে কোন দিনই দেখিনি। চার পাশের সব কিছুই সেই আলোর স্পর্শে স্পষ্টতর হয়ে উঠল আর ভগবানই জানেন কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য আমার চোখের সামনে উদঘাটিত হোল!
‘দাদাকে দু’একটা কী যেন কথা বলতে ইচ্ছে হোল, বললামও কিছু দু’একবার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রচণ্ড গর্জনের মধ্যে সে কথা কোথায় ডুবে গেল। আমি অবশ্য ওঁর কানের কাছেই প্রাণপণে চেঁচাচ্ছিলাম। দেখলাম মৃত ব্যক্তির মত দাদার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। একটা আঙুল উচিয়ে উনি চীৎকার করে উঠলেন, ‘শুনছ?
‘প্রথমটা ঠিক বুঝতে পারিনি কোনটা শোনার কথা উনি বলছেন, পরমুহূর্তেই কিন্তু একটা ভয়ঙ্কর চিন্তায় আমি যেন আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। পকেট থেকে ঘড়িটা টেনে বার করে এনে সময়টা দেখতে চাইলাম। হায় ভগবান! ঘড়িটা সেই সাতটার সময় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ভাটার সময়ের অনেক পরে আমরা এখানে এসে পড়েছি, আর ঘূর্ণাবর্ত তার সমস্তটুকু প্রচণ্ডতা নিয়ে আমাদের আকর্ষণ করছে। কেঁদে উঠে আমি ঘড়িটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম জলে।
‘নৌকো যদি পাকাঁপোক্ত করে বানানো হয় আর বেশী বোঝ। চাপানো না থাকে তাহলে প্রবল ঝড়ের সময়ও সমুদ্রের ঢেউগুলো তার তলা দিয়ে পিছলে যায়। ডাঙার মানুষদের কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত ঠেকবে হয়ত কিন্তু নাবিকদের ভাষায় একেই ‘রাইডিং’ বা ঢেউতে দোল খাওয়া বলে।