‘এখন তুমি ঘর্নিটা আরও ভালোভাবেই দেখতে পাবে’, বললেন বৃদ্ধ। আর যদি চূড়োটার ওদিকে ঘুরে গিয়ে এই প্রচণ্ড শব্দটাকে কিছু পরিমাণে আড়াল করতে পার তা হলে আমি তোমাকে একটা গল্প শোনাই। গল্পটা শুনলে তবে গিয়ে তুমি বিশ্বাস করবে যে এই ঘূর্ণাবর্ত সম্পর্কে আমার সত্যিকারের কিছু অভিজ্ঞতা আছে।
বাতাস যে দিক থেকে বইছিল আমরা সেই দিকে ঘুরে গেলাম আর উনি তার কাহিনী শুরু করলেন।
‘আমার আর আমার দু’ভায়ের একটা প্রায় সত্তর টন ওজনের মাল বওয়ার উপযোগী দু’পাল-ওয়ালা বড় নৌকো ছিল। ওটা নিয়ে আমরা মস্কো পেরিয়ে ভাগের কাছাকাছি এলাকায় মাছ ধরতে যেতাম। একটু সাহস নিয়ে ওদিকের উত্তাল সমুদ্রে যেতে পারলে মাছ পাওয়া যেত প্রচুর। লোফোডেন উপকূলভাগের যারা বাসিন্দা তাদের মধ্যে আমরাই শুধু প্রায় নিয়মিত ভাবেই ও এলাকায় যেতাম। মাছ পাওয়ার অঞ্চলটা ছিল বেশ খানিকটা দক্ষিণদিকে। খুব একটা বিপদের ঝুঁকি না নিয়ে ওখানে সারাদিন মাছ ধরা যেত। আমরা তাই ওই এলাকাটাকেই বেশী পছন্দ করতাম। ওখানকার পাহাড়গুলোর মধ্যে আমাদের একটা বেশ পছন্দসই জায়গা ছিল। মাছ ওখানে ধরা পড়ত প্রচুর। ওখানে একদিনে আমরা খুব ভালো জাতের মাছ যে পরিমাণে পেতাম, অন্য জায়গায় এক সপ্তাহেও তা পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। পরিশ্রমের কথা ছেড়ে দিয়েও বলা যায় যে মরণ-বাচনের প্রশ্ন থাকলেও ওখানে মাছ ধরতে যাওয়াটা আমাদের প্রায় নেশায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আমাদের সাহসিকতার জন্য পুরস্কারও পেতাম প্রচুর।
‘শান্ত আবহাওয়ার সময় ওখানকার উপকূল থেকে প্রায় মাইল পাঁচেক দূরে ছোট্ট খাড়ির ভেতর নৌকোটাকে নিয়ে গিয়ে জোয়ার আর ভাটার মধ্যে যে মিনিট পনেরো সময় সমুদ্র শান্ত থাকে তারই মধ্যে মস্কো ঘূর্ণির কাছ বরাবর গিয়ে পড়তাম, আর অটার হোম বা স্যাণ্ডফ্লেসেনের কাছে নোঙর নামিয়ে দিতাম। ওখানকার ঘজিল অন্য জায়গার মতো বেশী ভয়ঙ্কর মনে হতো না। ঘূর্ণি থেমে যাওয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করতাম, তারপর রওনা হতাম বাড়ীর দিকে। আমরা প্রত্যেকবারেই বাতাসের সুযোগ নিতাম। আর এই বাতাসের সুযোগ প্রতিবারই এমন সুন্দর ভাবে গ্রহণ করতাম যে যাওয়া আসার পথে কোনদিনই কোন অসুবিধে আমাদের হয়নি। গত ছ’ বছরের মধ্যে বাতাসহীন থমথমে আবহাওয়ার দরুণ আমাদের দু’রাত ও এলাকায় কাটাতে হয়েছিল। আর একবার এমন অদ্ভুত ঝড়ের মধ্যে পড়েছিলাম যে প্রায় অনাহারে সপ্তাহখানেক আমাদের বন্দী হয়ে থাকতে হয়েছিল ওই এলাকায়। ঝড় আমাদের টেনে নিয়ে গিয়েছিল ঘর্ণির দিকে আর তার পরিবর্তনশীল স্রোতের মধ্যে পড়ে একদিন দু’দিন করে এখানে ওখানে আমরা নিরুপায় অবস্থায় ভেসে চলেছিলাম। নোঙর ফেলেও তা থেকে আমরা রক্ষা পাইনি। শেষ পর্যন্ত সৌভাগ্যক্রমে ঐ স্রোতেরই বেগ ফ্লিমেনের একটা খাঁড়ির মধ্যে আমাদের নিয়ে ফেলে আর আমরা সে যাত্রা রক্ষা পেয়ে যাই।
‘ওখানে সে সময় আমরা ঠিক কতখানি বিপন্ন হয়েছিলাম, তার বিশভাগের একভাগও আমি বর্ণনা করতে পারলাম না। ভাল আবহাওয়াতেও ও জায়গাটা খুব নিরাপদ ছিল না। আমরা কিন্তু ঐ মস্কো-ঘূর্ণির কাছাকাছি প্রায়ই যেতাম আর কোন দুর্ঘটনার মুখো মুখী না হয়েই প্রত্যেকবার ফিরে আসতাম। দু’একবার অবশ্য ঠিক সময়ের এক মিনিট আগে বা পরে ঘুর্ণির কাছে গিয়ে পড়ার দরুণ আমাদের প্রাণ বেরিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। বাতাস ঠিক যত জোরে বইবে বলে হিসেব করে বেরিয়েছি, শেষ পর্যন্ত তার সে গতিবেগ কমে গেছে, আর আমরা পৌঁছতে দেরী করে ফেলেছি। ইতিমধ্যে স্রোত ভয়াবহ হয়ে উঠেছে আর আমাদের নৌকোটা তার মধ্যে পড়ে বিপন্ন হয়েছে। আমার বড় ভায়ের ছিল এক ছেলে। তার বয়স হয়েছিল আঠারো বছর। আমার ছিল দুটি খুব স্বাস্থ্যবান ছেলে। এরা নৌকো আটকাতে আর মাছ ধরতে অনেক সাহায্য করত আমাদের। যাই বলিনা কেন সমুদ্রে কিছু বিপদের ঝুঁকি তত ছিলই, তাই ছেলেদের নিয়ে যেতে আমাদের মন চাইত না। বিপদ বিপদই আর তা মিথ্যে নয় মোটেই।
‘যে ঘটনার কথা বলতে যাচ্ছি তোমাকে, সেটি ঘটেছিল বছর তিনেক আগে। ১৮সালের দশই জুলাইয়ের ঘটনা। সে দিনের কথা পৃথিবীর এই অংশের মানুষ কোনো দিনই ভুলবে না, ভোলা সম্ভবও নয়। এতবড় ভয়ঙ্কর ঝড় এর আগে কোন দিনই ঊলোক থেকে এই অঞ্চলের ওপর নেমে আসেনি। তবু কিন্তু সকালের দিকটা, এমন কি বলা যায় সন্ধ্যে পর্যন্ত আবহাওয়া প্রায় শান্তই ছিল, আর দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে সুন্দর বাতাস একটানা বয়ে চলেছিল।
আকাশে সূর্য রোজকার মততই উজ্জ্বল ছিল আর আমাদের মত অভিজ্ঞ সমুদ্রযাত্রীরাও কল্পনা করতে পারেনি যে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে একটা বিপর্যয় ঘটে যেতে চলেছে।
‘বিকেল দু’টো নাগাদ আমার দু’ভাই আর আমি, আমরা তিনজন ওদিকের দ্বীপটার কাছাকাছি গিয়ে পৌচেছিলাম, পথে আমরা ভালো জাতের এত মাছ পেয়েছিলাম যে ওরকম মাছ আগে কোনদিন ধরেছি বলে মনেই পড়ে না। ভাটা শুরু হলে আটটা নাগাদ সন্ধ্যের দিকে ঘুর্ণি আরম্ভ হয়, তাই আমার ঘড়িতে যখন সাতটা তখন আমরা বাড়ীর দিকে রওনা দিয়েছিলাম। পালে চমৎকার হাওয়া পেয়েছিলাম তাই নৌকোও চলেছিল বেশ বেগে। বিপদের ক্ষীণতম সম্ভাবনাও আমরা কেউ কল্পনা করিনি। হঠাৎ হেলসেগগেনের দিক থেকে হাওয়া বইতে শুরু করল। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে না বুঝলেও বড় অস্বস্তি বোধ করলাম। বাতাসটার সাহায্য যতটুকু পারি নিয়ে এগোবার হাজার চেষ্টা করেও আমরা এগোতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত মনে হোল আমরা যেখানটায় নোঙর করে থাকি সেখানে ফিরে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। হঠাৎ আকাশের দিকে চোখ পড়ল আমাদের। সারা আকাশ জুড়ে তখন তামাটে রঙের মেঘ হুহু করে উঠে আসছিল।