Site icon BnBoi.Com

তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৫: ভূমিকম্প – শামসুদ্দীন নওয়াব

ভূমিকম্প

 

ভূমিকম্প

পূর্ব কথা

গরমের এক দিনে, পেনসিলভেনিয়ার ফ্রগ ক্রীকের বনভূমিতে রহস্যময় এক ট্রী হাউস উদয় হয়।

তিন গোয়েন্দা দড়ির মই বেয়ে ওঠে ওটায়। ওরা আবিষ্কার করে ট্রী-হাউসটা বই দিয়ে ভর্তি।

ওরা শীঘ্রি টের পায় ট্রী হাউসটা জাদুর। বইয়ে উল্লেখিত নানান জায়গায় ওদেরকে নিয়ে যেতে পারে। ওদেরকে শুধু কোন ছবিতে আঙুল রেখে সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতে হয়।

এক সময় তিন বন্ধু জানতে পারে, ট্রী হাউসটার মালিক মরগ্যান লে ফে। রাজা আর্থারের ক্যামেট রাজ্যের এক জাদুকরী লাইব্রেরিয়ান সে। টাইম আর স্পেসে ভ্রমণ করে বই সংগ্রহ করার বাতিক তার।

মরগ্যান বলে, ক্যামেলটকে রক্ষার জন্য বিশেষ চারটি জিনিস খুঁজে বের করতে হবে। তাই এবারের অভিযানে বেরোচ্ছে কিশোর আর জিনা। তারপর…

বিছানায় উঠে বসল কিশোর। জানালা দিয়ে বাইরে চাইল।

আকাশ গাঢ় ধূসর। শীঘ্রি সূর্যোদয় হবে।

সময় হয়ে গেছে প্রায়, আপন মনে ফিসফিস করল ও।

গতকাল, জাদুর ট্রী হাউসে মরগ্যানের নোট বলেছিল, কালকে ভোরে চলে এসো।

বিছানা থেকে লাফিয়ে নামল কিশোর। জিন্স আর টি-শার্ট পরে নিল। এবার ব্যাকপ্যাক তুলে নিয়ে পা টিপে টিপে হল-এ বেরিয়ে এল।

জিনার কামরায় উঁকি দিল ও। জিনাকে দেখতে পেল না। সন্তর্পণে নীচে নেমে এসে বেরিয়ে পড়ল সদর দরজা দিয়ে।

বারান্দার সিঁড়ির ধাপে বসে ছিল জিনা। কিশোর ওর পাশে বসল।

কী করছ তুমি? প্রশ্ন করল।

পাখিদের গানের অপেক্ষা করছি, জানাল জিনা। তারপর তোমাকে ডাকতে যেতাম।

আকাশ গাঢ় ধূসর থেকে হালকা ধূসর হতে দেখল ওরা। পাখিরা এবার গান শুরু করল।

টুইট-টুইট, বলল জিনা।

টু শব্দটি না করে, কিশোর আর জিনা বারান্দা ছাড়ল। রাস্তা ধরে ফ্রগ ক্রীক উডসের দিকে চলেছে।

গাছ-গাছালির নীচে ঠাণ্ডা ভাব। বনভূমি ভেদ করে হন্তদন্ত হয়ে দড়ির মইটার উদ্দেশে চলল ওরা। সবচাইতে উঁচু ওক গাছটা থেকে ঝুলছে ওটা। আর গাছের মাথায় জাদুর ট্রী হাউসটা।

ট্রী হাউসটাতে দড়ির মই বেয়ে উঠল ওরা। ভিতরটা অনালোকিত।

মেঝেতে পড়ে থাকা চিরকুটটা তুলে নিল জিনা। জানালার কাছে ধরে জোরে জোরে পড়ল:

প্রিয় কিশোর ও জিনা,

ক্যামেলটের সামনে বিপদ, রাজ্য রক্ষার স্বার্থে

দয়া করে আমার লাইব্রেরির জন্য বিশেষ এই চারটি লেখা খুঁজে দাও:

সামথিং টু ফলো
সামথিং টু সেণ্ড
সামথিং টু লার্ন
সামথিং টু লেণ্ড
ধন্যবাদ,
মরগ্যান

গভীর শ্বাস টানল কিশোর।

মরগ্যানের লাইব্রেরির জন্যে কেন এগুলো খুঁজে বের করতে হবে কে জানে, বলল কিশোর। ক্যামেলটকে এগুলো কীভাবে রক্ষা করবে?

জানি না, বলল জিনা। তবে রওনা হওয়া যাক, যাতে রহস্যটা ভেদ করা যায়। আমাদের রিসার্চ বইটা কোথায়?

ট্রী হাউসের চারধারে নজর বুলাল ও।

পেনসিলভেনিয়ার বইটা, ওদেরকে সব সময় যেটা বাড়ি ফিরিয়ে আনে, এক কোনায় পড়ে রয়েছে। ওটার পাশে আরেকটা বই। জিনা। তুলে নিল বইটা।

এটাই সেটা, মৃদু কণ্ঠে বলল। বইটার প্রচ্ছদ দেখাল কিশোরকে। ওতে লেখা:

স্যান ফ্রান্সিসকো, ক্যালিফোর্নিয়া, ১৯০৬
ক্যালিফোর্নিয়া? বলল কিশোর, ভাল!
বইটার প্রচ্ছদে আঙুল রাখল জিনা।
আমরা ওখানে যেতে চাই, বলল ও।
বাতাস বইতে শুরু করল।
ট্রী হাউসটা পাক খাচ্ছে।
বন-বন করে ঘুরছে।
এবার সব কিছু নিথর হয়ে গেল।
একদম স্থির।

সুন্দর ড্রেস, বলল জিনা।

কিশোর চোখ মেলল।

জিনার গায়ে সেইলর কলারওয়ালা নীল-সাদা পোশাক আর সাদা। স্টকিং।

কিশোরের পরনে হাঁটু অবধি বাদামী প্যান্ট, জ্যাকেট, ক্যাপ আর টাই। ওর ব্যাকপ্যাকটা এখন চামড়ার ব্যাগ হয়ে গেছে। দুজনের পায়েই শর্ট লেস-আপ বুট।

এক গির্জার ঘণ্টা বাজতে লাগল।

ঢং, ঢং, ঢং, ঢং, ঢং।

পাঁচবার বেজেছে, বলল কিশোর। তারমানে ভোর পাঁচটা।

হ্যাঁ, বলল জিনা। জানালা দিয়ে বাইরে চাইল।

কিশোরও তাকাল। ভোরের বাতাস তাজা আর ঠাণ্ডা।

এক পাহাড়ের নীচে এক গাছে নেমেছে ট্রী হাউসটা। নির্জন এক পাথর বিছানো রাস্তায় রঙ করা কাঠের বাড়ি-ঘর আর গ্যাস লাইটের সারি দেখা গেল। রাস্তার ট্র্যাক ধরে চলেছে এক ট্রলি কার, পাহাড়ের চূড়ায় বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

দূরে উঁচু-উঁচু দালান। দালানগুলোর পিছনে সূর্য নীল আকাশে গোলাপী আভা ছড়িয়েছে।

দারুণ লাগছে, বলল জিনা।

হ্যাঁ, বলল কিশোর।

রিসার্চ বইটা বের করে পড়ল:

১৯০৬ সালের ১৮ এপ্রিল, বুধবার
স্যান ফ্রান্সিসকো ছিল মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলের সবচাইতে
বড় শহর। এখানে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ
বাস করত। দেশের অন্যতম তিলোত্তমা
নগরী ছিল এটি।

নোটবই বের করে তথ্যগুলো টুকে নিল কিশোর। ও লিখল:

স্যান ফ্রান্সিসকো-এপ্রিল ১৮, ১৯০৬
পশ্চিমের সবচাইতে বড় শহর
তিলোত্তমা।

চলো, যাই! অধৈর্য কণ্ঠে বলল জিনা।

কিশোর বইটার দিকে চাইল। ও আরও জানতে চায়।

পরে পোড়ো, বলল জিনা। কিশোরের কাছ থেকে বই আর নোটবইটা কেড়ে নিয়ে চামড়ার ব্যাগটায় রেখে দিল। আর সময় নষ্ট। করব না।

ট্রী হাউস ত্যাগ করল জিনা।

গবেষণা করলে সময় নষ্ট করা হয় না, গলা চড়িয়ে বলল কিশোর।

কিন্তু কাঁধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে নিয়ে দড়ির মই বেয়ে ঠিকই অনুসরণ করল জিনাকে। দুজনেই ঘাসে নামার পর, কিশোর চারধারে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল।

কোথায় যেতে চাও? প্রশ্ন করল ও।

যে কোনখানে! বলল জিনা। আশপাশটা ঘুরে দেখি এসো, টুরিস্টের মত।

ঠিক আছে, বলল কিশোর। কিন্তু ভুলে যেয়ো না মরগ্যানের জন্যে লেখাটা খুঁজে বের করতে হবে।

নুড়ি বিছানো রাস্তাটা ধরে পা চালাল ওরা। পাহাড়ী ঢাল বেয়ে উঠে যাচ্ছে, উঁচু দালানগুলোর মাথা ছাড়িয়ে সূর্য উঠল।

ভোরের প্রথম আলোয় সব কিছুতে সোনালী রং ধরল: পাথর, স্ট্রীটল্যাম্প এবং নীরব বাড়িগুলোর সমস্ত কাঁচের জানালায়।

কী চুপচাপ চারদিক, বলল জিনা।

হ্যাঁ, সবাই মনে হয় ঘুমাচ্ছে, বলল কিশোর।

হঠাৎই গুড়গুড় করে এক শব্দ উঠল।

কিশোর থমকে দাঁড়াল। জিনার হাত চেপে ধরেছে।

কীসের শব্দ? বলল ও।

আওয়াজটা জোরাল হলো। মনে হচ্ছে মাটির নীচ থেকে বাজের শব্দ আসছে।

মাটি কাঁপতে শুরু করল।

খেপাটে শব্দে বেজে চলেছে গির্জার ঘণ্টাগুলো।

গোটা রাস্তা কাঁপছে। মহাসাগরের ঢেউয়ের মত ভেসে যাচ্ছে নুড়িপাথরগুলো।

কী হচ্ছে এসব? চেঁচিয়ে উঠল জিনা।

ছাদ থেকে চিমনি খসে পড়ছে!

গ্যাসলাইট ছিটকে পড়ছে!

রাস্তায় চূর্ণ-বিচূর্ণ হচ্ছে ইঁট।

বসে পড়ে মাথা ঢাকো! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।

মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে, গুটিসুটি মেরে বসে পড়ল কিশোর আর জিনা। চারপাশে গুড়-গুড়, ঠনঠন, মড়মড় শব্দ।

এবার দুনিয়া স্থির হলো। গুড়গুড় শব্দটা থেমেছে।

কিশোর আর জিনা মাথা তুলল। বাতাস ধুলোয় ভরা।

থেমেছে, বলল কিশোর।

মনে হয় ভূমিকম্প! বলল জিনা।

হ্যাঁ, সায় জানাল কিশোর।

তোমাকে জায়গাটা সম্পর্কে আরেকটু রিসার্চ করতে দিলে ভাল হত, বলল জিনা।

হুঁ, বলল কিশোর।

ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়াল ও দুপা টলছে। প্যান্ট ঝেড়ে নিতেই, গভীর গুড়গুড় শব্দটা আবারও শোনা গেল-এবার আগের চাইতেও জোরাল।

পরমুহূর্তে আরম্ভ হলো ভয়ঙ্কর ঝাঁকুনি। আগের চেয়ে জোরে।

কিশোর ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। রাস্তা দস্তুর মত দুলছে, কাঁপছে। শক্ত নুড়িপাথরে ঝাঁকি খাচ্ছে ওর দেহ।

জিনা! চেঁচাল ও।

উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল কিন্তু পড়ে গেল আবারও। ধুলোময় বাতাস ভেদ করে দেখতে পেল, আকাশের পটভূমিতে এপাশ-ওপাশ দুলছে উঁচু-উঁচু বাড়িগুলো!

হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে ছাদ!

রাস্তার এমাথায়-ওমাথায় ইঁট, কাঁচ আর কংক্রিটের বৃষ্টি ঝরছে!

মনে হলো যেন দীর্ঘ সময় বাদে ভয়ঙ্কর শব্দ আর দুলুনিটা শেষমেশ থামল।

ধুলোর মেঘ পাক খাচ্ছে কিশোরকে ঘিরে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। দৃষ্টি চলে। তবে জিনার কাশির শব্দ শুনতে পাচ্ছে ও।

কিশোর ওকে ডাকার জন্য মুখ খুলল। কিন্তু গলা বুজে গেল ধুলোয়।

কিশোর! কাশির ফাঁকে নাম ধরে চেঁচাল জিনা। কিশোর!

আমি এখানে! বোজা কণ্ঠে বলল কিশোর।

বিপদে পড়ে গেছি, বলল জিনা।

উঠে বসতে চেষ্টা করল কিশোর। সারা গায়ে ব্যথা। কাপড় ছিঁড়ে গেছে। ধুলোয় মাখামাখি। ক্যাপটা উধাও।

কোথায় তুমি? চেঁচাল ও।

এখানে! বলল জিনা।

উঠে দাঁড়াতে গেল কিশোর। কিন্তু পড়ে গেল আবারও। পা জোড়া যেন রবার।

কো-কোথায়? পুনরাবৃত্তি করল ও। চারধারে নজর বুলাল। কিন্তু ঘন ধুলোর কুয়াশা ভেদ করে জিনাকে দেখতে পেল না।

মাটিতে পড়ে গেছি! বলল জিনা।

কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে গুঁড়ি মেরে এগোল কিশোর।

কথা চালিয়ে যাও, বলল ও।

এখানে- কাশল জিনা- এখানে!

দুহাতে একটা পাথুরে তাক অনুভব করল কিশোর। রাস্তার বিশাল এক ফাটলের দিকে চোখ নামিয়ে চাইল। ধুলো ভেদ করে ওর ঠিক নীচে জিনাকে দেখতে পেল।

এই তো! কাশির দমকের ফাঁকে বলল জিনা।

আমি তোমাকে টেনে তুলব, ভয় পেয়ো না, বলল কিশোর।

জিনার দুহাত চেপে ধরল ও। ফাটলের ভিতর থেকে টেনে তুলতে চেষ্টা করল, কিন্তু জিনা যথেষ্ট ভারী।

পারছি না, বলল কিশোর।

আমি দাঁড়াতে পারি এমন কিছু একটা দাও, বলল জিনা। তা হলে হয়তো নিজেই বের হতে পারব।

কিশোর উঠে দাঁড়িয়ে টলতে টলতে সরে গেল ফাটলের কাছ থেকে। এক গাদা ইঁট জড় করল ও। এবার ফাটলের কাছে ফিরে গিয়ে একটা একটা করে ইঁট জিনাকে দিল।

জিনা সাবধানে একটার উপর একটা ইঁট সাজাল।

আরও লাগবে, বলল সে।

কিশোর দৌড়ে গেল আরও হঁট জোগাড় করতে। ওর মনে আতঙ্ক, আরেকবার ভূমিকম্প হলেই ফাটলটা বন্ধ হয়ে যাবে-ভিতরে জিনাকে নিয়ে!

ইঁটগুলো জিনার হাতে দিল ও।

জলদি! জরুরী কণ্ঠে তাগিদ দিল।

জলদিই করছি, বলল জিনা।

মাজানো শেষ হলো জিনার। ইঁটের গাদার উপরে। দাঁড়াল ও। খালি হাত দুটো ব্যবহার করে ধীরে ধীরে টেনে তুলল নিজেকে।

কিশোর ওকে দাঁড়াতে সাহায্য করল। জিনার সারা দেহ ধুলোয় ঢাকা। স্টকিং ছিঁড়ে গেছে। চামড়া ছড়ে গেছে হাঁটুর।

লেগেছে? কিশোরের প্রশ্ন।

সামান্য চামড়া ছড়েছে শুধু, বলল জিনা। তুমি ঠিক আছ তো?

মাথাটা একটু কেমন কেমন লাগছে, বলল কিশোর। আসলে রীতিমত মাথা ঘুরছে ওর।

আমারও, বলল জিনা।

বিরাট ভূমিকম্প হয়ে গেল, বলল কিশোর। কাশল। গলা ধুলোয় বুজে গেছে।

জিনাও কাশল।

বইতে কী বলে? জিজ্ঞেস করল ও।

চামড়ার ব্যাগ থেকে গবেষণার বইটা টেনে বের করল কিশোর। হাত কাঁপছে ওর। পাতা উল্টাতে কষ্ট হচ্ছে।

আমার কাছে দাও, বলল জিনা। বইটা নিয়ে ভাঙা এক রাস্তার ছবি বের করল।

জোরে জোরে পড়ল:

১৯০৬ সালের এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখ, ভোর ৫:১৩ মিনিটে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের অন্যতম বড় ভূমিকম্পে ঘুম থেকে জেগে ওঠে স্যান ফ্রান্সিসকোর নাগরিকরা। কেউ কেউ একে মহাকম্পন বলে।

একেবারে কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে, বলল কিশোর।

মনে হয় অনেক লোক আহত হয়েছে, বলল জিনা।

চারধারে দৃষ্টি বুলাল ওরা। ধুলোময় বাতাস ভেদ করে, পড়ো পড়ো বাড়ি-ঘর ছেড়ে টলতে টলতে বেরিয়ে আসছে মানুষ-জন। সবার পা খালি, পরনে রাতপোশাক।

বাচ্চারা কাঁদছে। তবে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, বড়রা সব চুপ। ফাটা রাস্তা আর ভাঙা বাড়ি-ঘরের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। তারা।

সবাই শকের মধ্যে আছে, বলল জিনা।

ওদের কেমন লাগছে চিন্তা করো, বলল কিশোর। চারদিকের ধ্বংসস্তূপ দেখে নিল ও। ইতিকর্তব্য ঠিক করে উঠতে পারছে না। স্বচ্ছ চিন্তা বাধা পাচ্ছে।

বইটার দিকে আবারও চাইল জিনা। পড়ল জোরে জোরে: ভূমিকম্পের ঠিক পরপরই ভাঙা চিমনি, চুলো আর প্রদীপ ভয়ানক অগ্নিকাণ্ডের সূচনা করে। আগুন।

জ্বলে প্রায় তিন দিন ধরে, প্রায় গোটা স্যান ফ্রান্সিসকো ধ্বংস হয়ে যায়। আটাশ হাজারের বেশি বাড়ি-ঘর পুড়ে যায়।

ভয়ঙ্কর, বলল কিশোর। দূরে, কালো ধোঁয়ার মেঘ আকাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠেছে।

আগুন লেগেছে! বলল জিনা।

আমাদের চলে যাওয়া উচিত, ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগেই এশহর ছাড়তে চায় ও।

মরগ্যানের লাইব্রেরির জন্যে তো লেখাটা এখনও জোগাড় হয়নি-সামথিং টু লেণ্ড।

খুঁজি এসো, বলল কিশোর।

ভগ্নস্তূপ ভেদ করে হাঁটা ধরল ওরা। ইঁটের গাদা, কংক্রিটের চাঙড়, আর ভাঙা কাঁচ মাড়িয়ে।

পড়ে থাকা প্রদীপ আর দোমড়ানো ট্রলি-কারের রাস্তা পেরিয়ে এল দুজনে।

বাড়ি-ঘর হেলে পড়েছে এক পাশে। লোক-জন রাস্তায় মাল-পত্র টেনে বের করছে।

এখন আমাদের মিশনের কথা ভুলে যাও, বলল জিনা। মানুষকে সাহায্য করতে হবে।

সাহায্য? কীভাবে? প্রশ্ন করল কিশোর। মাথার ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ওর।

এসো, বলল জিনা।

কিছু লোকের দিকে ইশারা করল ও। তারা পাগলের মত এক বিল্ডিং থেকে কটা থলে টেনে বের করে ঘোড়ায়-টানা এক ওয়াগনে তুলছে।

ওয়াগনটার কাছে দৌড়ে গেল জিনা।

কী করছেন আপনারা? জানতে চাইল।

ব্যাঙ্কের থলেগুলো বন্দরে নিয়ে যেতে চাইছি, বলল ওয়াগনের ড্রাইভার। যাতে নৌকায় করে এগুলো পার করা যায়।

কেন? প্রশ্ন করল কিশোর।

আগুনের হাত থেকে মানুষের টাকা-পয়সা বাঁচাতে হবে না? লোকটা বলল।

আকাশের দিকে তর্জনী তাক করল সে। ধোঁয়ার মেঘ ক্রমেই আরও বড় আর কালো হচ্ছে।

আমরা কি হেল্প করতে পারি? জিনার জিজ্ঞাসা।

কাজ হয়ে গেছে, জানাল ড্রাইভার। তোমরা এখুনি বাসায় চলে যাও। তারপর বাবা-মাকে নিয়ে শহর ছাড়ো।

কিশোরের ইচ্ছে হলো ওয়াগনে চেপে ও আর জিনাও বন্দরে যায়। তা হলে আগুনের কবল থেকে বাঁচতে পারত। কিন্তু দেখতে পেল ওয়াগনে ওদের জায়গা হবে না।

গুড লাক! বলল জিনা।

আমার কথাগুলো মনে রেখো কিন্তু! ড্রাইভার বলল। এবার সে আর তার ঘোড়াগুলো রওনা হয়ে গেল। ওয়াগনটা বড় রাস্তায় পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল পাহাড়ের ওপাশে।

বুঝতে পারছি না কাদেরকে হেল্প করব, বলল জিনা।

কিশোর গভীর শ্বাস টানল। তারপর নোটবই বের করে এলোমেলো হাতে লিখল:

ব্যাঙ্কের টাকা-ওয়াগনে করে বন্দরে-সেখান থেকে নৌকায় তুলে নিরাপদ জায়গায়।

অ্যাই, স্টোরিটা কী? এক মহিলা প্রশ্ন করল। তার কণ্ঠস্বরে জরুরী তাগিদ।

ঝট করে মুখ তুলে চাইল কিশোর।

এক লোক আর এক মহিলা ওদের সামনে দাঁড়িয়ে। মহিলার পরনে লম্বা পোশাক। হাতে নোটবই। লোকটির পরনে বুট। বড়সড় এক ক্যামেরা আর এক তেপায়া স্ট্যাণ্ড বইছে।

কীসের স্টোরি? জিজ্ঞেস করল জিনা।

ব্যাঙ্কের স্টোরিটা। আমার নাম লিণ্ডা। আমি একজন রিপোর্টার, জানাল মহিলাটি।

টেলিভিশনের? প্রশ্ন করল জিনা।

সেটা আবার কী? প্রশ্ন করল লিণ্ডা।

কিছু না, বলল কিশোর। ফিসফিস করে জিনাকে বলল, উনি খবরের কাগজের রিপোর্টার। টিভি এখনও আবিষ্কৃত হয়নি।

ও, আচ্ছা, বলল জিনা। বিব্রত।

ওয়াগনের ব্যাপারটা কী? লিণ্ডা জিজ্ঞেস করল কিশোর আর জিনাকে।

কিশোর ওর নোটবইটার দিকে চাইল।

বন্দরে নিয়ে গিয়ে টাকার থলেগুলো নৌকায় তুলে পাঠিয়ে দেবে, যাতে পুড়ে নষ্ট না হয়।

গুড রিপোর্টিং, বাছা! বলল মহিলা। জন ব্যাঙ্কের একটা ছবি নাও।

ফটোগ্রাফার স্ট্যাণ্ডের উপর ক্যামেরা রাখল। কালো এক পর্দার নীচে মাথা রেখে একটা ছবি তুলল।

নিয়েছি, জানাল।

ফটোগ্রাফার তার যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নিচ্ছে, এসময় লিণ্ডা ঘুরে চাইল কিশোর আর জিনার দিকে।

বাড়ি গিয়ে বাবা-মাকে নিয়ে সরে পড়ো, বলল। আগুন ছড়িয়ে পড়ছে।

জানি, বলল জিনা, তিন দিন শেষে, আগুনে স্যান ফ্রান্সিস্কোর প্রায় গোটাটা পুড়ে যাবে।

লিণ্ডাকে কৌতূহলী দেখাল।

কীভাবে জানলে? জবাব চাইল।

আন্দাজে বলেছে, চটপট জানাল কিশোর।

ওর আন্দাজটা ভয়ঙ্কর, বলল লিণ্ডা। বাবা-মাকে বোলো ফেরি না। ধরতে। ফেরি বিল্ডিঙে মানুষের প্রচণ্ড ভিড়। গোল্ডেন গেট পার্কে চলে যাও।

পরামর্শের জন্যে ধন্যবাদ, বলল জিনা।

স্টোরির জন্যেও ধন্যবাদ, বলল লিণ্ডা। এবার সে আর জন দ্রুত পা চালাল।

কিশোর আর জিনা চারধারে নজর বুলাল।

অনেক লোক এখন বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে। কেউ কেউ পাহাড় টপকে। কেউ বা আবার পাহাড় বেয়ে নেমে এসে।

এক বৃদ্ধা হাঁড়ি-পাতিল ভর্তি ঠেলাগাড়ি ঠেলে নিয়ে চলেছে। এক, মেয়ে বইছে এক সুটকেস ও একটা বিড়াল। এক ছেলের হাতে এক পাখির খাঁচা ও এক মাছের পাত্র দেখা গেল।

একেকজন একেক দিকে যাচ্ছে, বলল জিনা।

গোল্ডেন গেট পার্ক কোথায় কে জানে, বলল কিশোর। আমাদেরও মনে হয় ওখানে যাওয়া দরকার। দেখি তো বইতে কোন ম্যাপ আছে কিনা।

গবেষণার বইটা দেখে নিল কিশোর। স্যান ফ্রান্সিসকোর এক মানচিত্র খুঁজে পেল।

আমরা এখন কোথায়? জিজ্ঞেস করল ও।

স্ট্রীট সাইন খুঁজছে, এক লোককে এক গাদা বই বয়ে নিয়ে। বেরোতে দেখল সুদৃশ্য এক দালান থেকে। এক ঘোড়ায়-টানা ওয়াগনের পিছনদিকে বইগুলো রাখল সে।

কী করছে? কিশোরের প্রশ্ন।

মনে হয় বইগুলো বাঁচাচ্ছে, বলল জিনা।

বই বাঁচাচ্ছে? বলল কিশোর। মহর্তের জন্য নিজেদের নিরাপত্তার কথা বেমালুম ভুলে গেল ও। জলদি চলো, হেল্প করতে হবে!

কিশোর আর জিনা রাস্তা ধরে দৌড়ে গেল বইয়ের ওয়াগনটার কাছে। লোকটি সযত্নে ওয়াগনের পিছনে বইগুলো সাজিয়ে রাখছে। তার সারা শরীরে ধুলো। চশমার কাঁচ ফাটা।

আচ্ছা, স্টোরিটা কী? জিনা প্রশ্ন করল লোকটিকে।

কিশোর হেসে ফেলল। ঠিক খবরের কাগজের রিপোর্টারের মত শুনিয়েছে জিনার কথাগুলো।

দুপ্রাপ্য বইগুলো প্যাভিলিয়নে সরিয়ে নিচ্ছি, বলল লোকটি।

আমরা কি সাহায্য করতে পারি? কিশোরের জিজ্ঞাসা।

নিশ্চয়ই, দরজার পাশে আর অল্প কিছু বই আছে, বলল লোকটি।

ওগুলো নিয়ে এসো! জলদি! মার্কেট স্ট্রীটের আগুন শীঘ্রি এদিকে ছড়িয়ে পড়বে।

কিশোর আর জিনা এক দৌড়ে দালানটার ভিতরে ঢুকে পড়ল। দরজার কাছে বইয়ের ছোট দুটো স্তূপ।

কিশোর আর জিনা একটা করে গাদা তুলে নিল। বইগুলো প্রাচীন আর সুদৃশ্য। কোন কোনটার প্রচ্ছদ চকচকে সোনালী।

ওয়াও, ফিসফিস করে বলল কিশোর।

ও আর জিনা বইগুলো বয়ে নিয়ে গেল বাইরে।

সাবধানে, প্লিজ! বলল লোকটি। প্রত্যেকটা বই অমূল্য সম্পদ-প্রাচীন বাইবেল আর হাতে ছাপা বই।

লোকটা সাবধানী হাতে কিশোর আর জিনার বাহু থেকে বইগুলো নিয়ে ওয়াগনের পিছনে তুলে রাখল।

ধন্যবাদ, বলে হ্যাটটা পিছনদিকে ঠেলে দিল সে। এখুনি বাড়ি চলে যাও! আগুন শীঘ্রিই এখানে পৌঁছে যাবে!

ঘোড়াগুলো পাহাড় বেয়ে যখন উঠছে, জিনা হাত নেড়ে চেঁচিয়ে উঠল, গুড লাক!

লোকটা মনে হয় লাইব্রেরিয়ান, বলল কিশোর। গবেষণার বইটা খুলল ও। বাড়িটার একটা ছবি খুঁজে নিল।

এই যে, বলল। জোরে জোরে পড়ল: লোক-জন বিশেষ বিশেষ জিনিস রক্ষা করার চেষ্টা করে। কিন্তু সবক্ষেত্রে সফল হয়নি। লাইব্রেরির দুপ্রাপ্য বই সরিয়ে নেয়া হয় প্যাভিলিয়ন বিল্ডিঙে। প্যাভিলিয়ন বিল্ডিঙে আগুন ধরে গেলে, সব বই পুড়ে যায়। অথচ মূল বাড়ি, যেটিতে বইগুলো ছিল সেটি পোড়েনি।

হায়, হায়! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর, দাঁড়ান, দাঁড়ান!

এ গবেষণার বইটা চেপে ধরে, ওয়াগনের পিছন পিছন দৌড় দিল। জিনাও দৌড়ল ওর সঙ্গে।

দাঁড়ান! দাঁড়ান! দুজনেই চেঁচাল। ভাঙা নুড়িপাথরের উপর দিয়ে যথাসম্ভব জোরে ছুটল ওরা। উঠে যাচ্ছে খাড়া পাহাড় বেয়ে।

চুড়োর কাছে পৌঁছে ড্রাইভার শেষমেশ শুনতে পেল। ওয়াগন দাঁড় করাল সে।

প্যাভিলিয়নে যাবেন না! চেঁচিয়ে বলল কিশোর।

যেখানে ছিল সেখানে ফেরত নিয়ে যান! বলল জিনা।

ওখানে থাকলে বইগুলো পুড়বে না! বলল কিশোর। শ্বাস ফিরে পেতে চাইছে। যে বিল্ডিঙে নিয়ে যেতে চাইছেন বরং সেটাই পুড়ে যাবে!

কিশোর আর জিনার দিকে এমনভাবে তাকাল ড্রাইভার, ওরা যেন বদ্ধ উন্মাদ।

তোমরা নিজেদের নিয়ে ভাবো, বই নিয়ে ভাবতে হবে না, বলল সে, বাসায় বাবা-মার কাছে চলে যাও। লাইব্রেরির ব্যবস্থা আমি করব।

এবার লাগাম আছড়ে পাহাড়-চুড়ো ধরে এগিয়ে চলল ওয়াগন নিয়ে।

দোহাই আপনার, ফিরে আসুন! চেঁচাল কিশোর।

ওরা অসহায় চোখে দেখল ঝাঁকুনি খেতে খেতে, জঞ্জালের উপর দিয়ে গড়িয়ে চলেছে ওয়াগনটা। পাহাড়ের নীচ থেকে ধোঁয়া পাকিয়ে উঠছে।

শুনল না! বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলল কিশোর।

আমরা তো যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি, বলল জিনা। আলতো হাতে কিশোরের কাধ স্পর্শ করল।

এতগুলো বই… হারিয়ে গেল কিশোরের কণ্ঠ।

অ্যাই, বলল জিনা, কে যেন ওদিকে কাঁদছে-সাথে দুটো বাচ্চা। আমরা হয়তো ওদেরকে হেল্প করতে পারব।

নীল বাথরোব পরা এক মহিলা বসে ভাঙাচোরা এক পাথুরে দেয়ালের উপর। রুমালে মুখ ঢেকে ফোঁপাচ্ছে।

কালোচুলো দুটি ছেলে মহিলার পাশে বসা। তাদের পরনে ধুলোমাখা, ছেঁড়া পাজামা। দুজনেই খালি পা। ছোট ছেলেটি বড় ছেলেটিকে চারকোনা এক কাঠের উপর কয়লা দিয়ে লিখতে দেখছে।

জিনা কিশোরকে টেনে নিয়ে গেল পরিবারটির কাছে।

হাই, আমি জিনা, বলল ও।

ছেলে দুটি মুখ তুলে চাইল।

আমি পিটার, ছোটজন বলল। ও আমার ভাই অ্যাণ্ড। আর উনি আমাদের খালা মেরি। কথা বলার সময় ভাইকে আর খালাকে দেখিয়ে দিল।

মেরি খালা কান্নাভেজা চোখে হাসার চেষ্টা করলেন।

কিছু মনে কোরো না, বললেন তিনি, আমার ঘোরটা এখনও কাটেনি।

আমাদেরও, সহানুভূতির কণ্ঠে বলল জিনা।

বাড়িটায় আগুন লেগে যায়, বলল পিটার।

আমরা পালাতে পেরেছি, কিন্তু বেশিরভাগ জিনিস পুড়ে গেছে, বলল অ্যাণ্ড্রু।

এমনকী জুতোও, বলল পিটার।

কিশোর আর জিনা ছেলে দুটির পায়ের দিকে চাইল। কেটে গেছে, রক্তাক্ত।

আমার বুটজোড়া ছেলেদের বুটের মত, বলল জিনা। একজন এগুলো পরতে পারো।

আমারটাও নাও, বলল কিশোর। ও আর জিনা বুটের ফিতে খুলতে লাগল।

আমরা এমনি এমনি তোমাদের জুতো নিয়ে নিতে পারি না, বলল। অ্যাণ্ড্রু।

তা হলে ধার নাও, বলল কিশোর।

ছেলে দুটির হাতে জুতো তুলে দিল ওরা।

ধন্যবাদ, ধন্যবাদ, বললেন মেরি খালা। আবারও কেঁদে ফেললেন।

ছেলে দুটি বুট পায়ে গলাল। এবার পিটার ফিসফিস করে অ্যাণ্ড্রুকে কী যেন বলল। অ্যাণ্ড্রু কাঠের টুকরোটা কিশোর আর জিনার দিকে বাড়িয়ে দিল।

তোমরা এটা ধার নিতে পারো, বলল ও।

কাঠের টুকরোয় লেখা দুভাইয়ের একটা কবিতা পড়ল কিশোর আর জিনাঃ

দেয়ার ইজ নো ওয়াটার
অ্যাণ্ড স্টিল লেস সোপ
উই হ্যাভ নো সিটি
বাট লটস অভ হোপ

ধন্যবাদ, বলল জিনা।

দারুণ উপহার এটা, বলল কিশোর। আমাদের মনে আশা জাগানো দরকার ছিল।

তোমাদেরকে ধার দেয়ার মত একমাত্র এটাই আছে আমাদের কাছে, বলল অ্যাণ্ড্রু।

ধার? বলে উঠল জিনা। কিশোরের দিকে চাইল। আরি, ওরা এইমাত্র আমাদেরকে বিশেষ লেখাটা দিল-সামথিং টু লেণ্ড!

মৃদু হাসি ফুটল কিশোরের মুখে। ওরা এখন বাড়ি ফিরে যেতে পারে।

আপনারা গোল্ডেন গেট পার্কে চলে যান-এক রিপোর্টার আমাদেরকে ওখানে যেতে বলেছে, ছেলে দুটি আর তাদের খালাকে বলল কিশোর।

তোমরা কি ওখানে যাচ্ছ? মেরি খালা জানতে চাইলেন। কান্না বন্ধ হয়েছে তার। মনে হচ্ছে মনের জোর ফিরে পেয়েছেন।

আমরা বাড়ি ফিরে যাব, বলল জিনা।

নিরাপদে ফিরতে পারবে তো? খালার প্রশ্ন।

সায় ফিরলেই আমরা নিরাপদ, বলল কিশোর।

বুট ধার দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ! বলল পিটার। তোমাদের কথা মনে থাকবে!

আমাদেরও মনে থাকবে! বলল জিনা।

তোমরা আমাদের কতটা সাহায্য করেছ নিজেরাও জান না, বলল কিশোর।

সাবধানে যেয়ো, মেরি খালা বললেন।

ঠিক আছে! বলল কিশোর। আপনি ভাববেন না।

পরিবারটি পার্কের দিকে এগোলে হাত নেড়ে বিদায় জানাল ওরা।

কিশোর দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

রেডি? প্রশ্ন করল।

হ্যাঁ, জানাল জিনা। যেখান থেকে এসেছিলাম সেখানে ফিরে গেলেই হলো।

রাস্তার দিকে চাইল কিশোর। পাহাড়ের নীচ থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে।

কাজটা অত সোজা হবে না, বলল কিশোর।

সাবধানে, বলল জিনা।

ভাঙা নুড়িপাথরের উপর মোজা পরা পা ফেলল ওরা। সতর্ক রইল যাতে কেটে না যায়।

পাহাড় বেয়ে নেমে চলল ওরা। পথে পুলিসদের দেখতে পেল। আহতদেরকে স্ট্রেচারে বইছে।

সৈনিকদের দেখল আগুন থেকে যারা বাঁচার চেষ্টা করছে তাদেরকে পথ নির্দেশ দিচ্ছে।

এক লোক রাস্তা দিয়ে একটা পিয়ানো ঠেলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আরেক লোক একটার উপর একটা এভাবে এক গাদা হ্যাট পরেছে। এক মহিলা ব্যাগের মধ্যে তার তিনটে কুকুরছানা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

সবাই যার যার প্রিয় জিনিস সেভ করার চেষ্টা করছে, বলল জিনা।

সেই লাইব্রেরিয়ানের মত, বলল কিশোর। আর আমরা যেমন কবিতাটা সেভ করার চেষ্টা করছি। কাঠের টুকরোটা আঁকড়ে ধরল।

পাহাড় বেয়ে অর্ধেকটা নেমেছে, এসময় এক সৈনিক ঘোড়া ছুটিয়ে ওদের সামনে চলে এল।

রাস্তা থেকে সরে যাও! আমরা ডিনামাইট বসাচ্ছি! গর্জে উঠল সে।

ডিনামাইট? বলল কিশোর।

বলে কী! বলল জিনা।

মানুষ-জন দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করল। কিশোর আর জিনা মরিয়ার মত চারপাশে নজর বুলাল একটা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। এক অলিপথ দেখতে পেল কিশোর।

ওখানে চলো! বলল ও।

এক দৌড়ে অলিপথটায় ঢুকে মাটিতে গুটিসুটি মেরে বসল ওরা।

কিশোর ব্যাগে হাত ভরে দিল গবেষণার বইটার জন্য। ইনডেক্সে ডিনাইমাইট শব্দটা খুঁজে পেল। এবার সঠিক পৃষ্ঠা নম্বর বের করে পড়ল:

আগুন ধরে যাওয়ার পরে মেয়রের মাথায়
একটা আইডিয়া আসে। তার মনে হয়
কিছু বাড়ি যদি ধসিয়ে দেয়া যায়
তবে একটি কাঠের ছাদ থেকে অপর
কাঠের ছাদে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়াতে
পারবে না। ডিনামাইট দিয়ে তিনি কিছু
বাড়ি উড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন।
তার পরিকল্পনা কাজ করেনি, আগুন
ছড়িয়ে পড়ে বাড়ি থেকে বাড়িতে, রাস্তা
থেকে রাস্তায়।
ভয়ঙ্কর ব্যাপার, মনে মনে বলল কিশোর।
ও বইটা সরিয়ে রাখতে না রাখতেই বিকট শব্দে ডিনামাইট ফাটল।
ধুলো-মাটি উড়ছে চারদিকে। এমনকী অলিপথটিতেও।
এক হাতে কাঠের টুকরোটা চেপে ধরে থাকল কিশোর।
অপর হাতে চোখ ঢাকল। একই কাজ করল জিনাও।

আরেকটা প্রচণ্ড শব্দে মাটি কেঁপে উঠল।

কিশোর মুখে মাটির স্বাদ পেল। জিনার দিকে চাইল সে। আপাদমস্তক ধুলোয় ধূসরিত ও। নিজের দিকে চোখ নামিয়ে চাইল। কিশোর। ওর অবস্থাও জিনার মত।

ওদের দুজনকে দেখো! কেউ বলে উঠল। একটা স্টোরি পাওয়া গেছে!

মুখ তুলে চাইল কিশোর। খবরের কাগজের রিপোর্টার লিণ্ডা আর ফটোগ্রাফার জন ওদের সামনে দাঁড়িয়ে।

সারা গায়ে ধুলো-মাটি, তারপরও ক্যামেরা সেট আপ করছে জন। আর লিণ্ডা তার নোট বইতে কী সব টুকছে।

কাঠের টুকরোটা তুলে ধরো, বাছা, বলল লিণ্ডা।

হতভম্ব কিশোর মুখে কিছু বলল না, আশা জাগানিয়া কবিতাটা তুলে ধরল।

জন ছবি নিল।

আরেকটা ডিনামাইটের শব্দ মাটি কাঁপিয়ে দিল।

আমাদের সাথে চলো। আমরা পার্কের দিকে যাচ্ছি! বলল লিণ্ডা।

আপনারা যান, আমরা বাসায় যাব, বলল জিনা।

চলো, জন! তোমরা সাবধানে যেয়ো! বলল লিণ্ডা। পালাই চলো!

ফটোগ্রাফারের যন্ত্রপাতি নেয়া হয়ে গেলেই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিল। ওরা।

মনে হয় ওরা আমাদেরকে চিনতে পারেনি, বলল জিনা।

আমরাই কি নিজেদের চিনতে পারছি? বলল কিশোর।

আরেকটা বিস্ফোরণের শব্দে মাটি কেঁপে উঠল।

পালাই চলো! বলল জিনা।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ওরা দুজন। ব্যাগের ভিতরে কবিতাটা ঢুকিয়ে রাখল কিশোর। এবার আবার পাহাড় বেয়ে নামতে লাগল।

কিশোর আর জিনা নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে দৌড় দিল। ডিনামাইটের কানে তালা লাগানো শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ওদের পিছনে।

পাহাড় বেয়ে নেমে আসছে ওরা। আগুনের শিখা ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে।

আমরা সোজা আগুনঝড়ের দিকে যাচ্ছি, শোরগোল ছাপিয়ে শোনা গেল কিশোরের কণ্ঠস্বর।

যেতেই হবে, এ ছাড়া উপায় নেই, পাল্টা চেঁচাল জিনা। দেরি। করলে ট্ৰীহাউসে আগুন ধরে যাবে!

পাহাড়ের নীচে, রাস্তা ধরে ভেসে যাচ্ছে ঘন ধোঁয়ার মেঘ। চোখ জ্বালা করছে কিশোরের।

ট্রী হাউসটা কোথায়? চিৎকার করল ও।

এখানে! বলল জিনা।

কিশোর ওকে অনুসরণ করল।

দড়ির মইতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে জিনা।

এখনও এখানে আছে! স্বস্তির শ্বাস ফেলল কিশোর।

কেন থাকবে না। আমাদেরকে না নিয়ে ট্রী হাউস যায় কখনও? বলল জিনা। তুমি–

ওঠো! ওঠো! তাগাদা দিল কিশোর।

দড়ির মই বেয়ে উঠতে লাগল জিনা। ওকে অনুগমন করল। কিশোর। ট্রী হাউসে উঠে জানালা দিয়ে বাইরে চাইল ওরা।

চারধারে বাড়িগুলো সব জ্বলছে। কালো ধোঁয়া যেন গিলে খাবে শহরটাকে।

শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কিশোরের। গলা পুড়ে যাচ্ছে। চোখ জ্বালা করছে।

জিনা পেনসিলভেনিয়ার বইটা চেপে ধরল। ফ্রগ ক্রীকের ছবিটা বের করে তাতে আঙুল রাখল।

আমরা ওখানে যেতে চাই, বলল ও। গুড লাক, স্যান ফ্রান্সিসকো!

গুড বাই, স্যান ফ্রান্সিসকো! বলল কিশোর। বাতাস বইতে শুরু করল। ঘুরতে আরম্ভ করেছে ট্রী হাউস। বন-বন করে ঘুরছে। এবার সব কিছু স্থির হয়ে গেল। একদম নিথর।

ভোরের পাখির গানে মুখরিত বনভূমি।

কিশোর চোখ মেলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

ফ্রগ ক্রীকে ফিরে এসেছে ওরা। আবার বুক ভরে শ্বাস নিতে পারছে। এখন আর চোখ জ্বালা করছে না। ওর পরনে নিজের পোশাক, পায়ে নিজের স্নিকার্স।

ভাবছি ওদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল জিনা। অ্যাণ্ড্রু, পিটার আর ওদের খালা, লিণ্ডা আর জন এবং অন্যান্যদের।

কিশোর ওদের গবেষণার বইটা বের করল। পাতা উল্টে শেষ অধ্যায়ে চলে এল। জোরে জোরে পড়ল:

ভূমিকম্পের পর আগুন নেভানো হয়। সারা পৃথিবী
থেকে ত্রাণ পাঠানো হয় স্যান ফ্রান্সিসকোতে। সাহসী
নগরবাসী হাল ছাড়েনি। অনেকে এখুনি,
পুনর্নির্মাণ করি এসো লেখা ব্যাজ পরেছিল। দশ
বছরের কম সময়ে স্যান ফ্রান্সিসকো আবার
যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম তিলোত্তমা নগরীতে পরিণত হয়।

যাক, বাবা, স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বলল জিনা। কবিতাটা আছে তো?

প্যাকে হাত ভরে দিল কিশোর। পিটার আর অ্যাণ্ড্রুর কবিতাটা বের করে আনল।

মেঝের উপর রাখল ওটা।

এখন কী হবে? প্রশ্ন করল জিনা।

আচমকা একটা গর্জন শোনা গেল। উজ্জ্বল এক আলো ঝলসে গেল ট্রী হাউসে।

মুখ ঢাকল কিশোর। আঙুলের উপর দিয়ে উঁকি দিতেই, মরগ্যান লে। ফে-কে দেখতে পেল।

মরগ্যান! কিশোর আর জিনা উৎফুল্ল কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল। দুজনেই জড়িয়ে ধরল মরগ্যানকে। মরগ্যানও ওদেরকে আলিঙ্গন করল। আপনার লাইব্রেরির জন্যে লেখা নিয়ে এসেছি! বলল কিশোর। কাঠের টুকরোটা তুলে ধরল জিনা।

এই যে! বলল।

এগিয়ে দিল মরগ্যানের দিকে। কিন্তু মরগ্যান একটা হাত ওঠাল।

আমাকে দিয়ো না, বলল সে। আরেকজনের এগুলো বেশি। দরকার।

হঠাৎই চোখ ধাঁধানো আলো ঝলসে গেল ট্রী হাউসের ভিতর দিয়ে। প্রচণ্ড এক গর্জন উঠল, তারপর নীরবতা।

কিশোর আর জিনা যখন চোখ মেলল, ওরা তখন আর জাদুর ট্র হাউসে নেই।

তার বদলে বিশাল এক ছায়াময় কামরায় দাঁড়িয়ে। ঘরে চমৎকার এক সুগন্ধ-চামড়া, বই আর কাঠ-পোড়া আগুনের।

পেল্লায় এক পাথুরে চুলায় ফট-ফট শব্দে ফাটছে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। দেয়ালগুলোতে সারি সারি লম্বা বইয়ের তাক-বই ভর্তি।

আমার লাইব্রেরিতে স্বাগতম, মৃদু কণ্ঠে বলল মরগ্যান।

বাব্বা, ফিসফিস করে বলল কিশোর। দারুণ তো!

একজন তোমাদের জন্যে অপেক্ষায় আছেন, বলল মরগ্যান।

আমি তাকে বলেছি শীঘি দুজন বিশেষ দূত এসে পৌঁছবে।

কোথায় তিনি? জিনার প্রশ্ন।

মরগ্যান আঙুল তাক করল। গাঢ় নীল পোশাক পরা এক লোক লাইব্রেরির এক কোনায় চেয়ারে বসে। মাথা নোয়ানো তার। কাঁচা পাকা চুল।

ক্লান্ত মনে হচ্ছে, ফিসফিস করে বলল জিনা।

হ্যাঁ, উনি এবং ওঁর নাইটরা পরাজিত হয়েছেন, শান্ত কণ্ঠে বলল মরগ্যান। উনি রাজ্য রক্ষার আশা ছেড়ে দিয়েছেন।

আমরা ওঁকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি? জিনার প্রশ্ন।

কিশোরের হাতে ধরা বিশেষ লেখাটির দিকে চোখ নামিয়ে চাইল। মরগ্যান।

এটা দেখালে কাজ হবে? কিশোর জানতে চাইল।

স্মিত হাসল মরগ্যান।

যাও, দেখাও ওঁকে! বলল জিনা।

ওরা কামরাটা পার হয়ে ক্লান্ত মানুষটির সামনে নতজানু হয়ে বসল।

মাফ করবেন, বলল জিনা।

মানুষটি চোখ তুলে চাইলেন। ধূসর চোখের মণিতে বিষণ্ণ দৃষ্টি।

আমরা মরগ্যানের দূত। আমরা সাহায্য করতে এসেছি, জানাল কিশোর।

মাথা নাড়লেন মানুষটি।

বুঝতে পারছি না, গভীর, ক্লান্ত স্বরে বললেন তিনি, তোমাদের মত বাচ্চামানুষরা কীভাবে সাহায্য করতে পারে!

কখনও কখনও ছোটরাও অনেক কাজে আসে, বলল জিনা।

কিশোর আর আমি আহত সৈনিকদের সাহায্য করেছি।

আমরা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদেরও সাহায্য করেছি, যোগ করল কিশোর।

মানুষটি খানিকটা সোজা হয়ে বসলেন।

বাহ, চমৎকার, সপ্রশংস কণ্ঠে বললেন।

কীভাবে করেছি আপনাকে জানাতে চাই, বলল জিনা। গৃহযুদ্ধের সেই তালিকাটা তুলে ধরে দেখাল। আহতদেরকে কীভাবে সাহায্য করতে হয় তা এখানে আছে।

এবার কিশোর স্যান ফ্রান্সিসকো ভূমিকম্পের সময় পাওয়া কাঠের টুকরোটা তুলে ধরল।

এতে বলছে সব হারানোর পরও আশা টিকে থাকে, বলল ও।

বিশেষ লেখা দুটি এক ঝলক দেখে নিলেন মানুষটি। এবার অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে কিশোর আর জিনার দিকে চাইলেন।

এগুলো আমার কাছে নিয়ে আসার জন্যে ধন্যবাদ, বললেন তিনি। তোমরা কি জাদু জানো?

না, না, বলে উঠল জিনা। মরগ্যান জাদু জানে। আমরা সাধারণ ছেলে-মেয়ে।

মানুষটি মৃদু হাসলেন। তাঁকে এখন আগের চাইতে কম ক্লান্ত আর বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।

আর আমি সাধারণ এক রাজা, মৃদু কণ্ঠে বললেন। দুটো সাধারণ ছেলে-মেয়ে যদি সাহস আর আশা খুঁজে পেতে পারে, তা হলে একজন সাধারণ রাজারও তা পাওয়া উচিত।

ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

যাই নাইটদের সাথে কথা বলিগে, বললেন। তোমাদের আনা জ্ঞানের কথা ওদেরকে জানাই।

আলখিল্লা জড়িয়ে নিয়ে কিশোর আর জিনার উদ্দেশে বাউ করলেন।

ধন্যবাদ, বললেন। এবার দৃপ্তপায়ে, বেরিয়ে গেলেন মরগ্যানের লাইব্রেরি ছেড়ে।

হ্যাঁ, ধন্যবাদ, বলে ওদের দিকে এগিয়ে এল মরগ্যান।

ইউ আর ওয়েলকাম, বলল ওরা।

এগুলো আপনার লাইব্রেরির জন্যে, বলল কিশোর। বিশেষ লেখাগুলো তুলে দিল মরগ্যানের হাতে।

মরগ্যান স্মিত হাসল।

এখানে যে সব পাঠক আসবে এগুলো তাদের কাজে লাগবে, বলল।

খুব ভাল, বলল জিনা। না, তোমাদের বাড়ি ফেরার সময় হলো, বলল মরগ্যান।

কিশোর মরগ্যানের লাইব্রেরির চারধারে নজর বুলাল। ওর যেতে মন চাইছে না। এত সুন্দর কামরা ও এর আগে দেখেনি।

চিন্তা নেই, তোমরা আবার ফিরে আসতে পারবে, বলল মরগ্যান, ওর মনোভাব বুঝতে পেরেছে। তোমরা অবশ্যই আসবে, কারণ তোমাদের জন্যেই ক্যামেলট রক্ষা পেয়েছে। আপাতত বিদায়।

কিশোর আর জিনা মুখ খুলতে পারার আগেই, আরেকটি চোখ ধাঁধানো আলোর ঝলকানি দেখা গেল।

এবার ওরা পৌঁছে গেল ট্রী হাউসে, ফ্রগ ক্রীক বনভূমিতে-ভোর বেলায়।

১০

বিশ্বাসই হচ্ছে না আমরা মরগ্যানের লাইব্রেরি থেকে ঘুরে এসেছি, বলল জিনা।

কিশোর মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকাল।

অবিশ্বাস্য না? বলল জিনা।

হ্যাঁ, বলল কিশোর।

এসময় দমকা হাওয়া প্রবেশ করল ট্রী হাউসের জানালা দিয়ে। ফলে, স্যান ফ্রান্সিসকো নিয়ে লেখা ওদের গবেষণার বইটা খুলে গেল। জিনা বইটার দিকে হাত বাড়াল।

কিশোর! বলল সে। এটা দেখো!

বইটার এক ফটোগ্রাফে আঙুল রাখল। ওটায় দেখা গেল ধুলোয় মাখামাখি এক ছেলে ও এক মেয়েকে। ছেলেটির হাতে এক টুকরো কাঠ। আশা জাগানিয়া সেই কবিতাটি।

জিনা ক্যাপশনটা পড়ে শোনাল:

ভূমিকম্পের পরে, গোটা শহর যখন গ্রাস করে
নিচ্ছে আগুন, তখন দুটি সাহসী ছেলে-মেয়ে
অন্যদের মনে আশা জাগানোর চেষ্টা করে।

হেসে উঠল জিনা।

আমাদের কথা লিখেছে! বলল ও। আমরা স্যান ফ্রান্সিসকো ছেড়ে আসার আগে জন এই ছবিটা নেয়।

কিশোর হেসে উঠে মাথা ঝাঁকাল। বিস্মিত।

বইটা বন্ধ করল জিনা।

আমরা রাজা আর্থারকেও আশা দেয়ার চেষ্টা করেছি, বলল কিশোর। তাই না?

রাজা আর্থার? জিনার প্রশ্ন।

হ্যাঁ, বলল কিশোর। ব্যাক-প্যাক পিঠে নিয়ে দড়ির মই বেয়ে নামতে লাগল। ওটাই মরগ্যানের লাইব্রেরির রহস্য। ক্যামেলটকে রক্ষার জন্যে রাজা আর্থারকে আশা আর সাহস দেয়ার দরকার ছিল, আমরা সেটা দিয়েছি।

উনি রাজা আর্থার নন,বলল জিনা। কিশোরকে অনুসরণ করল।

অবশ্যই রাজা আর্থার, বলে মাটিতে পা রাখল কিশোর। উনি বললেন শোননি উনি একজন সাধারণ রাজা?

কিন্তু রাজা আর্থার তো কোন সাধারণ রাজা নন।

উনি তেমনটাই ভাবেন। আমি জানি উনিই রাজা আর্থার, বলল কিশোর।

স্মিত হাসল ও। বনভূমি ভেদ করে পা চালাল।

জিনা ওকে অনুসরণ করল।

রাজা আর্থার!

পাখির গানে ভোরের বনভূমি ভরপুর, জিনা মরগ্যানের লাইব্রেরিতে ওদের বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবল। বিষাদগ্রস্ত রাজার কথা মনে পড়ল ওর এবং কীভাবে ওদের জোগাড় করা লেখাগুলো তাকে সাহস জুগিয়েছে।

কিশোর মনে হয় ঠিকই বলেছে। ওরা সত্যিই হয়তো ক্যামেলটকে রক্ষায় সাহায্য করেছে রাজা আর্থারকে। আবার কোনদিন হয়তো ওরা

ওখানে ফিরে যাবে।

জলদি চলো! চেঁচিয়ে ডাকল কিশোর। আঙ্কল-আন্টি জেগে ওঠার আগেই।

আসছি! পাল্টা চেঁচাল জিনা। দৌড় দিল কিশোরের পিছু পিছু।

Exit mobile version