কিশোর আর জিনা চারধারে নজর বুলাল।
অনেক লোক এখন বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে। কেউ কেউ পাহাড় টপকে। কেউ বা আবার পাহাড় বেয়ে নেমে এসে।
এক বৃদ্ধা হাঁড়ি-পাতিল ভর্তি ঠেলাগাড়ি ঠেলে নিয়ে চলেছে। এক, মেয়ে বইছে এক সুটকেস ও একটা বিড়াল। এক ছেলের হাতে এক পাখির খাঁচা ও এক মাছের পাত্র দেখা গেল।
একেকজন একেক দিকে যাচ্ছে, বলল জিনা।
গোল্ডেন গেট পার্ক কোথায় কে জানে, বলল কিশোর। আমাদেরও মনে হয় ওখানে যাওয়া দরকার। দেখি তো বইতে কোন ম্যাপ আছে কিনা।
গবেষণার বইটা দেখে নিল কিশোর। স্যান ফ্রান্সিসকোর এক মানচিত্র খুঁজে পেল।
আমরা এখন কোথায়? জিজ্ঞেস করল ও।
স্ট্রীট সাইন খুঁজছে, এক লোককে এক গাদা বই বয়ে নিয়ে। বেরোতে দেখল সুদৃশ্য এক দালান থেকে। এক ঘোড়ায়-টানা ওয়াগনের পিছনদিকে বইগুলো রাখল সে।
কী করছে? কিশোরের প্রশ্ন।
মনে হয় বইগুলো বাঁচাচ্ছে, বলল জিনা।
বই বাঁচাচ্ছে? বলল কিশোর। মহর্তের জন্য নিজেদের নিরাপত্তার কথা বেমালুম ভুলে গেল ও। জলদি চলো, হেল্প করতে হবে!
৫
কিশোর আর জিনা রাস্তা ধরে দৌড়ে গেল বইয়ের ওয়াগনটার কাছে। লোকটি সযত্নে ওয়াগনের পিছনে বইগুলো সাজিয়ে রাখছে। তার সারা শরীরে ধুলো। চশমার কাঁচ ফাটা।
আচ্ছা, স্টোরিটা কী? জিনা প্রশ্ন করল লোকটিকে।
কিশোর হেসে ফেলল। ঠিক খবরের কাগজের রিপোর্টারের মত শুনিয়েছে জিনার কথাগুলো।
দুপ্রাপ্য বইগুলো প্যাভিলিয়নে সরিয়ে নিচ্ছি, বলল লোকটি।
আমরা কি সাহায্য করতে পারি? কিশোরের জিজ্ঞাসা।
নিশ্চয়ই, দরজার পাশে আর অল্প কিছু বই আছে, বলল লোকটি।
ওগুলো নিয়ে এসো! জলদি! মার্কেট স্ট্রীটের আগুন শীঘ্রি এদিকে ছড়িয়ে পড়বে।
কিশোর আর জিনা এক দৌড়ে দালানটার ভিতরে ঢুকে পড়ল। দরজার কাছে বইয়ের ছোট দুটো স্তূপ।
কিশোর আর জিনা একটা করে গাদা তুলে নিল। বইগুলো প্রাচীন আর সুদৃশ্য। কোন কোনটার প্রচ্ছদ চকচকে সোনালী।
ওয়াও, ফিসফিস করে বলল কিশোর।
ও আর জিনা বইগুলো বয়ে নিয়ে গেল বাইরে।
সাবধানে, প্লিজ! বলল লোকটি। প্রত্যেকটা বই অমূল্য সম্পদ-প্রাচীন বাইবেল আর হাতে ছাপা বই।
লোকটা সাবধানী হাতে কিশোর আর জিনার বাহু থেকে বইগুলো নিয়ে ওয়াগনের পিছনে তুলে রাখল।
ধন্যবাদ, বলে হ্যাটটা পিছনদিকে ঠেলে দিল সে। এখুনি বাড়ি চলে যাও! আগুন শীঘ্রিই এখানে পৌঁছে যাবে!
ঘোড়াগুলো পাহাড় বেয়ে যখন উঠছে, জিনা হাত নেড়ে চেঁচিয়ে উঠল, গুড লাক!
লোকটা মনে হয় লাইব্রেরিয়ান, বলল কিশোর। গবেষণার বইটা খুলল ও। বাড়িটার একটা ছবি খুঁজে নিল।
এই যে, বলল। জোরে জোরে পড়ল: লোক-জন বিশেষ বিশেষ জিনিস রক্ষা করার চেষ্টা করে। কিন্তু সবক্ষেত্রে সফল হয়নি। লাইব্রেরির দুপ্রাপ্য বই সরিয়ে নেয়া হয় প্যাভিলিয়ন বিল্ডিঙে। প্যাভিলিয়ন বিল্ডিঙে আগুন ধরে গেলে, সব বই পুড়ে যায়। অথচ মূল বাড়ি, যেটিতে বইগুলো ছিল সেটি পোড়েনি।
হায়, হায়! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর, দাঁড়ান, দাঁড়ান!
এ গবেষণার বইটা চেপে ধরে, ওয়াগনের পিছন পিছন দৌড় দিল। জিনাও দৌড়ল ওর সঙ্গে।
দাঁড়ান! দাঁড়ান! দুজনেই চেঁচাল। ভাঙা নুড়িপাথরের উপর দিয়ে যথাসম্ভব জোরে ছুটল ওরা। উঠে যাচ্ছে খাড়া পাহাড় বেয়ে।
চুড়োর কাছে পৌঁছে ড্রাইভার শেষমেশ শুনতে পেল। ওয়াগন দাঁড় করাল সে।
প্যাভিলিয়নে যাবেন না! চেঁচিয়ে বলল কিশোর।
যেখানে ছিল সেখানে ফেরত নিয়ে যান! বলল জিনা।
ওখানে থাকলে বইগুলো পুড়বে না! বলল কিশোর। শ্বাস ফিরে পেতে চাইছে। যে বিল্ডিঙে নিয়ে যেতে চাইছেন বরং সেটাই পুড়ে যাবে!
কিশোর আর জিনার দিকে এমনভাবে তাকাল ড্রাইভার, ওরা যেন বদ্ধ উন্মাদ।
তোমরা নিজেদের নিয়ে ভাবো, বই নিয়ে ভাবতে হবে না, বলল সে, বাসায় বাবা-মার কাছে চলে যাও। লাইব্রেরির ব্যবস্থা আমি করব।
এবার লাগাম আছড়ে পাহাড়-চুড়ো ধরে এগিয়ে চলল ওয়াগন নিয়ে।
দোহাই আপনার, ফিরে আসুন! চেঁচাল কিশোর।
ওরা অসহায় চোখে দেখল ঝাঁকুনি খেতে খেতে, জঞ্জালের উপর দিয়ে গড়িয়ে চলেছে ওয়াগনটা। পাহাড়ের নীচ থেকে ধোঁয়া পাকিয়ে উঠছে।
শুনল না! বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলল কিশোর।
আমরা তো যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি, বলল জিনা। আলতো হাতে কিশোরের কাধ স্পর্শ করল।
এতগুলো বই… হারিয়ে গেল কিশোরের কণ্ঠ।
অ্যাই, বলল জিনা, কে যেন ওদিকে কাঁদছে-সাথে দুটো বাচ্চা। আমরা হয়তো ওদেরকে হেল্প করতে পারব।
৬
নীল বাথরোব পরা এক মহিলা বসে ভাঙাচোরা এক পাথুরে দেয়ালের উপর। রুমালে মুখ ঢেকে ফোঁপাচ্ছে।
কালোচুলো দুটি ছেলে মহিলার পাশে বসা। তাদের পরনে ধুলোমাখা, ছেঁড়া পাজামা। দুজনেই খালি পা। ছোট ছেলেটি বড় ছেলেটিকে চারকোনা এক কাঠের উপর কয়লা দিয়ে লিখতে দেখছে।
জিনা কিশোরকে টেনে নিয়ে গেল পরিবারটির কাছে।
হাই, আমি জিনা, বলল ও।
ছেলে দুটি মুখ তুলে চাইল।
আমি পিটার, ছোটজন বলল। ও আমার ভাই অ্যাণ্ড। আর উনি আমাদের খালা মেরি। কথা বলার সময় ভাইকে আর খালাকে দেখিয়ে দিল।
মেরি খালা কান্নাভেজা চোখে হাসার চেষ্টা করলেন।
কিছু মনে কোরো না, বললেন তিনি, আমার ঘোরটা এখনও কাটেনি।
আমাদেরও, সহানুভূতির কণ্ঠে বলল জিনা।
বাড়িটায় আগুন লেগে যায়, বলল পিটার।