আমার কাছে দাও, বলল জিনা। বইটা নিয়ে ভাঙা এক রাস্তার ছবি বের করল।
জোরে জোরে পড়ল:
১৯০৬ সালের এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখ, ভোর ৫:১৩ মিনিটে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের অন্যতম বড় ভূমিকম্পে ঘুম থেকে জেগে ওঠে স্যান ফ্রান্সিসকোর নাগরিকরা। কেউ কেউ একে মহাকম্পন বলে।
একেবারে কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে, বলল কিশোর।
মনে হয় অনেক লোক আহত হয়েছে, বলল জিনা।
চারধারে দৃষ্টি বুলাল ওরা। ধুলোময় বাতাস ভেদ করে, পড়ো পড়ো বাড়ি-ঘর ছেড়ে টলতে টলতে বেরিয়ে আসছে মানুষ-জন। সবার পা খালি, পরনে রাতপোশাক।
বাচ্চারা কাঁদছে। তবে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, বড়রা সব চুপ। ফাটা রাস্তা আর ভাঙা বাড়ি-ঘরের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। তারা।
সবাই শকের মধ্যে আছে, বলল জিনা।
ওদের কেমন লাগছে চিন্তা করো, বলল কিশোর। চারদিকের ধ্বংসস্তূপ দেখে নিল ও। ইতিকর্তব্য ঠিক করে উঠতে পারছে না। স্বচ্ছ চিন্তা বাধা পাচ্ছে।
বইটার দিকে আবারও চাইল জিনা। পড়ল জোরে জোরে: ভূমিকম্পের ঠিক পরপরই ভাঙা চিমনি, চুলো আর প্রদীপ ভয়ানক অগ্নিকাণ্ডের সূচনা করে। আগুন।
জ্বলে প্রায় তিন দিন ধরে, প্রায় গোটা স্যান ফ্রান্সিসকো ধ্বংস হয়ে যায়। আটাশ হাজারের বেশি বাড়ি-ঘর পুড়ে যায়।
ভয়ঙ্কর, বলল কিশোর। দূরে, কালো ধোঁয়ার মেঘ আকাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠেছে।
আগুন লেগেছে! বলল জিনা।
৪
আমাদের চলে যাওয়া উচিত, ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগেই এশহর ছাড়তে চায় ও।
মরগ্যানের লাইব্রেরির জন্যে তো লেখাটা এখনও জোগাড় হয়নি-সামথিং টু লেণ্ড।
খুঁজি এসো, বলল কিশোর।
ভগ্নস্তূপ ভেদ করে হাঁটা ধরল ওরা। ইঁটের গাদা, কংক্রিটের চাঙড়, আর ভাঙা কাঁচ মাড়িয়ে।
পড়ে থাকা প্রদীপ আর দোমড়ানো ট্রলি-কারের রাস্তা পেরিয়ে এল দুজনে।
বাড়ি-ঘর হেলে পড়েছে এক পাশে। লোক-জন রাস্তায় মাল-পত্র টেনে বের করছে।
এখন আমাদের মিশনের কথা ভুলে যাও, বলল জিনা। মানুষকে সাহায্য করতে হবে।
সাহায্য? কীভাবে? প্রশ্ন করল কিশোর। মাথার ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ওর।
এসো, বলল জিনা।
কিছু লোকের দিকে ইশারা করল ও। তারা পাগলের মত এক বিল্ডিং থেকে কটা থলে টেনে বের করে ঘোড়ায়-টানা এক ওয়াগনে তুলছে।
ওয়াগনটার কাছে দৌড়ে গেল জিনা।
কী করছেন আপনারা? জানতে চাইল।
ব্যাঙ্কের থলেগুলো বন্দরে নিয়ে যেতে চাইছি, বলল ওয়াগনের ড্রাইভার। যাতে নৌকায় করে এগুলো পার করা যায়।
কেন? প্রশ্ন করল কিশোর।
আগুনের হাত থেকে মানুষের টাকা-পয়সা বাঁচাতে হবে না? লোকটা বলল।
আকাশের দিকে তর্জনী তাক করল সে। ধোঁয়ার মেঘ ক্রমেই আরও বড় আর কালো হচ্ছে।
আমরা কি হেল্প করতে পারি? জিনার জিজ্ঞাসা।
কাজ হয়ে গেছে, জানাল ড্রাইভার। তোমরা এখুনি বাসায় চলে যাও। তারপর বাবা-মাকে নিয়ে শহর ছাড়ো।
কিশোরের ইচ্ছে হলো ওয়াগনে চেপে ও আর জিনাও বন্দরে যায়। তা হলে আগুনের কবল থেকে বাঁচতে পারত। কিন্তু দেখতে পেল ওয়াগনে ওদের জায়গা হবে না।
গুড লাক! বলল জিনা।
আমার কথাগুলো মনে রেখো কিন্তু! ড্রাইভার বলল। এবার সে আর তার ঘোড়াগুলো রওনা হয়ে গেল। ওয়াগনটা বড় রাস্তায় পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল পাহাড়ের ওপাশে।
বুঝতে পারছি না কাদেরকে হেল্প করব, বলল জিনা।
কিশোর গভীর শ্বাস টানল। তারপর নোটবই বের করে এলোমেলো হাতে লিখল:
ব্যাঙ্কের টাকা-ওয়াগনে করে বন্দরে-সেখান থেকে নৌকায় তুলে নিরাপদ জায়গায়।
অ্যাই, স্টোরিটা কী? এক মহিলা প্রশ্ন করল। তার কণ্ঠস্বরে জরুরী তাগিদ।
ঝট করে মুখ তুলে চাইল কিশোর।
এক লোক আর এক মহিলা ওদের সামনে দাঁড়িয়ে। মহিলার পরনে লম্বা পোশাক। হাতে নোটবই। লোকটির পরনে বুট। বড়সড় এক ক্যামেরা আর এক তেপায়া স্ট্যাণ্ড বইছে।
কীসের স্টোরি? জিজ্ঞেস করল জিনা।
ব্যাঙ্কের স্টোরিটা। আমার নাম লিণ্ডা। আমি একজন রিপোর্টার, জানাল মহিলাটি।
টেলিভিশনের? প্রশ্ন করল জিনা।
সেটা আবার কী? প্রশ্ন করল লিণ্ডা।
কিছু না, বলল কিশোর। ফিসফিস করে জিনাকে বলল, উনি খবরের কাগজের রিপোর্টার। টিভি এখনও আবিষ্কৃত হয়নি।
ও, আচ্ছা, বলল জিনা। বিব্রত।
ওয়াগনের ব্যাপারটা কী? লিণ্ডা জিজ্ঞেস করল কিশোর আর জিনাকে।
কিশোর ওর নোটবইটার দিকে চাইল।
বন্দরে নিয়ে গিয়ে টাকার থলেগুলো নৌকায় তুলে পাঠিয়ে দেবে, যাতে পুড়ে নষ্ট না হয়।
গুড রিপোর্টিং, বাছা! বলল মহিলা। জন ব্যাঙ্কের একটা ছবি নাও।
ফটোগ্রাফার স্ট্যাণ্ডের উপর ক্যামেরা রাখল। কালো এক পর্দার নীচে মাথা রেখে একটা ছবি তুলল।
নিয়েছি, জানাল।
ফটোগ্রাফার তার যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নিচ্ছে, এসময় লিণ্ডা ঘুরে চাইল কিশোর আর জিনার দিকে।
বাড়ি গিয়ে বাবা-মাকে নিয়ে সরে পড়ো, বলল। আগুন ছড়িয়ে পড়ছে।
জানি, বলল জিনা, তিন দিন শেষে, আগুনে স্যান ফ্রান্সিস্কোর প্রায় গোটাটা পুড়ে যাবে।
লিণ্ডাকে কৌতূহলী দেখাল।
কীভাবে জানলে? জবাব চাইল।
আন্দাজে বলেছে, চটপট জানাল কিশোর।
ওর আন্দাজটা ভয়ঙ্কর, বলল লিণ্ডা। বাবা-মাকে বোলো ফেরি না। ধরতে। ফেরি বিল্ডিঙে মানুষের প্রচণ্ড ভিড়। গোল্ডেন গেট পার্কে চলে যাও।
পরামর্শের জন্যে ধন্যবাদ, বলল জিনা।
স্টোরির জন্যেও ধন্যবাদ, বলল লিণ্ডা। এবার সে আর জন দ্রুত পা চালাল।