গবেষণা করলে সময় নষ্ট করা হয় না, গলা চড়িয়ে বলল কিশোর।
কিন্তু কাঁধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে নিয়ে দড়ির মই বেয়ে ঠিকই অনুসরণ করল জিনাকে। দুজনেই ঘাসে নামার পর, কিশোর চারধারে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল।
কোথায় যেতে চাও? প্রশ্ন করল ও।
যে কোনখানে! বলল জিনা। আশপাশটা ঘুরে দেখি এসো, টুরিস্টের মত।
ঠিক আছে, বলল কিশোর। কিন্তু ভুলে যেয়ো না মরগ্যানের জন্যে লেখাটা খুঁজে বের করতে হবে।
নুড়ি বিছানো রাস্তাটা ধরে পা চালাল ওরা। পাহাড়ী ঢাল বেয়ে উঠে যাচ্ছে, উঁচু দালানগুলোর মাথা ছাড়িয়ে সূর্য উঠল।
ভোরের প্রথম আলোয় সব কিছুতে সোনালী রং ধরল: পাথর, স্ট্রীটল্যাম্প এবং নীরব বাড়িগুলোর সমস্ত কাঁচের জানালায়।
কী চুপচাপ চারদিক, বলল জিনা।
হ্যাঁ, সবাই মনে হয় ঘুমাচ্ছে, বলল কিশোর।
হঠাৎই গুড়গুড় করে এক শব্দ উঠল।
কিশোর থমকে দাঁড়াল। জিনার হাত চেপে ধরেছে।
কীসের শব্দ? বলল ও।
আওয়াজটা জোরাল হলো। মনে হচ্ছে মাটির নীচ থেকে বাজের শব্দ আসছে।
মাটি কাঁপতে শুরু করল।
খেপাটে শব্দে বেজে চলেছে গির্জার ঘণ্টাগুলো।
গোটা রাস্তা কাঁপছে। মহাসাগরের ঢেউয়ের মত ভেসে যাচ্ছে নুড়িপাথরগুলো।
কী হচ্ছে এসব? চেঁচিয়ে উঠল জিনা।
ছাদ থেকে চিমনি খসে পড়ছে!
গ্যাসলাইট ছিটকে পড়ছে!
রাস্তায় চূর্ণ-বিচূর্ণ হচ্ছে ইঁট।
বসে পড়ে মাথা ঢাকো! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে, গুটিসুটি মেরে বসে পড়ল কিশোর আর জিনা। চারপাশে গুড়-গুড়, ঠনঠন, মড়মড় শব্দ।
এবার দুনিয়া স্থির হলো। গুড়গুড় শব্দটা থেমেছে।
কিশোর আর জিনা মাথা তুলল। বাতাস ধুলোয় ভরা।
থেমেছে, বলল কিশোর।
মনে হয় ভূমিকম্প! বলল জিনা।
হ্যাঁ, সায় জানাল কিশোর।
তোমাকে জায়গাটা সম্পর্কে আরেকটু রিসার্চ করতে দিলে ভাল হত, বলল জিনা।
হুঁ, বলল কিশোর।
ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়াল ও দুপা টলছে। প্যান্ট ঝেড়ে নিতেই, গভীর গুড়গুড় শব্দটা আবারও শোনা গেল-এবার আগের চাইতেও জোরাল।
পরমুহূর্তে আরম্ভ হলো ভয়ঙ্কর ঝাঁকুনি। আগের চেয়ে জোরে।
কিশোর ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। রাস্তা দস্তুর মত দুলছে, কাঁপছে। শক্ত নুড়িপাথরে ঝাঁকি খাচ্ছে ওর দেহ।
জিনা! চেঁচাল ও।
উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল কিন্তু পড়ে গেল আবারও। ধুলোময় বাতাস ভেদ করে দেখতে পেল, আকাশের পটভূমিতে এপাশ-ওপাশ দুলছে উঁচু-উঁচু বাড়িগুলো!
হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে ছাদ!
রাস্তার এমাথায়-ওমাথায় ইঁট, কাঁচ আর কংক্রিটের বৃষ্টি ঝরছে!
মনে হলো যেন দীর্ঘ সময় বাদে ভয়ঙ্কর শব্দ আর দুলুনিটা শেষমেশ থামল।
৩
ধুলোর মেঘ পাক খাচ্ছে কিশোরকে ঘিরে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। দৃষ্টি চলে। তবে জিনার কাশির শব্দ শুনতে পাচ্ছে ও।
কিশোর ওকে ডাকার জন্য মুখ খুলল। কিন্তু গলা বুজে গেল ধুলোয়।
কিশোর! কাশির ফাঁকে নাম ধরে চেঁচাল জিনা। কিশোর!
আমি এখানে! বোজা কণ্ঠে বলল কিশোর।
বিপদে পড়ে গেছি, বলল জিনা।
উঠে বসতে চেষ্টা করল কিশোর। সারা গায়ে ব্যথা। কাপড় ছিঁড়ে গেছে। ধুলোয় মাখামাখি। ক্যাপটা উধাও।
কোথায় তুমি? চেঁচাল ও।
এখানে! বলল জিনা।
উঠে দাঁড়াতে গেল কিশোর। কিন্তু পড়ে গেল আবারও। পা জোড়া যেন রবার।
কো-কোথায়? পুনরাবৃত্তি করল ও। চারধারে নজর বুলাল। কিন্তু ঘন ধুলোর কুয়াশা ভেদ করে জিনাকে দেখতে পেল না।
মাটিতে পড়ে গেছি! বলল জিনা।
কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে গুঁড়ি মেরে এগোল কিশোর।
কথা চালিয়ে যাও, বলল ও।
এখানে- কাশল জিনা- এখানে!
দুহাতে একটা পাথুরে তাক অনুভব করল কিশোর। রাস্তার বিশাল এক ফাটলের দিকে চোখ নামিয়ে চাইল। ধুলো ভেদ করে ওর ঠিক নীচে জিনাকে দেখতে পেল।
এই তো! কাশির দমকের ফাঁকে বলল জিনা।
আমি তোমাকে টেনে তুলব, ভয় পেয়ো না, বলল কিশোর।
জিনার দুহাত চেপে ধরল ও। ফাটলের ভিতর থেকে টেনে তুলতে চেষ্টা করল, কিন্তু জিনা যথেষ্ট ভারী।
পারছি না, বলল কিশোর।
আমি দাঁড়াতে পারি এমন কিছু একটা দাও, বলল জিনা। তা হলে হয়তো নিজেই বের হতে পারব।
কিশোর উঠে দাঁড়িয়ে টলতে টলতে সরে গেল ফাটলের কাছ থেকে। এক গাদা ইঁট জড় করল ও। এবার ফাটলের কাছে ফিরে গিয়ে একটা একটা করে ইঁট জিনাকে দিল।
জিনা সাবধানে একটার উপর একটা ইঁট সাজাল।
আরও লাগবে, বলল সে।
কিশোর দৌড়ে গেল আরও হঁট জোগাড় করতে। ওর মনে আতঙ্ক, আরেকবার ভূমিকম্প হলেই ফাটলটা বন্ধ হয়ে যাবে-ভিতরে জিনাকে নিয়ে!
ইঁটগুলো জিনার হাতে দিল ও।
জলদি! জরুরী কণ্ঠে তাগিদ দিল।
জলদিই করছি, বলল জিনা।
মাজানো শেষ হলো জিনার। ইঁটের গাদার উপরে। দাঁড়াল ও। খালি হাত দুটো ব্যবহার করে ধীরে ধীরে টেনে তুলল নিজেকে।
কিশোর ওকে দাঁড়াতে সাহায্য করল। জিনার সারা দেহ ধুলোয় ঢাকা। স্টকিং ছিঁড়ে গেছে। চামড়া ছড়ে গেছে হাঁটুর।
লেগেছে? কিশোরের প্রশ্ন।
সামান্য চামড়া ছড়েছে শুধু, বলল জিনা। তুমি ঠিক আছ তো?
মাথাটা একটু কেমন কেমন লাগছে, বলল কিশোর। আসলে রীতিমত মাথা ঘুরছে ওর।
আমারও, বলল জিনা।
বিরাট ভূমিকম্প হয়ে গেল, বলল কিশোর। কাশল। গলা ধুলোয় বুজে গেছে।
জিনাও কাশল।
বইতে কী বলে? জিজ্ঞেস করল ও।
চামড়ার ব্যাগ থেকে গবেষণার বইটা টেনে বের করল কিশোর। হাত কাঁপছে ওর। পাতা উল্টাতে কষ্ট হচ্ছে।