জেফরির দিকে ফিরল কিশোর। আগুন লাগল কীভাবে?
জানি না, মাথা নাড়লেন জেফরি। লাকড়ি আনতে বনে গিয়েছিলাম আমরা। ফিরে এসে দেখি জানালায় আগুনের আলো। দেখেই বুঝে গেলাম, চিমনির আগুন না।
কী করে বুঝলেন? জিজ্ঞেস করল মুসা।
জবাব দিতে যাচ্ছিলেন জেফরি, বাধা দিল মুন। ফিসফিস করে বলল, বাবা, আস্তে। ব্ৰিণ্ডল জ্যাক আসছে।
শক্ত হয়ে গেল জেফরির চোয়াল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, আসতে দাও!
ঘুরে তাকাল কিশোর। ব্ৰিণ্ডল জ্যাককে দেখল। চেহারা আর ভাবভঙ্গি সন্দেহ জাগায়। মুখে বিচিত্র বাঁকা হাসি। ঠোটের এক কোণ বাঁকিয়ে হাসে। চোখে কুটিল দৃষ্টি।
দুঃখই লাগছে, জেফ, জ্যাক বলল। অবশ্য এমনিতেও পুরানো হয়ে গিয়েছিল কেবিনটা, নতুন আরেকটা বানাতে হতই। দেরি না করে শুরু করে দাও, বানাতে সময় লাগবে না। যে কাজটা ভাল, পারো, সেটা বাদ দিয়ে কেন যে জানোয়ার ধরতে যাও বুঝি না। ওসব তোমার কর্ম নয়। একটা পরামর্শ দিই শোনো, এখনও সময় আছে, জানোয়ার ধরা বাদ দিয়ে কেবিনের ব্যবসায় লাগো। গ্লিটারকে যদি সত্যিই থিম পার্ক বানানো হয় কখনও-এবং আমার বিশ্বাস, হবে-তাহলে কাজের অভাব হবে না তোমার।
তোমার পরামর্শ ছাড়াই এতকাল কাটিয়েছি, বাকি দিনগুলোও কাটাতে পারব! কঠিন কণ্ঠে বললেন জেফরি।
জ্যাকের ঠোটের কোণে হাসিটা বাড়ল। এই একটিবার অন্তত আমার পরামর্শ তোমাকে শুনতেই হবে, জেফ, নইলে শীতে জমে মরবে। যদি চাও তো তোমার কেবিন বানানোয় সাহায্য করতে পারি আমি।
ব্যঙ্গ করছে কি না জ্যাক বোঝা গেল না।
ভুরু কুঁচকে গেল জেফরির। চোখের পাতা সরু হয়ে এল। এত হাসি কেন তোমার মুখে, ব্ৰিণ্ডল? আগুন লাগানোয় তোমার হাত ছিল না তো?
না, ছিল না, সহজ কণ্ঠে জবাব দিল জ্যাক। থাকলে নিভানোয় সাহায্য করতে আসতাম না। তুমি তোক ভাল না, জেফ, তাই অন্যের জায়গায় ফাঁদ পেতে শয়তানি করতে পারো, কিন্তু আমি তো আর তোমার মত নই। যাক, কেবিনটা পুড়ে যাওয়ায় কিছুদিন শান্তিতে থাকতে পারব। এখানে তোমাকে কেবিন বানানোয় ব্যস্ত থাকতে হবে, বনে গিয়ে আমার ফাঁদ পাতায় বাগড়া দিতে পারবে না। টেনে টেনে হাসতে লাগল ও।
মুঠোবদ্ধ হয়ে গেল জেফরির হাত। শঙ্কিত হলো কিশোর। হাতাহাতি না বেধে যায়।
মুসাও চোখের পাতা সরু করে জ্যাকের দিকে তাকিয়ে আছে।
আগুনটা কীভাবে লেগেছে বলে তোমার ধারণা? জেফরি জিজ্ঞেস করলেন।
এটা কোনও প্রশ্ন হলো? জ্যাক বলল, ম্যাচের কাঠি, মশালের আগুন, ঘরের মধ্যে হ্যারিকেন উল্টে পড়া… কাঠের কেবিনে আগুন ধরানোটা কোন ব্যাপারই না। যেভাবেই ধরুক, তোমার কেবিনটার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে, জেফ। কিন্তু কী আর করবে। অ্যাক্সিডেন্ট তো আর বলে কয়ে আসে না।
ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল জ্যাক। ওর পিছু নিতে যাচ্ছিলেন জেফরি। ধরে ফেললেন এরিনা। না না, যেয়ো না।… বাইরে ঠাণ্ডা লাগছে। ঘরে চলো। চা খাই। রাতের খাওয়ার ব্যবস্থাও করতে হবে।
বাবা-মা চলে গেলে কিশোরদের দিকে ফিরল মুন। ফাঁদ পাতা নিয়ে বাবা আর ব্ৰিণ্ডল আঙ্কেলের ঝগড়াটা চিরকালের। দেখা হলেই শুরু করে। ঝগড়া না করে ওই সময়টা যদি থিম পার্ক নিয়ে মাথা ঘামাত, ভাল করত। থিম পার্কের কথা জোসি তোমাদের কিছু বলেছে নাকি?
বলেছে, জবাব দিল মুসা। পার্ক বানানোর ব্যাপারে তোমার বাবার কী মত?
বাবা পুরোপুরি এর বিপক্ষে, মুন বলল। বাবা বলে, থিম পার্কটা হতে দিলে আমরা হয়ে যাব সার্কাসের জানোয়ার। টুরিস্টরা আসবে, এমন ভঙ্গিতে তাকাবে আমাদের দিকে, যেন আমরা অদ্ভুত কোন জীব। প্রকৃতির মাঝে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকারও হারাব আমরা।
কিশোর জিজ্ঞেস করল, ব্রিণ্ডল জ্যাক কী বলে? সে কোন্ পক্ষে?
কীভাবে বলি? ও একটা অদ্ভুত চরিত্র। বাবা যদি কিছু করে, সে করবে ঠিক তার উল্টো। জেদ করেই যেন করে এ সব। হয়তো এ ক্ষেত্রেও বিপক্ষেই যাবে।
সেজন্যই কি তোমাদের কেবিনে আগুন ধরাল? হেসে বলল মুসা।
মুসার দিকে তাকাল মুন। না, এত পাগল না! শহরের বাড়িঘর যে সব কাঠের তৈরি, তা তো নিশ্চয় দেখেছ। শীতকালে শুকিয়ে ঠনঠনে হয়ে থাকে। বাতাস বইছে না বলে আজ বেঁচে গেছি। একটু বাতাস থাকলেই আমাদের কেবিনের আগুন সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ত। পুড়ে ছাই হতো গোটা শহর। পাগল হয়ে না গেলে এখানকার কোন লোক কারও ঘরে আগুন দেবে না, সেটা যার ঘরই হোক।
দুজনকে নিয়ে জোসিদের কেবিনে ঢুকল মুন। ঘরের ভিতরটা এখনও ঠাণ্ডা। তবে স্টোভের আগুনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। ঘর গরম হতে দেরি হবে না। গায়ের পার্কা খুলে ফেললেন এরিনা। ঝুলিয়ে রাখলেন দরজায় গাঁথা হুকে। পাঁচ গ্যালনের একটা ক্যান থেকে কেটলিতে পানি ঢেলে চুলায় চাপালেন।
দুটো খালি ক্যান তুলে নিতে নিতে মুন বলল, আরও পানি লাগবে। ঝর্না থেকে নিয়ে আসিগে।
একটা ক্যান দাও আমার হাতে, হাত বাড়াল মুসা। আমিও তোমার সঙ্গে যাই।
হাসল মুন। দরকার নেই। তুমি ভাবছ আমার কষ্ট হবে? এ সব আমাদের দৈনন্দিন কাজ, জন্মের পর থেকে করে আসছি। শ্লেজ নিয়ে চলে যাব। কোনও অসুবিধে হবে না।
মুন বেরিয়ে গেলে জোসি ঢুকল। মলিন হাসি হেসে বলল, খুব বিরক্ত লাগছে, না? আমাদের জীবন এমনই। বিপদে ভরা। নানা
প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে আমাদের টিকে থাকতে হয়।