বুঝতে পারছি না, চিন্তিত ভঙ্গিতে জবাব দিল জোসি। অনেক কিছুই ঘটতে পারে। তবে আগুন লাগাটা এখানে ভয়ানক ব্যাপার। পুরো শহরটাই কাঠের তৈরি।
টেডের দিকে তাকাল কিশোর। শহর থেকে দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে ওর স্লেজ। অবাক হলো কিশোর। আগুন দেখেনি নাকি? ওকে বলা দরকার।
চিল্কার করে ডাকল জোসি, টেড! এই টেড!
ফিরেও তাকাল না টেড। যেন জোসির ডাক ওর কানেই ঢোকেনি।
আবার ডাকল জোসি। এবারও তাকাল না টেড। কুকুর-বাহিনী নিয়ে ছুটতে ছুটতে সরে যেতে লাগল শহর থেকে দূরে।
থামল না কেন? মুসার প্রশ্ন।
এতদূর থেকে বোধহয় আমার ডাক শুনতে পায়নি, জবাব দিল জোসি।
কিন্তু কিশোরের যথেষ্ট সন্দেহ হলো। সমতল জমাট বরফের ওপর দিয়ে এমনিতেই শব্দ চলে বহুদূর। তা ছাড়া এখানে বাধা দেবার মতও কিছু নেই। জোসিকে উপেক্ষা করার জন্য শুনেও না শোনার ভান করেছে টেড। জরুরি কাজে সহায়তা করার জন্য ওকে ডাকা হয়েছে, সেটা নিশ্চয় বুঝতে পারেনি।
ওদেরকে নদীতীর পার করিয়ে আনল ডায়মণ্ডহার্টের দল। কেবিনের কাছের সমতল জায়গাটায় পৌঁছল স্লেজ। গাড়ি থামাল জোসি। লাফিয়ে নামল কিশোর ও মুসা।
ইতিমধ্যে শহরের লোক জড় হয়ে একটা স্বেচ্ছাসেবী অগ্নিনির্বাপক-বাহিনী গঠন করে ফেলেছে। নারী-পুরুষ সবই আছে তাদের মধ্যে। সবার হাতে বালতি। কেবিনের কাছ থেকে লম্বা সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে ওরা। সারির এক মাথা একটা পানির ট্যাংকের কাছে, অন্য মাথা কেবিনের কাছে। হ্যাণ্ড পাম্প লাগানো একটা লম্বা হোস পাইপ নিয়ে দৌড়ে এল তিনজন লোক।
দমকল নেই? চারপাশে তাকিয়ে দমকলের গাড়ি খুঁজতে লাগল মুসার চোখ।
নাহ, জোসি জানাল।
ট্যাংক থেকে পানি নিয়ে বালতি এগিয়ে দিতে থাকল অগ্নিনির্বাপকদের বালতি-বাহিনী। কেবিনের সবচেয়ে কাছে দাঁড়িয়েছে চওড়া কাঁধওয়ালা একজন শক্তিশালী পুরুষ। পাশের লোকটার হাত থেকে বালতি নিয়ে পানি ছুঁড়ে দিচ্ছে আগুনের ওপর। খালি বালতিটা পাশের লোকটাকে ফিরিয়ে দিয়ে আরেকটা ভরা বালতি নিচ্ছে ওর হাত থেকে। হাতে হাতে খালি বালতিটা চলে যাচ্ছে ট্যাংকের কাছে, পানি ভর্তি হয়ে আবার ফিরে আসছে প্রথমজনের হাতে। পানি বহনের কাজ দ্রুত চলছে এভাবে।
তুষার সরানোর একটা বেলচা তুলে নিয়ে কিশোরের দিকে ছুঁড়ে দিল জোসি। আরেকটা দিল মুসাকে। তৃতীয় আরেকটা নিজে নিয়ে চিৎকার করে বলল, আগুনে তুষার ফেলতে থাকো। বেলচা তুলে দেখাল, ওই যে আমার চাচা-চাচী।
বেলচায় করে তুষার তুলে নিয়ে কেবিনের খোলা জানালা দিয়ে ভিতরে ছুঁড়ে দিল কিশোর। ফেলতে থাকল এভাবে। কঠিন কাজ। অল্পক্ষণেই হাঁপিয়ে গেল। মুখ দিয়ে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে বরফ-কণায় রূপান্তরিত হচ্ছে বাতাস। বিচিত্র আকৃতি। কোনটা রিঙ, কোনটা লম্বা। মুসাও পাল্লা দিয়ে তুষার ফেলছে ঘরের ভিতর। ঘোঁৎ-ঘোৎ শব্দ বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে। এখন ওদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছে আরও অনেকে। জ্বলন্ত কেবিনটা ঘিরে ফেলেছে অগ্নিনির্বাপক-বাহিনী।
তুষার ফেলার দিকেই কিশোরের নজর ছিল এতক্ষণ, এখন খেয়াল করে দেখল, আগুনের শিখা আর দেখা যাচ্ছে না। শুধু ভলকে ভলকে উঠে যাওয়া সাদা ধোঁয়া। আগুনের কারণে দূরে সরে থাকতে বাধ্য হয়েছিল এতক্ষণ মেরুর ঠাণ্ডা। সুযোগ পাওয়ামাত্র কামড় বসাল আবার। গায়ে। কিশোরের মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল শিহরণ বয়ে গেল।
আগুনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জেতা মানুষগুলো উল্লাসে চিৎকার করে উঠল। চওড়া হাসি ফুটল কিশোর-মুসা-জোসির মুখেও। একে অন্যের পিঠ চাপড়ে দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করল ওরা।
চাচা-চাচী আর চাচাত বোন মুনস্টোনের সঙ্গে কিশোর ও মুসাকে পরিচয় করাতে টেনে নিয়ে গেল জোসি। স্তব্ধ হয়ে গেছে টিনুক পরিবার। সহায়-সম্পত্তি বলতে যা ছিল ওদের, কেবিনটার সঙ্গে সঙ্গে সব গ্রাস করে নিয়েছে আগুন।
খুব খারাপ লাগছে আমার, মিস্টার টিনুক, সহানুভূতির সুরে কিশোর বলল।
জোর করে মুখে দুর্বল হাসি ফোটালেন জোসির চাচী। জবাবটা তিনিই দিলেন। থ্যাংক ইউ। মিস্টার বলা লাগবে না, ওকে শুধু জেফরি বললেই চলবে। আমাকে এরিনা। আমরা এখানে অত সৌজন্য আর ফর্মালিটির ধার ধারি না। তোমাদের জন্য আমারও খারাপ লাগছে। গ্লিটারে এলে বেড়াতে, আর এ সময়ই এ রকম একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। খাতির-যত্নও করতে পারব না ভালমত। আজ রাতটা কোথায় কাটাব, সেটাই জানি না।
অত চিন্তা করছ কেন, চাচী, জোসি বলল। আমাদের বড় কেবিনটাতেই থাকো। ধীরে সুস্থে তোমাদের কেবিনটা আবার বানিয়ে নিয়ো।
নিজেদের কেবিনের পোড়া দরজার কাছে গিয়ে ভিতরে উকি দিলেন জোসির চাচা। দেখে, ফিরে এলেন আগের জায়গায়।
মুন জিজ্ঞেস করল, কী দেখলে, বাবা?
মুনকে দেখছে মুসা। বয়েসে ওদের চেয়ে বছরখানেকের ঘোট। সুন্দরী। গভীর নীল চোখ।
পিছন দিকটাতেই ক্ষতি বেশি হয়েছে, জেফরি জানালেন। কিছু জামা-কাপড় আর ফার্নিচার বোধহয় বাঁচানো যাবে।
বাঁচানো গেলেও সাফ করতে জান বেরোবে, মুন বলল। যে পরিমাণ কালিঝুলি আর ছাই পড়েছে।
স্টোভটা জ্বেলে দিয়ে আসি, জোসি বলল।
মুসা জিজ্ঞেস করল, আমরা কোনও কাজে লাগতে পারি?
মাথা নাড়ল জোসি, না। আমিই পারব।
যে কেবিনে কিশোরদের থাকতে দিয়েছে, তার পরের কেবিনটার দিকে এগোল জোসি।