উঠে বসল মুসা। মুখোমুখি বসল কিশোর। শ্লেজের পিছনে রানারের ওপর উঠে দাঁড়াল জোসি।
দারুণ গাড়ি। স্টিয়ারিং হুইল নেই। অ্যাক্সিলারেটর নেই, মুসা বলল।
সিটবেল্ট নেই। এয়ারব্যাগ নেই, বলল কিশোর।
হাসাহাসি করতে লাগল তিনজনে।
কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকাল ডায়মণ্ডহার্ট। উত্তেজনায় কাঁপছে। কিশোরের মনে হলো, কুকুরটাও যেন মজা পাচ্ছে ওদের রসিকতায়।
কুকুরগুলোর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠল জোসি, হাইক! হাইক!
জমাট তুষারে পা বসিয়ে টান দিল কুকুরগুলো। একসঙ্গে ঝাঁপ দিল সামনের দিকে। অসমতল বরফের ওপর দিয়ে ঝাকি খেতে খেতে নদীর দিকে ছুটল স্লেজ। আচমকা এই তীব্র গতিবেগ অবাক করল কিশোর ও মুসাকে।
হাইক! হাইক! আবার চিৎকার করে উঠল জোসি। বাঁ পায়ের ভর রানারে রেখে ডান পা নামিয়ে লগি দিয়ে নৌকা বাওয়ার মত করে ঠেলা মারছে, গতি বাড়াতে সাহায্য করছে কুকুরগুলোকে।
পার্কার গলার কাছের ফিতে বাধল কিশোর। মাথার হুড তুলে কান ঢাকল। বাতাসে বরফের ছোঁয়া। হাঁটার সময় এত গতিও থাকে না, এত বাতাসও লাগে না। কনকনে ঠাণ্ডা ইতিমধ্যেই ওর নাক-গাল অসাড় করে দিয়েছে।
নদীর পাড়ে পৌঁছল গাড়ি। জমাট বরফের ওপর গাড়িটা লাফিয়ে ওঠার সময় থাবা দিয়ে গাড়ির ধার খামচে ধরল কিশোর। ওর মনে হলো, আকাশে উড়াল দিয়েছে স্লেজ।
মহা আনন্দে চিৎকার করে উঠল মুসা, ইয়াহু!
পিচ্ছিল বরফে উঠে আসায় গতি বেড়ে গেল স্লেজের। আরও জোরে টানতে লাগল কুকুরগুলো। গতি বাড়ানোর জন্য ওগুলোরও যেন রোখ চেপে গেছে।
চিৎকার করে বলল জোসি, আরে থাম, থাম!
শীতের রৌদ্রালোকে ঝকঝক করছে সাদা বরফ। চোখে লাগে। চোখের পাতা সরু করে চারপাশে তাকাতে লাগল কিশোর। দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত সীমাহীন আলাস্কার বরফে ঢাকা এই আদিম প্রকৃতিতে কিছুই নড়ছে না, কোন শব্দ নেই, একমাত্র বরফের ওপর দিয়ে ছুটে চলা স্লেজ ও একপাল কুকুরের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া।
সামনে দুই ভাগ হয়ে গেছে পথটা। চিৎকার করে ডায়মণ্ডহার্টকে নির্দেশ দিল জোসি, জি! ডায়মণ্ড, জি!
মুহূর্তে ডানে মোড় নিল ডায়মণ্ডহার্ট।
ডানে ঘোরার জন্য জি, কিশোর বলল, বাঁয়ে ঘোরাতে হলে?
হউ! জোসি বলল। স্লেজ ডগকে প্রথম যে দুটো শব্দ শিখতে হয়, তা হলো এই জি আর হউ।
ভীষণ ঠাণ্ডা! মুসা বলল।
হ্যাঁ।
তাপমাত্রা এখন শূন্যের বিশ ডিগ্রি নীচে।
নদীর ওপর দিয়ে কোণাকুণি ছুটছে স্লেজ। বহু ব্যবহৃত পথটা দেখে বোঝা যায় মাত্র একটা স্লেজ চালিয়ে এই রাস্তা তৈরি করা সম্ভব নয়। শহরের অন্য মাশাররাও নিশ্চয় এই পথ ব্যবহার করে। লাকড়ি আনতে নদী পেরিয়ে বনে যায়। ইউকন নদীটা শীতকালে হয়ে যায় গ্লিটারবাসীর মহাসড়ক।
কে আসে দেখো! জোসি বলল।
একসঙ্গে ফিরে তাকাল কিশোর-মুসা দুজনেই।
ওদিকে নয়, বাঁয়ে তাকাও, জোসি বলল।
গলা লম্বা করে বাঁয়ে তাকাল কিশোর। নদীর তীর ধরে আরেকটা কুকুর-বাহিনীকে এগিয়ে আসতে দেখল। জোসিকে জিজ্ঞেস করল, কে, টেড নাকি? তোমার সঙ্গে রেস খেলতে আসছে?
নাহ্, প্র্যাকটিস করছে।
দৌড়াচ্ছে তো খুব জোরে, বিড়বিড় করল মুসা। পালাচ্ছে নাকি?
পালাবে কেন? টেডের দিকে তাকিয়ে আছে জোসি। গাড়িতে মালপত্র নেই, বোঝা নেই, সে-কারণেই গতি বেশি। এভাবে প্র্যাকটিস করাটা ভুল। তাতে আসল রেসের সময় যখন বোঝা নিয়ে দৌড়াবে কুকুরগুলো, অনভ্যস্ততার কারণে অসুবিধে হবে ওদের। যা ইচ্ছে করুকগে, আমার কী।
টেডকে ভাল করে দেখার জন্য অনেকখানি ঘাড় ঘোরাল কিশোর।
আচমকা চেঁচিয়ে উঠল, জোসি, এত ধােয়া কেন শহরে?
কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকাল জোসি। চমকে গেল সে-ও। হুয়া! হুয়া! বলে উত্তেজিত চিৎকার করে থামতে বলল কুকুরগুলোকে। এত জোরে ব্লেড-ব্রেক চেপে ধরল, তুষারে বসে গেল ব্রেকের ব্লেড। নৌকার মত দুলে উঠল স্লেজ। প্রচণ্ড ঝাঁকি লাগল।
দাঁড়িয়ে গেল ডায়মণ্ডহার্ট সহ বাকি কুকুরগুলো।
কিছু একটা হয়েছে, চিন্তিত ভঙ্গিতে ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে আছে জোসি। শহরের একধারে কালো ধোয়ার মোটা একটা রেখা আকাশে উঠে যাচ্ছে।
কীসের ধোঁয়া? জানতে চাইল মুসা।
চাচার কেবিনে আগুন লেগেছে! জোসি বলল।
৩
স্লেজ থেকে নেমে পড়ল জোসি। চেঁচিয়ে বলল, নামমা! নামো! গাড়ি ঘোরাতে হবে!
লাফিয়ে নামল কিশোর-মুসা। দৌড় দিল জোসির পিছনে। রুক্ষ বরফ। লাগাম পরা অবস্থায়ই কুকুরগুলোকে টেনে নিয়ে এল ওরা। গ্লিটারের দিকে মুখ করাল। স্নেজের মুখও ঘুরিয়ে দিল একই দিকে।
লাফ দিয়ে আবার স্নেজে গিয়ে উঠল কিশোর-মুসা। লাগাম ধরে চিৎকার করে উঠল জোসি, ডায়মণ্ডহার্ট! হাইক! হাইক!
সামনে ঝাঁপ দিল কুকুরটা। বরফে নখ বসাল। ওর পেশীবহুল শক্তিশালী বুকে চেপে বসল চামড়ার লাগাম। দেখাদেখি বাকি কুকুরগুলোও একই কাজ করল। ছুটতে শুরু করল স্লেজ।
নদীর ভাটির দিকে চলেছে এখন ওরা। জেফরি টিনুকের কেবিনের ওপর কুণ্ডলী পাকিয়ে উড়ছে কালো ধোঁয়া।
ফুল স্পিডে কুকুরগুলোকে ছুটিয়ে নিয়ে চলল জোসি। চিৎকার করে ক্রমাগত নির্দেশ দিতে থাকল, টান, ডায়মণ্ড, টান! টেনে যা!
লাগামের সঙ্গে গা মিলিয়ে দেহটাকে টান টান করে ফেলেছে ডায়মণ্ডহার্ট। জরুরি অবস্থা আঁচ করে ফেলেছে কুকুরগুলো।
জোসি, কী হয়েছে বলো তো? এতক্ষণে জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেল কিশোর।