সেটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। ঘুরে ঘুরে প্রতিটি কুকুরের মাথা চাপড়ে আদর করে দিতে লাগল জোসি। তবে মোটামুটি এগারো-বারোদিনের মত লাগে। ভীষণ বিপজ্জনক আর উত্তেজনায় ভরা এই রেস।
কুকুরগুলোর ওপর নিশ্চয় খুব চাপ পড়ে? মুসার প্রশ্ন।
তা পড়ে। তবে সেটা ওরা পছন্দও করে। শূন্যের বিশ ডিগ্রি নীচে নেমে যায় তাপমাত্রা। শরীর গরম হতে চায় না। মাশিঙের জন্য অস্থির হয়ে ওঠে ওরা।
মাশিং কী? কুকুরের খাবার?
হাসল জোসি। উঁহু। ডগস্লেজিঙের স্থানীয় নাম মাশিং। ফরাসি শব্দ মার্শা থেকে এসেছে শব্দটা। এর মানে চলো যাই।
কিশোর জিজ্ঞেস করল, রেসের সময় বাইরের সহযোগিতা পাওয়া যায়?
মাথা নাড়ল জোসি। না। ইডিটারোড রেসে যা যা করার রেসারকে একলাই করতে হয়। নিজের খাবার, কুকুরের খাবার, কাপড়-চোপড়, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যেতে হয়। টিকে থাকার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, সব সঙ্গে নিতে হয়।
মুসা বলল, তারমানে নিয়ম-নীতি খুব কঠোর।
কঠোর না হয়ে উপায় নেই, জোসি বলল। ইডিটারোড রেসটা শুধু খেলা বা প্রতিযোগিতা নয়, রেসার তৈরিতেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। সেই উনিশশো পঁচিশ সাল থেকে এ নিয়ম চালু আছে। নৌমে সেবার মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল ডিপথেরিয়া। সারা শহরে কোথাও এর ওষুধ ছিল না। গাড়ি আসার রাস্তা ছিল না। প্লেন নামতে পারত না। কিন্তু আলাস্কার কিছু বেপরোয়া ডগস্লেজ মাশার প্রচণ্ড তুষার ঝড়ের তোয়াক্কা না করে অ্যাঙ্কারেজ থেকে নৌমে ওষুধ পৌঁছে দিয়েছিল। বাঁচিয়ে দিয়েছিল শহরটাকে। সেই থেকে ইডিটারোড রেসের গুরুত্ব ভীষণভাবে বেড়ে গেছে এই এলাকার লোকের কাছে। নিউ ইয়র্ক সিটির সেন্ট্রাল পার্কের বিখ্যাত কুকুরের মূর্তিটার কথা নিশ্চয় জানো, বাল্টোর মূর্তি। নৌমের সেই উদ্ধারঅভিযানে একটা দলের লিড ডগ ছিল বাল্টো। ওষুধ আনার পর থেকে হিরো হয়ে গেছে। ডায়মণ্ডহার্টের মাথা চাপড়ে দিতে আবার নিচু হলো ও। আমাদের ডায়মণ্ডও বাল্টোর চেয়ে কম নয়, কি বলিস ডায়মণ্ড? এবারের ইডিটাররাডে আমরাই জিতব। পঞ্চাশ হাজার ডলারের পুরস্কার বাড়িতে আনব।
শিস দিল মুসা। ওর মুখ থেকে বেরোনো বাতাসে তুষারকণার লম্বা একটা রেখা তৈরি হলো। পঞ্চাশ হাজার!
বেশি মনে হচ্ছে? হাসতে লাগল জোসি। তবে এতে যে পরিমাণ বিপদ, সেই তুলনায় টাকাটা খুব বেশি না। পদে পদে মৃত্যুর আশঙ্কা। কুকুর ছাড়া একশো গজও যেতে পারবে না।
হাঁটতে হাঁটতে শহরে ফিরে এল ওরা। ওদের বয়েসি আরেকটা ছেলেকে উল্টো দিক থেকে আসতে দেখা গেল। জোসির মত ওর পরনেও চামড়ার পার্কা আর উলের প্যান্ট। মাথার হুড তুলে দেয়া। অন্য দিকে নজর। ওদের যেন দেখেইনি।
ও টেড সিউল, জোসি বলল। গলা চড়িয়ে ডাকল, এই টেড, শোনো। এরা আমার বন্ধু। মেহমান। লস অ্যাঞ্জেলেসের রকি বিচ থেকে এসেছে।
থামল টেড। তবে জোসির দিকে তাকাল না।
টেডও রেসে অংশ নিচ্ছে, জানাল জোসি। ইডিটারোড রেসে এই প্রথমবারের মত প্রতিযোগিতা করতে যাচ্ছি আমরা। গোটা শহর আমাদের নিয়ে উত্তেজিত। অনেকেই বলাবলি করছে প্রতিযোগিতা আমার আর টেডের মধ্যেই হবে। দুজনের যে কোন একজন জিতব।
জ্বলন্ত চোখে জোসির দিকে তাকাল টেড। আমি না জিততে পারলে তোমাকেও জিততে দেয়া হবে না, কথাটা মনে রেখো। তার জন্য যদি আমাকে…
কথাটা শেষ করল না ও। ঝট করে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে গেল।
২
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে থেকে জোসিকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, ও অমন করল কেন?
জানি না, বিষন্ন মনে হলো জোসিকে। সেই ছোটবেলা থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। কিছুদিন থেকে কী যে হয়েছে ওর, একেবারেই সহ্য করতে পারে না আমাকে। ডগ রেসে বার বার আমার কাছে পরাজয়টা মেনে নিতে পারছে না বোধহয়।
প্রতিযোগিতায় হারজিত তো আছেই, মুসা বলল। তার জন্য এত শত্রুতা? নিশ্চয় তুমি ওর চেয়ে ভাল মাশার, নইলে জেতো কেন?
মাশার! বাহ, চমৎকার উচ্চারণ, হাসি ফুটল জোসির মুখে। শেখো, শেখো, শিখে ফেললা আমাদের ভাষা। কঠিন কিছু না।
মুসার মনে হলো ওর প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল জোসি।
যে রাস্তা ধরে চলেছে ওরা, সেটা গেছে একটা ভোলা চতুরের ধার দিয়ে। পঞ্চান্ন গ্যালনের অনেকগুলো বড় বড় ড্রাম রাখা আছে চত্বরে। পাশে একটা ছোট্ট ছাউনি। ছাউনির ভিতর থেকে আসছে ইঞ্জিনের শব্দ।
কীসের শব্দ জানতে চাইল মুসা।
জেনারেটর, জোসি বলল। ডিজেলে চলে। ওই ড্রামগুলোতে ডিজেল ভর্তি। গরমকালে ইউকনে যখন বরফ থাকে না, তখন বার্জে করে নিয়ে আসা হয়। হিসেব করে বিদ্যুৎ খরচ করতে হয় আমাদের। বসন্তে বরফ গলা শুরু হওয়ার আগে তেল ফুরিয়ে গেলে বিপদ। জেনারেটর চলবে না। বিদ্যুৎ বন্ধ। অন্ধকারে থাকতে হবে রাতের বেলা।
চিন্তিত অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হেঁটে চলেছে কিশোর। শহরটা বড় বেশি নিঃসঙ্গ। অস্বস্তি লাগছে ওর। এখানে সব কিছু ঠিকঠাক মত চললে কোন ভয় নেই। কিন্তু যে কোন অঘটন কিংবা অনিয়ম ঘটলে, তা সে যত সামান্যই হোক না কেন, শহরটাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে।
টেড সিউলের কথা ভাবল কিশোর। রহসময় আচরণ করেছে। জোসিকে জিজ্ঞেস করল, জোসি, টেড যে তোমাকে শাসিয়ে গেল, কতটা ক্ষতি করতে পারে?
আগে আগে হাঁটছে জোসি। ফিরে তাকিয়ে জবাব দিল, বাদ দাও ওর কথা। কামড়ের চেয়ে ঘেউ ঘেউ বেশি।