একটু থেমে দম নিয়ে আবার লল কিশোর, বিগ, শুনুন, আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। আপনার প্যাডের কাগজে লুককে একটা চিঠি লিখুন। তাকে বলুন, তাঁর কাজ আপনার পছন্দ হয়েছে। আপনি এবং আপনার কোম্পানি সেটা প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখছেন। তাকে নানারকম সুযোগ দিতে চান। এ নিয়ে আলোচনার জন্য তাঁর সঙ্গে মিটিঙে বসতে চান।
মাথা নেড়ে বিগস বলল, উঁহু, আমি তা করতে পারব না। ওই চিঠি অন্য কারও হাতে পড়লে ভীষণ বিপদে পড়ব। আমার চিঠি প্রমাণ করে দেবে, আমিও লুকের সহযোগী। না, আমি পারব না।
বিপদে পড়বেন কেন? মুসা বলল। চিঠির কোথাও তো দুর্ঘটনার কথা লেখা থাকছে না। শুধু লিখবেন ওর কাজ আপনার পছন্দ হয়েছে। কাজ তো কত রকমেরই হতে পারে।
আর কেউ না বুঝলেও লুক ঠিকই বুঝবে কোন কাজের কথা আপনি বলেছেন, কিশোর বলল।
মস্ত ঝুঁকি নেয়া হয়ে যাবে, দ্বিধা যাচ্ছে না বিগসের।
দেখুন, আজ হোক কাল হোক লুককে আমরা ধরবই, দৃঢ় কণ্ঠে বলল কিশোর। ওকে ধরতে সাহায্য করে গ্লিটারবাসীর কাছে ভাল হওয়ার এই সুযোগটা আপনি ছাড়বেন কেন? বলা যায় না, কাজটা করলে আপনার পক্ষে ভোটও বেড়ে যেতে পারে।
ভ্রূকুটি করল বিগস্। কথাটা মন্দ বলনি। বেশ, আমি তোমাদের সাহায্য করব। তবে এই চিঠি লেখার ব্যাপারটা আমার একটুও ভাল লাগছে না। লুক কী করবে, কিছু জানি না। আমাদের ফাঁদে যদি সে পা না দেয়?
ভোটে জেতার জন্য কিছুটা ঝুঁকি তো নিতেই হবে আপনাকে।
আর আপত্তি করল না বিগস্। প্যাড বের করে লিখতে তৈরি হলো। কোথায় দেখা করতে বলব?
বিগৃসের কেবিনটা ভাল করে দেখল কিশোর। ছোট ঘর। একটা অংশকে অফিস বানিয়েছে বিগস্। ছোট একটা রান্নাঘরও আছে এক কোণে। জানালাগুলো ছোট ছোট, ভারী কাঁচ লাগানো, যাতে ঠাণ্ডা ঢুকতে না পারে। ওপরে একটা চিলেকোঠা আছে। ওটা দেখিয়ে বিগকে জিজ্ঞেস করল, ওখানে জায়গা আছে?
থাকতে পারে, জবাব দিল বিগস্। দেখিনি।
ওপরে ওঠার সরু একটা মই আছে। বেয়ে ওপরে উঠে গেল কিশোর ও মুসা। পুরানো কিছু বাক্স আর পিপা রাখা। ওগুলো সরালে কিছুটা জায়গা বেরোবে।
ওখান থেকেই বিগসকে বলল কিশোর, ওকে জানিয়ে দিন, দেড় ঘণ্টার মধ্যে ওর সঙ্গে এখানে দেখা করতে চান আপনি। আশা করি, ততক্ষণে তৈরি হয়ে যেতে পারব আমরা।
ঘণ্টাখানেক পর। চিলেকোঠার সঙ্কীর্ণ জায়গায় ঠাসাঠাসি করে বসেছে কিশোর, মুসা, টেড, জোসি ও জেফরি। উত্তেজিত চারটে মুখের দিকে একে একে তাকাল কিশোর। সাক্ষী হওয়ার জন্য জেফরি, জোসি আর টেডকে ডেকে নিয়ে এসেছে। এখনও নিজেদের মধ্যে আচরণে সহজ হতে পারেনি জোসি ও টেড। তবে মনে মনে দুজনেই খুশি। পুরানো বন্ধুত্বটা জোড়া লাগতে যাচ্ছে আবার।
বিগস নীচে অপেক্ষা করছে। ওর কাশি শোনা গেল। কাগজপত্র ঘাটাঘাটির খসখস শব্দ। নিশ্চিন্ত হলো কিশোর। এত মৃদু শব্দও যখন কানে এসে পৌছাচ্ছে, লুক আর বিগসের সমস্ত কথাবার্তা চিলেকোঠা থেকে শোনা যাবে।
অবশ্য যদি আসে লুক!
চুপচাপ বসে অপেক্ষা করতে লাগল ওরা। বার বার ঘড়ি দেখছে কিশোর। বিগসের চিঠি লুকের মত ধড়িবাজ লোককে টেনে আনতে পারবে কি না নিশ্চিত হতে পারছে না। ঘুণাক্ষরেও যদি সন্দেহ করে বসেন ফাঁদ পাতা হয়েছে, তাহলে কেবিনের ত্রিসীমানা মাড়াবেন না। বরং বিগকে ফাঁসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবেন। সোজা চিঠিটা নিয়ে হাজির হবেন আদালতে।
গড়িয়ে কাটছে সময়। ভাবনার ঝড় বইছে কিশোরের মাথায়। লুক চিঠি পাওয়ার পর গোপনে এসে আড়াল থেকে চোখ রাখেননি তো কেবিনের ওপর? কিশোর-মুসা আর অন্যদেরকে দল বেঁধে বিগসের কেবিনে ঢুকতে দেখলেই বুঝে যাবেন, তাঁকে ফাঁদে ফেলার জন্য ওই চিঠি লেখা হয়েছে। তুষারে পাঁচ জোড়া জুতোর ছাপ পড়েছিল। সেগুলো মুছে ফেলা হয়েছে জেফরির নির্দেশে। সতর্ক লোক। সতর্ক না হলে এই বুনো অঞ্চলে টিকতে পারতেন না। তাড়াহুড়ো করে জুতোর ছাপগুলো মোছা হয়েছে। হয়তো কিছু চিহ্ন রয়েই গেছে। চোখে পড়ে যাবে না তো লুকের?
একই কথা মুসাও ভাবছে। ভাবতে ভাবতে মাথা গরম হয়ে যাবার জোগাড়। সময় কাটাতে বিড়বিড় করে কবিতা আবৃত্তি শুরু করল। কাঁধে হাত পড়তে চমকে গেল ও। ঠোটে আঙুল রেখে ওকে শব্দ না করতে ইশারা করছে টেড।
অপেক্ষা করছে ওরা। লুক আর আসেন না। সবাই যখন ভাবতে আরম্ভ করেছে, লুক আসবেন না, অত সাধারণ একটা চিঠির ফাঁদে ধরা দেবেন না তাঁর মত চতুর লোক, ঠিক তখনই দরজায় শোনা গেল টোকার শব্দ। মুহূর্তে বরফের মত জমে গেল যেন চিলেকোঠার সবাই।
নীচে কাঠের মেঝেতে জুতোর শব্দ।
দরজার দিকে এগোচ্ছে বিগস্।
দরজা খোলার শব্দ হলো।
এসেছেন। আন্তরিক কণ্ঠে বিগ ডাকল, আসুন। রাইফেল এনেছেন কেন? শিকারে বেরোবেন নাকি?
সঙ্গীদের দিকে তাকাল মুসা। গম্ভীর হয়ে আছে সবাই। লুক রাইফেল নিয়ে আসবেন ভাবেনি।
গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলেন লুক, ঝুঁকি নিতে চাইনি।
বিগস বলল, আমার কোম্পানির জন্য ক্ষতির কারণ হয় এমন কোন ঝুঁকি আমিও নিতে চাই না। তবে মনে হচ্ছে একসঙ্গে কাজ আমরা করতে পারব। দাঁড়িয়ে কেন, বসুন না।
বিগস ও লুকের কথাবার্তা টেপ করার জন্য পকেট থেকে একটা মাইক্রো ক্যাসেট রেকর্ডার বের করল কিশোর। অন সুইচ টিপল। খুব সামান্য শব্দ হলো। অতি মৃদু। কিন্তু লুকের কান এড়াল না।