অবশেষে বহু কসরত করে ওকে আগের জায়গায় নিয়ে এল মুসা। বরফের ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল দুজনে। ভয়ানক পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছে।
গেছিলাম আজ! হাঁপাচ্ছে কিশোর।
হ্যাঁ, মুসাও হাঁপাচ্ছে। লুক মেঝেতে কী ফেলেছেন?
জানি না। তোমার কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো?
না। উঠে দাঁড়াল মুসা। চলো, কাছে গিয়ে দেখি।
সাবধানে ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল দুজনে।
চলে গেছেন লুক। কেবিনে ঢুকল ওরা। মেঝেতে একটা হাতুড়ি পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিল কিশোর। হাতলে খোদাই করা দুটো ইংরেজি অক্ষর: টি এফ।
টি এফ, আনমনে বলল ও। টেক্স ফেরানির নামের আদ্যাক্ষর।
নিজে জুতো চুরি করে ঘরে গোল্ডের হাতুড়িটা ফেলে গেছেন লুক, যাতে দোষটা গোল্ডের ঘাড়ে গিয়ে পড়ে, কিশোর বলল। কেবিনটা কার জানতে পারলে ভাল হতো।
নিশ্চয় এমন কেউ, যে থিম পার্কের বিপক্ষে।
হ্যাঁ!
তারমানে লুকই অপরাধী! বিশ্বাস হতে চাইছে না মুসার। এখন বুঝলাম, ফিশহুইলের কাছে কেন গিয়েছিলেন তিনি। আমরা সময়মত চলে গিয়েছিলাম বলে রক্ষে, নইলে ওটাও যেত। নষ্ট করে দিতেন। সর্বনাশ হয়ে যেত জো বেচারার। এখন বোেঝা গেল, নৌকার তলাও লুকই ফুটো করেছেন। রাত দুপুরে নিজের বাড়িতে ইলেকট্রিক করাত চালিয়ে রেখে গিয়েছিলেন, যাতে ওই শব্দে গজালের ওপর হাতুড়ি পিটানোর শব্দ চাপা পড়ে যায়। কেবিনে থেকে মহিলা তাই শুধু করাতের শব্দই শুনেছিল।
কিন্তু তাঁকে ধরার মত কোনও প্রমাণ নেই আমাদের কাছে, নীচের ঠোট কামড়াল কিশোর। জুতো চুরি করতে দেখলেও হাতেনাতে ধরতে না পারলে তার মত প্রভাবশালী টাকাওয়ালা একজন মানুষকে জেলে পাঠানো কঠিন। শুধু আমাদের মুখের কথায় হবে না।
কী করা যায় বলো তো?
চিবুকে টোকা দিল কিশোর। একটা বুদ্ধি আসতে আরম্ভ করেছে মাথায়। দেখি, আরেকটু ভাবি।
অ্যাসেম্বলি হলে ফিরে এল ওরা। পটল্যাচ শেষ। লোকজন চলে যেতে শুরু করেছে। ইলকিস বিগ আছে এখনও। ওকে একপাশে ডেকে নিয়ে এল কিশোর। নিচুস্বরে বলল, আপনার সঙ্গে কথা আছে। এখানে বলা যাবে না।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা ঝাঁকাল বিগস। ঠিক আছে, আমার কেবিনে চলো।
কেবিনে ঢুকে কিশোর বলল, আপনি জানেন, গ্লিটারে গত কয়েক দিন ঘরে যে সব দুর্ঘটনা ঘটছে, তার জন্য আপনাকে আর আপনার কোম্পানিকে দায়ী করছে লোকে?
অন্যায় করছে, বিগ বলল। আমি কিছু করিনি। আমার কোম্পানি কিছুই জানে না।
আপনার কোম্পানির কোন দুর্নাম নেই, খবর নিয়েছি আমরা। তবে টাকার টানাটানিতে আছে। যা-ই হোক, আমরা আপনাকে দোষী ভাবছি না। গ্লিটারবাসীর কাছে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার একটা সুযোগ আপনাকে দিতে পারি। তাতে আপনার লাভই হবে। অপরাধীকে ধরতে আমাদের সাহায্য করুন।
কিন্তু তোমরা তো ছেলেমানুষ…
বয়েস কম বলতে পারেন। তাতে কী? আরও অনেক কম বয়েস থেকেই গোয়েন্দার কাজ করছি আমরা, শখের গোয়েন্দা। অনেক জটিল কেসের সমাধান করেছি। পুলিশকে অপরাধী ধরতে সাহায্য করেছি। বিশ্বাস না হলে জোসিকে জিজ্ঞেস করুন। সে সব জানে।
জোসি ভাল ছেলে, চিন্তিত ভঙ্গিতে ঠোট কামড়াল বিস্। পরিবারটাও খুব ভাল, যদিও আমাদের থিম পার্কের বিপক্ষে। তবে বিরোধিতা করলেই মানুষ খারাপ হয় না। যাই হোক, আমিও এ সব দুর্ঘটনা বন্ধ করতে চাই। বদনাম হয়ে গেলে আমার ক্যারিয়ার শেষ।
মুসার দিকে তাকাল কিশোর। স্বস্তি বোধ করছে। অপরাধীকে ধরতে বিগস্ সাহায্য করতে রাজি না হলে ওকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারত না। লুক আর বিগস যুক্তি করে দুর্ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে, এই ভাবনাটা জোরাল হতো।
চলুন এখন, অপরাধীকে ধরতে যাই, মুসা বলল।
হাঁ হয়ে গেল বিগস্। কে অপরাধী, জানো নাকি?
মাথা ঝাঁকাল মুসা। লুক স্টার্লিং।
কী বলছ? চেঁচিয়ে উঠল বিগস্।
বিশ্বাস করলেন না তো?
না, করেছি। ওর যা টাকার লোভ, ওকে দিয়ে সব সম্ভব এখানকার হস্তশিল্পের বাজারটাকে ও কোণঠাসা করে ফেলেছে। মানুষকে বাকিতে জিনিস দেয়, কেউ কিছু চাইলে কখনও না করে না, যে যা চায় দিয়ে দেয়। ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে। তারপর সুযোগ বুঝে চাপে ফেলে ঋণ শোধ করার নামে খুব কম দামে ওদের ঠকিয়ে দামি দামি জিনিসগুলো আদায় করে নেয়। এভাবে প্রচুর জিনিস জমিয়েছে। সেগুলো যে কোন মিউজিয়ামের কাছে চড়া দামে বেচতে পারবে।
কিন্তু বিক্রি করবেন না, কিশোর বলল। তার উদ্দেশ্য এখন আমার কাছে পরিষ্কার। মানুষকে হ্যাঁ ভোটে বাধ্য করার জন্য রাজ্যের শয়তানি করে বেড়াচ্ছেন তিনি। জো সারটনের মত দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষগুলোর সহায়-সম্বল ধ্বংস করে দিয়ে ওদের অসহায় করে ফেলতে চাইছেন, যাতে টাকার অভাবে থিম পার্কের পক্ষে ভোট দিতে বাধ্য হয় ওরা। গ্লিটারে থিম পার্ক হলে সবচেয়ে বেশি লাভ তার। টুরিস্টদের কাছে জিনিস বিক্রি করবেন। যত ইচ্ছে দাম নেবেন। গ্লিটারে আর কোন দোকান নেই, ভবিষ্যতেও বসতে দেবেন না–একচেটিয়া ব্যবসা করবেন। স্থানীয়দের কাছ থেকে ঠকিয়ে নেয়া অ্যান্টিক দেখিয়ে টুরিস্টদের আকৃষ্ট করবেন। ওসব জিনিসের নকল তৈরি করে সুভনিয়ার হিসেবে চড়া দামে বিক্রি করবেন। হস্তশিল্পের ব্যবসাটাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলবেন এখানে, তবে শুধুই নিজের জন্য। কী সাংঘাতিক প্ল্যান!