জোসিকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে জ্যাকের কথা জিজ্ঞেস করল কিশোর।
শহরেই ছিল না ও, জোসি বলল। মিঙ্ক রিভারের ওপারের জঙ্গলে ফাদ পেতে জানোয়ার ধরতে চলে গিয়েছিল। গ্লিটার থেকে বহুদূরে। ওই জায়গা নিয়ে চাচার সঙ্গে ঝগড়া নেই ওর। আজ এসেছে পটল্যাচে যোগ দিতে। পটল্যাচ না থাকলে আসত না।
মুসা বলল, তারমানে জ্যাকও সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ। কমতে কমতে তো শেষ! কাকে সন্দেহ করব এরপর?
সে-কথাই তো ভাবছি, চিন্তিত ভঙ্গিতে জবাব দিল কিশোর। সন্দেহভাজনই যদি কেউ না থাকে, সন্দেহ করব কাকে?
সেদিন বিকেলে শহরবাসীদের সঙ্গে অ্যাসেম্বলি হলে গিয়ে পটল্যাচে অংশ নিল দুই গোয়েন্দা। স্থানীয় ভাষায় গান গাইছে কয়েকজন অ্যাথাবাস্কান। একঘেয়ে ভঙ্গিতে হাত ওঠাচ্ছে আর নামাচ্ছে। কিছু লোক গানের তালে তালে নেচে চলেছে।
এক সময় শেষ হলো নাচ। শহরের সবচেয়ে প্রবীণ মানুষটি শহরবাসীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিলেন। দিনটার বিশেষত্ব নিয়ে আলোচনা করলেন। তারপর নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা দুজন অ্যাথাবাস্কান মহিলা এগিয়ে এল। একজনের হাতে একটা বড় কড়াই, আরেকজনের হাতে ছোট ছোট অনেকগুলো বাটি ও একটা হাতা। ঘরের প্রতিটি মানুষের কাছে যেতে লাগল ওরা। বাটিতে করে ধূমায়িত ঘন ঝোল খেতে দিল।
কী খাচ্ছে? নিচুস্বরে জোসিকে জিজ্ঞেস করল মুসা।
মুচকি হাসল জোসি। সুপ। সবাইকেই খেতে হবে। এটাই নিয়ম।
কীসের সুপ? ভালুকের মাংস?
আরে নাহ্। দুর্ভিক্ষ না লাগলে ভালুক কে খায়, জোসির হাসিটা চওড়া হলো। মুজের মাথা।
আস্ত মাথা হাঁড়িতে ফেলে সিদ্ধ করেছে?
হ্যাঁ, করেছে। চোখ, কান, দাঁত কিছুই ফেলেনি।
চামড়া?
সিদ্ধ হওয়ার পরে ফেলেছে।
এই সুপ খেতে হবে ভেবে নিজের অজান্তেই মুখটা বিকৃত হয়ে গেল কিশোরের। এমন জানলে অনুষ্ঠানেই আসত না।
ওর মুখের অবস্থা দেখে হাসল জোসি। অত মুখ বাঁকাচ্ছ কেন? খেতে খারাপ লাগে না।
প্রথমে মুসার কাছে এসে দাঁড়াল দুই মহিলা। বাটিতে করে ঝোল খেতে দিল। ঢোক গিলল ও। ঠোটে লাগিয়ে চুমুক দিল। ওর দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল কিশোর। নীরবে জানতে চাইল, কেমন।
ভাল বলতে পারব না, তবে যতটা খারাপ ভেবেছিলাম ততটা লাগল না, মুসা জবাব দিল। আর অতিরিক্ত লবণ।
বাটি হাতে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কিশোর। কোন ফাঁকে ফেলে দেবে সেই সুযোগ খুঁজছে। পারল না।
কোনমতে ঘন তরল পদার্থটা গিলে নিয়ে বাটিটা ফিরিয়ে দিল মুসা। ঘরের চারপাশে তাকাল। সবাই সুপ খেতে ব্যস্ত। চোখ আটকে গেল দরজার দিকে। কিশোর, ফিসফিস করে বলল ও, লুককে বেরিয়ে যেতে দেখলাম। চোখে চোরা চাহনি। দেখব নাকি কোথায় যান?
চলো।
জোসির দিকে তাকাল কিশোর। জোসি, আমরা বাইরে যাচ্ছি। কাজ আছে। বলে জোসি কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজের হাতের বাটিটা ওর হাতে ধরিয়ে দিল।
খেলে না? সুপটা কি এতই খারাপ? নাকি বাথরুমে যাচ্ছ? হেসে জিজ্ঞেস করল জোসি।
কিশোর হাসল, না, বাথরুমে যাচ্ছি না। পরে বলব। মুসার হাত ধরে টান দিল। এসো।
লুককে অনুসরণ করে শহরের পশ্চিম প্রান্তে চলে এল দুজনে। তাকে একটা কেবিনে ঢুকতে দেখল।
কেবিনটায় কেউ আছে বলে মনে হলো না। নিশ্চয় পটল্যাচ অনুষ্ঠানে চলে গেছে। চারপাশে তাকাল কিশোর। একটা উঁচু টিলা চোখে পড়ল। ওখানে উঠে বসলে কেবিনের ভিতরটা দেখতে পারব। চলো।
টিলাটাকে ছোটখাট একটা পাহাড় বলা চলে। প্রচুর গাছপালা জন্মে আছে। ওগুলোর ভিতর দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল দুজনে। চূড়ায় উঠে আবার কেবিনটা চোখে পড়ল। লুককে দেখা যাচ্ছে জানালা দিয়ে।
কী করছেন লুক? বিড়বিড় করল কিশোর।
চোখের পাতা সরু করে তাকাল মুসা। কেবিনের পিছনের ঘরে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন লুক। চারপাশে তাকাচ্ছেন। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে টান দিয়ে হুক থেকে দুটো স্লে–পেড়ে বা বগলের নীচে চেপে ধরলেন। পার্কা থেকে কী যেন বের করে ছুঁড়ে দিলেন মেঝেতে।
জুতো চুরি করছেন! বলল অবাক কিশোর। কী কাণ্ড!
মেঝেতে কী ফেললেন? মুসার প্রশ্ন।
ভালমত দেখার জন্য আরেকটু এগোতে গেল কিশোর। উত্তেজনায় খেয়ালই রইল না, খাড়া দেয়ালের কিনারে রয়েছে ও। হাত ফসকাল। ডিগবাজি খেয়ে উল্টে পড়ে গেল।
১৪
কিশোরের চিৎকারে ফিরে তাকাল মুসা। বরফে ঢাকা ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে দেখল কিশোরকে। থাবা দিয়ে ধরে ফেলল ওর বাঁ পায়ের গোড়ালি। কিশোরের ওজন ওকেও নীচে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। বুটের ডগা তুষারে গেঁথে ফেলে নিজের পতন ঠেকানোর চেষ্টা করল। পারল না। পড়ে যেতে শুরু করল সে-ও কিশোরের সঙ্গে।
তিরিশ ফুট নীচের পাথরে পড়লে কী ঘটবে আর ভাবতে চাইল না। মরিয়া হয়ে পা দিয়ে কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে চাইছে। পা ঠেকল একটা সিডারের চারায়। ছোট্ট ওই গাছটাকেই পা দিয়ে পেঁচিয়ে ধরল। ভারের চোটে বাঁকা হয়ে গেল গাছ। তবু শিকড় উপড়াল না।
ঝুলে থাকো, মুসা বলল। একটুও নড়বে না। আমি তোমাকে টেনে তুলছি।
ডান হাতে কিশোরের গোড়ালি ধরে আছে ও। গাছের চারায় পা আটকে নিয়ে বাঁ হাতটাও বাড়িয়ে দিল। দুই হাতে এখন কিশোরের গোড়ালি ধরল। এক হাতের ওপর চাপ কিছুটা কমল। পেটের পেশীকে ব্যবহার করে ইঞ্চি ইঞ্চি করে পিছাতে শুরু করল ও। সঙ্গে কিশোরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ডান পা উঁচু করল কিশোর এক হাতে বা পাটা ধরে রেখে অন্য হাতে কিশোরের ডান পাটাও ধরল মুসা। ধীরে ধীরে টেনে তুলে আনতে লাগল কিশোরকে। বরফে ঢাকা দেয়ালের কিনারে আঙুল বাধানোর অবিরাম চেষ্টা চালাচ্ছে কিশোর। সুবিধে করতে পারছে না।