শহরের লোকের প্রতিক্রিয়া কী? কিশোর জিজ্ঞেস করল। তারা কী বলে?
এ সব ক্ষেত্রে সাধারণত যা হয়, মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ থিম পার্কের পক্ষে, কেউ বিপক্ষে।
সামনে মূল রাস্তাকে ক্রস করে গেছে আরেকটা রাস্তা। সেটা ধরে দ্রুত এগিয়ে আসছে একজন মানুষ। বড় বড় চুল প্রায় জট পাকিয়ে গেছে। গায়ে সবুজ পার্কা। পরনে উলের ঘন বুনটের ভারী প্যান্ট। দোমড়ানো। ময়লা। নিচুস্বরে জোসিকে জিজ্ঞেস করল মুসা, কে লোকটা?
টেক্স ফেরানি। লোকে ডাকত গোল্ড ফেরানি। ডাকতে ডাকতে এখন গোল্ড হয়ে গেছে ওর ডাকনাম, জোসি বলল। শহরের বাইরে ছোট্ট একটা গোল্ড ক্লেইম আছে ওর। গোল্ড ক্লেইম বোঝো?
মাথা ঝাঁকাল মুসা। সোনা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন জায়গার বৈধ মালিক।
হ্যাঁ। গোল্ড এক বিচিত্র চরিত্র।
সোনা মানে তো বিরাট ব্যাপার, মুসা বলল। কিন্তু এ লোকটাকে দেখে খাবার পায় বলেই মনে হয় না।
আসলেই তা-ই, টাকা নেই ওর। পঞ্চাশ বছর কাটিয়েছে সোনা খুঁজে খুঁজে। এখনও কিছুই করে উঠতে পারল না বেচারা। তবে আশা ছাড়েনি, সোনা খোজায় ওর বিরাম নেই।
জোসির সঙ্গে শহরের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলল কিশোর-মুসা। শহরের অন্যপাশে এসে একটা কেবিন দেখিয়ে জোসি বলল, ওইটা আমার চাচার কেবিন।
তোমার চাচার ছেলেমেয়ে নেই? মুসা জানতে চাইল।
আছে। এক মেয়ে। নাম মুনস্টোন। তোমাদের এগিয়ে আনার জন্য আমার সঙ্গে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু লাকড়ি কেটে আনাটাও জরুরি। সেজন্য বনে গেছে। অসুবিধে নেই, পরেও দেখা করতে পারবে। আর ওই যে কেবিনটা দেখছ, এটা তোমাদের।
চাচার কেবিন থেকে দশ-বারো গজ দূরে আরেকটা ছোট কেবিনে কিশোরদেরকে নিয়ে এল জোসি। দুটো বাংক। একগাদা কম্বল। এ ছাড়া একটা টেবিল, একটা চেয়ার, আর পেটমোটা এক পুরানো চুলা আছে। মাটিতে বিছানো ভালুকের চামড়ায় তৈরি একটা মাদুর। চুলার পাশে একটা কাঠের খোলা বা লাকড়িতে বোঝাই।
এখানে থাকতে তোমাদের কষ্ট হবে না তো? জোসি জিজ্ঞেস করল। তোমাদের বাড়ির মত আরাম পাবে না আগেই বলে দিচ্ছি।
আমার তো খারাপ লাগছে না, হাতের ব্যাগটা একটা বাংকে নামিয়ে রাখল কিশোর। বরং মনে হচ্ছে আরামেই থাকতে পারব। শোনো, আমাদের নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। বহু খারাপ জায়গায় থেকে অভ্যাস আছে আমাদের।
ঠিক, মুসা বলল। ওসব জায়গার তুলনায় কেবিনটা তো পাঁচতারা হোটেল।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল জোসি। বন্ধুদের থাকার জায়গা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল ও, বোঝা গেল। জিজ্ঞেস করল, আমার জেটানা কুকুরগুলো দেখবে?
নিশ্চয়ই, জবাব দিতে এক মুহূর্ত দেরি করল না মুসা।
কেবিন থেকে বেরিয়ে শহরের সীমানা ধরে এগিয়ে চলল ওরা। এক জায়গায় কতগুলো কেনল চোখে পড়ল। কুকুরের ঘরগুলোর কাছে প্রায় দুই ডজন কুকুর বাধা। ওদের দেখে জোর গলায় চচামেচি শুরু করল ওগুলো। প্রচুর লাফালাফি আর লেজ নেড়ে স্বাগত জানাল।
সবগুলো তোমার কুকুর? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।
হ্যাঁ। এখানে আছে একুশটা। তবে ইডিটারোড রেসে বারোটার বেশি ব্যবহার করব না। হাতে আরও সময় নিয়ে আসা উচিত ছিল তোমাদের। তাহলে রেসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখে যেতে পারতে।
থাকতে পারলে খুশিই হতাম, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। কিন্তু কী করব, স্কুল খুলে যাবে।
স্কুল কামাই দিয়ে হলেও থাকতে রাজি আছি আমি, মুসা বলল। রেসের শেষ দেখতে না পারলে মনে খুঁতখুঁতি থেকে যাবে।
নাহ্, রেসের জন্য স্কুল কামাই দেয়া ঠিক হবে না, কিশোর বলল।
বেশির ভাগ দর্শকই রেসের শুরুটা কেবল দেখে, জোসি বলল। অনেক লম্বা পথ। অ্যাঙ্কারেজ থেকে নৌম পর্যন্ত এগারোশো মাইল। এতখানি তো আর সঙ্গে সঙ্গে যাওয়া সম্ভব না।
হাঁ করে তাকিয়ে রইল মুসা। এগারোশো মাইল!
একটা কুকুরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল জোসি। ওদের প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ করছে কুকুরটা। ওর নাম ডায়মণ্ডহার্ট।
হীরকহৃদয়, বিড়বিড় করল কিশোর।
কী বললে?
ডায়মণ্ডহার্টের বাংলা করলাম।
আচ্ছা, হাসল জোসি। বাংলা নামটাও শুনতে ভাল লাগছে। সুন্দর একটা ছন্দ আছে। কিন্তু এখন আর বাংলা নামে ডাকলে সাড়া দেবে না ওটা, নইলে রেখেই দিতাম।
বড় একটা হাস্কি কুকুরের পাশে বসে ওটার গলা জড়িয়ে ধরল জোসি। কুকুরটার গায়ের রঙ সাদা আর ধূসরে মিশানো। চোখ টলটলে নীল। আদর পেয়ে জোরে জোরে লেজ নাড়তে লাগল। কিশোর ও মুসার দিকে তাকাল জোসি। ও আমার লিড ডগ।
মানে নেতা কুকুর? মুসা বলল।
মাথা ঝাঁকাল জোসি। হ্যাঁ।
মনিবের গাল চেটে দিতে লাগল ডায়মণ্ডহার্ট। হেসে মুখ সরিয়ে নিল জোসি।
দলের সবচেয়ে মূল্যবান সদস্য লিড ডগ, জোসি বলল। হোয়াইট আউটের মধ্যে পড়লে ওকে ছাড়া নিস্তার পাওয়া কঠিন।
হোয়াইট আউট কী? মুসা জানতে চাইল।
তুষার ঝড়, জোসি বলল। যখন তখন শুরু হয়ে যায়। এতই ঘন হয়ে তুষার পড়ে, নিজের হাতও দেখা যায় না। ভয়ঙ্কর ব্যাপার। তবে ডায়মণ্ডহার্টের মত একটা হাস্কি সঙ্গে থাকলে নিরাপদ। পথের মোড়ে কোনখানে কী বিপদ ওত পেতে আছে, নদীর বরফের স্তর কোথায় অতিরিক্ত পাতলা, ভার সইতে না পেরে ভেঙে যাবে, আগে থেকেই সব বুঝতে পারে। ওকে ছাড়া ইডিটারোড রেসে অংশ নেয়ার কথা ভাবতেই পারি না আমি।
রেস শেষ হতে কতদিন লাগে? জানতে চাইল কিশোর।