ও ছাড়া আর কে? আমার ওপর আর কার এমন আক্রোশ থাকবে?
ও তোমার বন্ধু, টেড।
ছিল। এখন নেই।
কণ্ঠস্বরে যতটা সম্ভব আন্তরিকতা ফুটিয়ে তুলে কিশোর বলল, টেড, জোসি এ সব করছে না। কারণ, কেউ একজন জোসিরও ক্ষতি করতে চাইছে। তোমাদের পুরো শহরটাকেই ধ্বংস করে দিতে চাইছে ওই লোক। জোসি, ওর চাচা-চাচী, চাচাত বোন, সবাই চাইছে রহস্যটার সমাধান করি আমরা। যে এ সব করে বেড়াচ্ছে, ওকে খুঁজে বের করি।
আমরা গুণ্ডাপাণ্ডা নই, টেড, যা তুমি ভাবছ, মুসা বলল। আমরা গোয়েন্দা।
জ্বলে উঠল টেডের চোখ। তাহলে বলো, লোকটা কে? দেখো ওর কী করি!
এখনও জানি না আমরা, জবাব দিল কিশোর। এতদিন তো তোমাকেই সন্দেহ করে এসেছি।
আমি কিছু করিনি। নিজের শহর ধ্বংস করে দেব, এত বোকা আমাকে ভাবলে কী করে?
জোসিও চায় না শহরটা ধ্বংস হয়ে যাক।
চুপ হয়ে গেল টেড। নীরবে দেখতে লাগল কিশোর ও মুসাকে। সন্দেহ যাচ্ছে না ওর। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল। চলে গেল ওর জেটার কাছে, যেখানে অসীম ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছে কুকুরগুলো।
কিশোর-মুসাও. হাঁটতে শুরু করল আবার। উল্টো দিকে। টিনুকদের কেবিনের কাছে এসে থামল। দরজায় টোকা দিল কিশোর। খুলে দিলেন এরিনা। হাতে একটা ডোরাকাটা স্কার্ফ। তোমরা। আমি মনে করেছি গোল্ড। স্কার্ফটা ফেলে গেছে তো, ভাবলাম ফেরত নিতে এসেছে বুঝি। দাঁড়িয়ে কেন, এসো।
ঘরে ঢুকে পার্কা খুলতে খুলতে মুসা জিজ্ঞেস করল, গোল্ড কখন এসেছিল?
মিনিট পনেরো আগে। এইমাত্র গেল। কেন?
স্টোভের কাছে চেয়ারে বসে আছেন জেফরি। থিম পার্কের পক্ষে ভোট দেয়ার জন্য আমাকে বোঝাতে এসেছিল গোল্ড। হাসলেন তিনি। টুর গাইডের চাকরির অফারও দিয়ে গেছে আমাকে।
দরজা খুলে গেল আবার। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল গোল্ড। বাতাসের ঝাপটা লাগল। ওর বুটে লেগে থাকা তুষার গলে গলে
পড়ছে।
গোল্ড বলল, গলার কাছে ঠাণ্ডা লাগতে মনে পড়ল স্কার্ফটা ফেলে গেছি। আরেকটু হলে গলাটাই বরফ হয়ে যাচ্ছিল।
এরিনার হাত থেকে স্কার্ফটা নিয়ে গলায় পেঁচাল গোল্ড। বেরোনোর জন্য ঘুরে দাঁড়াল।
কিশোর জিজ্ঞেস করল, গোল্ড, জো সারটনের ফিশহুইলটার কাছে গিয়েছিলেন কেন?
ঝটকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল গোল্ড। কে বলেছে?
লুক। একটু আগে নাকি ওটার কাছে দেখেছেন আপনাকে।
জেফরিকে সাক্ষী মানল গোল্ড। শুনলে! শুনলে মিথুকটার কথা! আমি নাকি নদীর ধারে জো সারটনের ফিশহুইলের কাছে গেছি! কিশোরের দিকে ফিরল ও। কখন দেখেছে বলল?
আধঘণ্টা আগে, মুসা বলল।
লাল হয়ে গেছে গোল্ডের মুখ। আধঘণ্টা আগে যদি নদীর ধারে গিয়ে থাকি, তা হলে এখানে ছিল কে? আমার ভূত?
অবাক মনে হলো জেফরিকে। গোল্ড এখানেই ছিল, আমাদের সাথে। লুক নিশ্চয় ভুল করেছে।
শীতকালে এ ধরনের ভুল হতেই পারে, এরিনা বললেন। কাপড়-চোপড় দিয়ে গা ঢেকে শরীরটাকে পুটলি বানিয়ে রাখে সবাই। দূর থেকে চেনা কঠিন।
তাই হবে! বিড়বিড় করল কিশোর। তারমানে লুক ভুল করেছেন।
সারটনের ফিশহুইলটারও কিছু হয়েছে নাকি? শঙ্কিত মনে হলো গোল্ডকে।
তা তো জানি না। জো গিয়ে ওটা দেখলে বুঝতে পারবে।
ফিশহুইলটাও যদি নষ্ট হয়ে থাকে, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল গোল্ড, কার কাজ, আর সন্দেহ থাকবে না আমার। সোজা গিয়ে ওই চামারটার ঘাড় চেপে ধরব, সব বেরিয়ে যাবে।
কার কথা বলছেন?
কার আবার? ওই অর্থপিশাচ লুক স্টার্লিংটার। টাকার জন্য পারে না ও, এমন কাজ নেই।
গটমট করে বেরিয়ে গেল গোেল্ড। পিছনে দড়াম করে লাগিয়ে দিয়ে গেল দরজার পাল্লা।
প্রথমে কিশোরের দিকে তাকালেন জেফরি। তারপর মুসার দিকে। বললেন, গোল্ডের আচরণে মনে হয় না জানি কী ভয়ঙ্কর লোক। কিন্তু আমি জানি, ওর ওই বদমেজাজ আর রুক্ষতার আড়ালের মনটা খুব নরম। আর মোটেও অসৎ নয়। মাঝে মাঝে ওর কথাবার্তায় আমারও রাগ লাগে। তবে ওকে আমি অবিশ্বাস করি না।
দরজা খুলে গেল আবারও। লাকড়ির বোঝা নিয়ে ঘরে ঢুকল মুন কিশোর-মুসাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, ডিনামাইটের খোঁজ নিয়েছিলে?
অবাক মনে হলো জেফরি ও এরিনাকে। বিগৃসের চিঠির কথা জানানো হলো ওঁদের।
কিশোর বলল, বিগসকে জিজ্ঞেস করেছি। ডিনামাইট কোম্পানির চিঠির কথা স্বীকার করেছে ও।
ডিনামাইট দিয়ে ও কী করবে? কপাল ডলতে লাগলেন জেফরি। কী যে সব কাণ্ড শুরু হলো গ্লিটারে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কাকে সন্দেহ করব, তা-ও বুঝতে পারছি না। কিশোর, কিছু একটা করো তোমরা জলদি! শহরটাকে বাঁচাও!
পরদিন সকাল সকাল কেবিন থেকে বেরোল কিশোর ও মুসা। শহরের প্রান্তে একটা পাহাড়ের গোড়ায় জেফরি ও এরিনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাত নাড়ল কিশোর। জেফরিও হাত নাড়লেন।
এগিয়ে গেল দুজনে। পাহাড়ের গোড়ার এক টুকরো খোলা জায়গা লোহার রেলিঙ দিয়ে ঘেরা। তুষার ভেদ করে মাথা তুলে রেখেছে। অসংখ্য কবরফলক। শহরের গোরস্থান এটা, বুঝতে পারল ওরা।
কেউ মারা গেল নাকি?
জিজ্ঞেস করে জানা গেল, মারা যায়নি, তবে আজ পটল্যাচের দিন। পটল্যাচ হলো আলাস্কার আদিবাসীদের একটা বিশেষ উৎসব। সকালে কবরস্থানে ফুল দিতে আসে মৃতের আত্মীয়রা। বিকাল থেকে শুরু হয় উৎসব-অনুষ্ঠান।
ব্ৰিণ্ডল জ্যাককে দেখা গেল ওখানে। জেফরিকে দেখেই বেরিয়ে গেল গোরস্থান থেকে। কিশোরের মনে পড়ল, সন্দেহভাজনদের সে-ও একজন। অথচ বেমালুম ভুলে গিয়েছিল ওর কথা, আশ্চর্য!