চলো, জিজ্ঞেস করি।
দোকানে ঢুকে ওরা দেখল দোকানের মেঝে ঝাড় দিচ্ছেন লুক।
পেলে কিছু? মুখ তুললেন না তিনি, নিজের কাজে মনোযোগ। দেখলাম, পোড়া ছাইয়ের গাদায় কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছ।
এই যে, এটা পেলাম, পোড়া, বাতিল ঘড়িটা দেখাল কিশোর।
ও, ওটা। দশ বছর আগে ফেলে দিয়েছিলাম।
হতাশ হলো মুসা। কিছুদিনের মধ্যে কেউ কিনেছে এ রকম ঘড়ি?
কিনলে তো বেঁচেই যেতাম, তাকের দিকে আঙুল তুললেন লুক। ওই দেখো, কত ঘড়ি পড়ে আছে। বড় শহর হলে কবে বেচে ফেলতাম। ওসব জায়গায় সময়ের খুব দাম। আর এখানে লোকের অফুরন্ত সময়। অ্যালার্ম ক্লক কারও কাজে লাগে না।
দোকান থেকে বেরোতেই বিগসূকে দেখতে পেল ওরা। হনহন করে হেঁটে চলে যাচ্ছে শহরের বাইরে। বার বার ফিরে তাকাচ্ছে। কেউ পিছু নিল কি না দেখছে বোধহয়।
কোথায় যায়? মুসার প্রশ্ন।
চলো, দেখে আসি।
বিগস্ এখনও ওদের দেখেনি। বেশ অনেকটা দূর থেকে ওকে অনুসরণ করে চলল দুজনে। মিনিট পাঁচেক পর মুসা বলল, এ রাস্তা দিয়ে একমাত্র গোল্ডের বাড়িতেই যাওয়া যায়।
ওখানে যাচ্ছে কেন? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল কিশোর। গোল্ডের কাছে তো আর থিম পার্কের উপকারিতা বয়ানের দরকার নেই। গোল্ড এমনিতেই ওর পক্ষে।
সেটাই তো ভাবছি।
গোল্ডের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল বিগস্। টোকা দেবার আগেই খুলে গেল দরজা।
তারমানে বিগস্ আসবে গোল্ড জানে, ফিসফিস করে বলল মুসা। আরেকটু কাছে যেতে পারলে ভাল হতো। কী বলে শুনতে পারতাম।
পা টিপে টিপে এগোল দুজনে। কেবিনের পাশ ঘুরে এসে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে কান পাতল। বিগসকে বলতে শুনল, আগুন লাগানো, বোমাবাজি, এ সব কিন্তু মোটেও পছন্দ হচ্ছে না আমার!
এ সব আমাকে বলছ কেন? রেগে গেল গোল্ড।
কোম্পানির বদনাম হয়ে যাচ্ছে, বিগস বলল। এই শয়তানি বন্ধ করা দরকার।
গোল্ডও চেঁচিয়ে উঠল, আমাকে ধমকানোের তুমি কে? আমার যা খুশি আমি করব। আগুন লাগাতে ইচ্ছে করলে লাগাব, বোমা মারতে ভাল লাগলে মারব। তোমার গা জ্বালা করলে ইউকন নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ঠাণ্ডা করোগে।
মুসার দিকে তাকাল কিশোর। এক ভুরু উঁচু করল। গোল্ডের কথায় মনে হচ্ছে অপরাধগুলো সে-ই করেছে।
তুমি ভাবছ এ সব করে কোম্পানির মস্ত উপকার করছ? বিগসের ঝাঁঝাল কণ্ঠ। এমনিতেই পরিস্থিতি ভীষণ নাজুক। শহরের লোকের মানসিকতা এই ভাল তো এই মন্দ। কোন সিদ্ধান্তই নিতে পারছে না। এখন এ সব দুর্ঘটনা ঘটতে থাকলে পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেবে বুঝতে পারছ না? আমি এ সব বন্ধ করাব। বুঝলে, করিয়ে ছাড়ব?
আমার বাড়িতে এসে আমাকেই ধমক! গর্জে উঠল গোল্ড।
বিগও কম যায় না। আমি তোমাকে এ সব করতে বলিনি। পাগলামি করে কোটি ডলারের প্রোজেক্ট ধ্বংস করবে, আর আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকব যদি ভাবো, ভুল করছ।
হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল কিশোর। ওদের পিছনের ঝোপে কী যেন নড়ছে। বড় কোন জানোয়ার হতে পারে। ফিরে তাকাল ও। ভয়ের শীতল শিহরণ বয়ে গেল মেরুদণ্ডে।
ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল বিশাল এক বাদামি ভালুক। কিশোরদের দেখে যেন হোঁচট খেয়ে থেমে গেল। পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে মানুষের মত সোজা হয়ে দাঁড়াল। হাঁ করা মুখের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে টকটকে লাল জিভ আর হলুদ রঙের মারাত্মক দাঁত।
ওর দিকে তাকিয়ে রাগে গোঁ-গোঁ করল জানোয়ারটা।
দিশেহারা হয়ে পড়ল কিশোর। কী করবে, বুঝতে পারছে না।
১২
ভিতরের কথা ভালমত শোনার জন্য জানালায় কান পেতে দাঁড়িয়েছিল মুসা। ভালুকের গোঁ-গোঁ শুনে চমকে গেল। কেবিন থেকে শোনা গেল বিগ্সের কথা, কীসের শব্দ!
ভালুক, গোল্ডের জবাব। দাঁড়াও, আসছি।
আঙুলের ইশারায় মুসাকে একটা পাথরের চাঙড় দেখাল কিশোর।
মাথা ঝাঁকাল মুসা। মুহূর্ত পরেই কেবিনের দরজা খুলে গেল। শব্দ শুনে দরজার দিকে মুখ ফেরাল ভালুকটা। এই সুযোগে এক দৌড়ে গিয়ে পাথরের আড়ালে লুকাল কিশোর ও মুসা। ভালুক আর গোল্ডকে দেখতে পাচ্ছে এখান থেকেও।
এই ব্যাটা, বন্দুক চিনিস? হাতের রাইফেল দেখিয়ে হুমকি দিল গোল্ড। জলদি ভাগ। নইলে দুনিয়া থেকে ভাগাব।
গর্জে উঠল ভালুক। নড়ল না।
রাইফেল নেড়ে আবার চেঁচিয়ে উঠল গোল্ড, ভাগ! ভাগ! জলদি ভাগ! হোল্কা হাঁদা কোথাকার। কথা কানে যাচ্ছে না? ভাগ বলছি।
আবার গর্জে উঠল ভালুক। তবে গলার জোর কমে গেছে।
ও, ভাল কথায় যেতে ইচ্ছে করে না! রাইফেলের নল আকাশের দিকে তুলে গুলি করল গোল্ড।
আর সাহস ধরে রাখতে পারল না ভালুকটা। ঝোপঝাড় ভেঙে ছুটে পালাল। বনে যাওয়ার আগে থামল না আর।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। ভয় পাচ্ছিল, তাড়া খেয়ে ভালুকটা ওদের দিকে ছুটে আসে।
গুলি করলে না কেন? গোল্ডের পিছন থেকে কথা বলল বিগ।
অকারণে মেরে লাভ কী? পরক্ষণে হেসে উঠল গোল্ড। ও, ভালুকের মাংস খেতে চেয়েছিলে? আগে বললে না কেন…
আমি যাচ্ছি, বিগৃস্ বলল। যা বললাম, মনে রেখো।
আমি যা বললাম, তুমিও মনে রেখো, গোল্ডও পাল্টা জবাব দিল।
দরজা লাগানোর শব্দ হলো। বিগসের পায়ের শব্দ ক্রমশ দূরে চলে গেল। আর বসে থেকে লাভ নেই। উঠে দাঁড়াল কিশোর। চলো, যাই।
শহরে ফেরার পথে মুসা বলল, গোল্ডকে কিন্তু বিগসের লোক মনে হলো না।
কী জানি! আমি ঠিক বুঝতে পারছি না!
আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে পুরো ব্যাপারটাই একটা নাটক, মুসা বলল। আমাদেরকে দ্বিধায় ফেলার জন্য করেছে। নিশ্চয় আমাদেরকে পিছু নিতে দেখেছিল বিগস্। কেবিনে ঢুকে ইশারায় কোনভাবে গোল্ডকে বুঝিয়ে দিয়েছে আমরা পিছু নিয়েছি। তারপর দুজনে ঝগড়ার নাটক করেছে।