ফ্যাকাসে মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল লুক স্টার্লিংকে। কাছে গিয়ে দাঁড়াল মুসা। বলল, ভাগ্যিস দোকানে লাগেনি।
ওই ঘরে কী আছে? পিছন থেকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
জঞ্জাল আর আজেবাজে বাতিল জিনিস, লুক জবাব দিলেন। পুড়ে গেলেই ভাল।
আপনার দোকান থেকে দূরেই আছে ওগুলো, কিশোর বলল। ওখান থেকে আগুন ছড়াবে না।
কিন্তু লাগল কীভাবে? মুসার প্রশ্ন। বিস্ফোরণের শব্দ শুনে তো মনে হলো বোমা ফেটেছে।
এমন অনেক জিনিস আছে ফাটলে বোমার মত শব্দ হয়, লুক বললেন। গোটা দুই পাঁচ গ্যালনের জেরিক্যান ছিল ভিতরে। যদি সামান্য পেট্রলও থেকে থাকে ওগুলোর কোনটাতে, আর গরম করা হয়, ভিতরে যে বাষ্প তৈরি হবে, তাতে বোমা ফাটার মতই শব্দ হবে।
তারমানে আপনি বলতে চাইছেন প্রথমে আগুন লেগেছে, জেরিক্যানগুলোকে গরম করেছে, তারপর বিস্ফোরণ? কিশোরের প্রশ্ন।
কী করে বলি? দেখার জন্য আমি তো আর এখানে ছিলাম না। সবার সঙ্গে মিটিঙে ছিলাম। তোমরা জিজ্ঞেস করলে, তাই কীভাবে আগুন লাগতে পারে ধারণা দিলাম মাত্র। অস্থির হয়ে উঠেছেন লুক। কিশোরদের কাছ থেকে সরে গেলেন।
আগুন নিভানোর পর নিজেদের কেবিনে ফিরে এল গোয়েন্দারা। আলোচনায় বসল।
এই প্রথম একটা দুর্ঘটনা ঘটল, মুসা বলল, যা জোসির রেসকে কোনভাবে প্রভাবিত করবে না। থিম পার্কের বিরোধিতা যারা করছে, তাদেরকে ভয় দেখানোর জন্যও ঘটানো হয়ে থাকতে পারে এটা।
কিন্তু লুক তো থিম পার্কের বিপক্ষে নন, কিশোর বলল। তাহলে তাঁর ঘর পোড়ানো হলো কেন?
সেটাই তো বুঝতে পারছি না। ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে রহস্য!
কিশোর বলল, তবে, আগের রহস্যগুলোর সঙ্গে এই ছাউনি পোড়ানোর সম্পর্ক আছে। সন্দেহভাজনদের সংখ্যা এখন কমিয়ে আনা সম্ভব। মিটিঙের সময় আমাদের জানামতে কে কে টাউন হলের বাইরে
ছিল?
টেডকে দেখিনি ওখানে, মুসা বলল।
জোসিও ছিল না।
তারমানে তুমি জোসিকেও সন্দেহ করো?
এখনও করছি না, কিশোর বলল। টাউন হলের বাইরে কে কে ছিল সেটা মনে করার চেষ্টা করছি আপাতত। লুকের কথাই ঠিক মনে হচ্ছে। আগুনটা আগে লেগেছে, তারপর বিস্ফোরণ। আর যদি বোমা ফাটিয়ে আগুন লাগানো হয়, ফাটানো হয়েছে টাইমার দিয়ে। তখন আবার সন্দেহভাজনদের সংখ্যা বেড়ে যাবে। যে কেউ ঘটাতে পারে এ রকম দুর্ঘটনা, মিটিঙে সে-লোক থাকুক বা না থাকুক।
দমে গেল মুসা। কিশোরের কথায় প্রথমে মনে হয়েছিল, রহস্য সমাধানের দোরগোড়ায় পৌছে গেছে। এখন মনে হচ্ছে, এ রহস্য ভেদ করা এত সহজ নয়।
দরজায় টোকা শুনে উঠে গিয়ে খুলে দিল ও। জোসি দাঁড়িয়ে আছে।
ঘরে ঢুকল জোসি। পার্কাটা খুলে নিতে নিতে বলল, রেড লাইটকে পাওয়া গেছে।
ভাল আছে ও? চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
আছে। কিন্তু ভীষণ দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে আমাকে। ওকে কেনলে রাখতে গিয়ে ছেঁড়া দড়িটা দেখলাম। কেউ কেটে রেখেছিল।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আমরাও দেখেছি। তোমাকে বলার সুযোগ পাইনি।
টেড যে এতদূর যাবে তা কল্পনাও করতে পারিনি, ছোট্ট ঘরটার মধ্যে পায়চারি শুরু করল জোসি। কী করতে চাইছে ও? যুদ্ধ? ও কি বুঝতে পারছে না ও যতটা ক্ষতি করছে আমার, আমিও ততটাই করতে পারি? এ ভাবে দুজনে ঝগড়া আর একে অন্যের ক্ষতি করতে থাকলে লাভ কিছু হবে না, বরং ক্ষতি, রেসে আর অংশ নিতে পারব না।
টেডকে দেখেছ নাকি? মুসা জিজ্ঞেস করল। ওর সঙ্গে কথা আছে আমাদের।
মাথা নাড়ল জোসি। দেখিনি। হয়তো কুকুরগুলোকে প্র্যাকটিস করাতে নিয়ে গেছে। এখন তো ওর একমাত্র কাজই হলো প্র্যাকটিস। আমিও অবশ্য তা-ই করতাম। কিন্তু দুর্ঘটনাগুলো বাধা দিচ্ছে আমাকে। ভয় লাগছে, প্র্যাকটিস করাতে না পারলে চর্বি জমে যাবে কুকুরগুলোর গায়ে। তাতে ক্ষিপ্রতা হারাবে ওরা। আমাকে আটকে ফেলে এটাই করাতে চাইছে কি না টেড, কে জানে!
পরদিন খুব সকালে লুকের ছাউনিটা দেখতে চলল কিশোর ও মুসা। বাতাসে ছাই আর পোড়া কাঠের ঝাঁঝাল গন্ধ৷ প্রচণ্ড তাপে গলে বিকৃত, কালো হয়ে গেছে বড় বড় ক্যান। বিছানার একটা গদি পুড়েছে, প্রিংগুলোই শুধু অবশিষ্ট আছে, কাপড়, রবার সব পুড়ে ছাই। পুরানো একটা সোমোবাইল, আগেই হয়তো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, এখন পোড়া দেহটা পড়ে আছে।
কী খুঁজছ? কিশোরকে ছাতের একটা কড়িকাঠ সরাতে দেখে জিজ্ঞেস করল মুসা।
অস্বাভাবিক কিছু, জবাব দিল কিশোর।
হাসল মুসা। এখানে স্বাভাবিক কোটা? সবই তো অস্বাভাবিক।
মিনিট বিশেক খোঁজার পর হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর, মুসা, দেখো!
পুরানো মডেলের একটা অ্যালার্ম ঘড়ি দেখাল ও চাবি ঘুরিয়ে দম দেয়া হতো।
সোমোবাইলটার মতই আরেকটা জঞ্জাল, আগ্রহ দেখাল না মুসা।
তা ঠিক। কিন্তু আসল জিনিসটাই চোখে পড়েনি তোমার। বারো নম্বর লেখাটার ঠিক মাঝখানে একটা পিন ফুঁড়ে বেরিয়ে আছে। ঘণ্টার কাঁটা আর মিনিটের কাঁটা দুটোকেই এক জায়গায় আটকে দিয়েছে।
আরে তাই তো! এতক্ষণে উৎসাহ দেখা গেল মুসার। ব্যাটারিতে দুটো তার লাগিয়ে তারের এক মাথা মিনিটের কাটায়, আরেক মাথা ঘণ্টার কাঁটায় লাগিয়ে দিলে, বোমার টাইমার বানিয়ে ফেলা যায়।
এ ধরনের ঘড়ি কোথায় দেখেছি আমি, তা-ও মনে পড়ছে, কিশোর বলল। লুক স্টার্লিঙের দোকানের তাকে। পোড়া ঘড়িটা দেখিয়ে বলল, এটা কার কাছে বিক্রি করেছিলেন, মনে করতে পারবেন নিশ্চয়।