অর্ধেকের মত শ্রোতা জোর করতালি দিয়ে স্বাগত জানাল গোল্ডের বক্তব্যকে। যারা দিল না, তাদেরও অনেককেই এই বক্তৃতা শোনার পর দ্বিধান্বিত মনে হচ্ছে। থিম পার্কের পক্ষে ভোট দেবে কি না সেটা ভাবছে বোধহয়।
জেফরি উঠে দাঁড়ালেন। গোল্ড ঠিকই বলেছে।
অবিশ্বাসের গুঞ্জন উঠল শ্রোতাদের মাঝে। পার্কের পক্ষ নিয়েছেন ঘোর বিরোধী জেফরি! অবাক হলো কিশোর।
ঠিক বলেছে গোল্ড, আবার বললেন জেফরি, অন্তত একটা ব্যাপারে। আমাদের আয় কমে গেছে। আর কমলে না খেয়ে থাকতে হবে। আমরা সেটা জানি। আয়ের নতুন পথ খোঁজা উচিত আমাদের, তা-ও জানি। কিন্তু আমার মতে থিম পার্কই এর সমাধান নয়।
পাশে বসা মুনকে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে শুনল কিশোর। স্বস্তির।
শত শত বছর ধরে, জেফরি বলে চলেছেন, এখানকার মাটি আর প্রকৃতির সঙ্গে মিলে-মিশে বাস করেছেন আমাদের পূর্বপুরুষরা, আমরাও করছি। শীতের আগে আমরা বনে গিয়ে মুজ শিকার করি, গরমে স্যামন ধরি নদীতে। দীর্ঘ শীতের মাসগুলোতে আমরা কুকুরের ট্রেনিং দেই। আমাদের হস্তশিল্পের কদর দুনিয়াজোড়া। আমাদের ইতিহাস, আমাদের ঐতিহ্য, সব আমরা নষ্ট করব টাকার লোভে টুরিস্ট ডেকে আনলে। আমাদের স্বকীয়তা বলতে আর কিছু থাকবে না তখন। আমাদের শহর আমাদের থাকবে না। হাজার হাজার মাইল দূরের অফিসে বসে এ শহরটাকে নিয়ন্ত্রণ করবে এমন কিছু মানুষ, গ্লিটারবাসীর কাছে যারা পুরোপুরি অচেনা। আমরা কি ওদের ডেকে এনে নিজের সর্বনাশ করতে চাই? ভালমত ভেবে দেখা দরকার।
বসে পড়লেন জেফরি। আবার অর্ধেকের মত শ্রোতা জোর করতালি দিয়ে তাঁকে সমর্থন করল।
বিগস উঠে দাঁড়িয়ে বলল, জেফরি, আপনার বক্তব্যকে আমি যথেষ্ট সম্মান করি। আপনার উদ্বেগের কারণও আমি বুঝি। কিন্তু একটা কথা কি আপনি জানেন, থিম পার্ক কোম্পানি আপনাদের প্রতি আকৃষ্টই হয়েছে আপনারা আপনাদের ঐতিহ্য বজায় রাখতে পেরেছেন বলেই? আপনার কি মনে হয় সে-সব ধ্বংস করে দিতে চাইব আমরা? তাতে নিজের পায়ে নিজেরা কুড়াল মারব। পুরানো সব কিছু ধ্বংস করে দিলে টুরিস্টদের কী দেখাতে আনব? আমি আপনাকে পরিষ্কারভাবে বলে দিতে চাই…
কথা শেষ হলো না ওর। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠল অ্যাসেম্বলি হল।
১১
তুমুল শোরগোল। অ্যাসেম্বলি হলের অনেকেই সিট থেকে মেঝেতে ঝাঁপ দিয়েছে। বহু প্রশ্ন আর চিৎকার-চেঁচামেচির স্রোত বয়ে গেল জনাকীর্ণ ঘরটায়। কে যেন একজন চেঁচিয়ে উঠল, এই চলো চলো, বেরোও! মরবে নাকি এখানে থেকে! দরকার নেই আমাদের থিম পার্কের!
হুড়াহুড়ি করে দরজার দিকে ছুটল বহু লোক। বাইরে থেকে চিৎকার শোনা গেল, আগুন! আগুন!
এই থামুন থামুন! শান্ত হোন! সব হট্টগোলকে ছাপিয়ে শোনা গেল মিস্টার সিউলের কণ্ঠ। অহেতুক ঠেলাঠেলি করবেন না। ঘরের মধ্যে কোন বিপদ নেই। বাইরে থেকে এসেছে বিস্ফোরণের শব্দ।
আতঙ্কিত জনতার কাছ থেকে মুনকে টেনে সরাল কিশোর ও মুসা। তারপর দুজনে হাতে হাত ধরে ওকে মাঝখানে রেখে একটা ব্যারিকেড তৈরি করল উন্মত্ত জনতার ধাক্কাধাক্কি থেকে বাঁচানোর জন্য। শহরের গণ্যমান্য কয়েকজন নানাভাবে বুঝিয়ে জনতাকে থামানোর চেষ্টা করছে। দরজার কাছ থেকে ওদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে চেয়ারে বসাতে চাইছে। দ্রুত কমে এল আতঙ্ক।
জেফরির চিঙ্কার শোনা গেল, দরজার কাছ থেকে সরে আসুন। বাতাস ঢোকা বন্ধ করে দিচ্ছেন তো।
ঘুরে তাকাল মুসা। একটা চেয়ারের ওপর দাঁড়ানো দেখতে পেল জেফরিকে। দুই হাত মুখের কাছে জড় করে চিৎকার করে আবার বললেন তিনি, যারা আগুন নেভাতে পারে তাদের বেরোতে দিন আগে। সরুন। সরে যান দরজার কাছ থেকে।
কেমন বোকা বোকা লাগছে মানুষগুলোকে। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। ধীরে ধীরে সরে যেতে শুরু করল দরজার কাছ থেকে। ডজনখানেক লোক, যাদেরকে জেফরির কেবিনের আগুন নিভাতে দেখেছিল মুসা, এক দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। তাদের পিছু পিছু আরও অনেকেই বেরোনো শুরু করল।
চলো, আমরাও যাই, কিশোরকে বলল মুসা।
জনতার লম্বা সারিতে একটা ফাঁক দেখে তার মধ্যে নিজেদের ঢুকিয়ে নিল ওরা। মনে হলো সারিটা আটকে গেছে। আগেও যায় না, পিছেও যায় না। তারপর আচমকা স্রোতের ধাক্কায় কুটোর মত বেরিয়ে চলে এল সরু দরজাটা দিয়ে। ঠাণ্ডা বাতাসে দম নিতে লাগল হাঁ করে।
এমনিতে বাইরের বাতাস তাজাই থাকে, তবে এখন পুরোপুরি তাজা বলা যাবে না। ধূসর ধােয়ার চাদর ছড়িয়ে পড়েছে। কোনখানে ওই ধোয়ার উৎপত্তি, বুঝতে সময় লাগল না।
হায় হায়, আমার দোকান! চিৎকার করে উঠলেন লুক স্টার্লিং। আমার দোকানে আগুন লেগেছে।
দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে দৌড়ানো শুরু করলেন তিনি। তাঁর ঠিক পিছনেই রইল কিশোর ও মুসা। অর্ধেক পথ এসে কিশোর বলল, দোকান না, দোকান না, আগুন লেগেছে পিছনের কোন কিছুতে।
মুসাও দেখল। আগুন আর ধোঁয়া উঠছে দোকানের পিছনে বেশ খানিকটা দূরের একটা কাঠের ছাউনি থেকে। অবাক হলো। এটাই সেই ছাউনি, যেটা থেকে একজন লোককে বেরোতে দেখে তাড়া করেছিল ওরা।
কাজে লেগে গেছে অগ্নিনির্বাপক বাহিনী। বালতি বালতি পানি ছুঁড়ে দিচ্ছে ভাঙা জানালা দিয়ে ভিতরে। কিশোররা ওদের কাছে পৌঁছতেই ধুড়স করে বিকট শব্দে ছাত ধসে পড়ল। ফাঁকা পেয়ে লাফ দিয়ে গাছের মাথার কাছে উঠে গেল আগুন।