পাতলা হয়ে এল বন। পায়ে চলা একটা পথের ওপর এসে পড়ল দুজনে। শহরের দিকে মুখ করে দৌড়াতে থাকল। দূরে একটা টিলার মাথায় উঠে আসতে দেখল জোসি আর ওর কুকুরের দলকে। থেমে গেল কিশোর। ওর প্রায় ঘাড়ের ওপর এসে পড়ল মুসা। তবে ধাক্কাটা লাগল না। ধপ করে পথের ওপরই বসে পড়ল দুজনে। হাঁপাতে লাগল বিপজ্জনকভাবে।
কাছে এসে স্লেজ থামাল জোসি। গাড়ি থেকে নেমে এল। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
ভারী দম নিল কিশোর। ঢোক গিলে বলল, নেকড়ে।
আমাদের ঘিরে ফেলা শুরু করেছিল, মুসা জানাল। রেড লাইট আমাদের বাঁচিয়েছে।
অসীম সাহসে নেকড়েগুলোর মুখখামুখি হলো কুকুরটা, কিশোর বলল। ধমকানো শুরু করল। সুযোগ পেয়ে দৌড় দিলাম। ভুল করেছি। ওকে এভাবে ফেলে আসাটা উচিত হয়নি।
না, ভুল করনি। এটাই চেয়েছিল ও, জোসি বলল। তোমাদের পালানোর সুযোগ করে দিয়েছে। তোমরা যাও। আমি রেড লাইটকে আনতে যাচ্ছি। নেকড়েগুলো যেই বুঝবে কুকুরটা ওদের দলে যোগ দিতে চায় না, ধরে মেরে ফেলবে।
একা যাবে? কিশোর বলল। আমরা আসি?
দরকার নেই, জোসি বলল। নেকড়ে আমাদের কিছু করতে পারবে না। দেখছ না, কত কুকুর নিয়ে যাচ্ছি। গম্ভীর হয়ে গেল ও। আমি ভয় পাচ্ছি রেড লাইটের কথা ভেবে। ওকে জ্যান্ত পেলে হয়! ওকে হারালে…
স্লেজে ধাক্কা দিল জোসি। কুকুরগুলোকে বলল, হাইক! হাইক!
ছুটতে শুরু করল কুকুরের দল। মুহূর্তে টিলার ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সেদিকে তাকিয়ে থেকে চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল, কিন্তু কুকুরটার দড়ি কাটল কে? অবাক লাগছে আমার!
শহরের দিকে রওনা হলো দুজনে।
দড়ি কাটার খবরটা কি জোসি জানে? মুসার প্রশ্ন।
মনে হয় না। তবে জানার পর কী খেপা যে খেপবে সেটা আন্দাজ করতে পারছি। এই কুকুরগুলোই ওর সব।
শহরের কেবিন আর কাঠের ছাউনিগুলো নজরে এল। খপ করে মুসার হাত চেপে ধরে কিশোর বলল, দেখলে?
কী? এদিক ওদিক তাকাল মুসা।
আস্তে কথা বলো! ওই ছাউনিটার দিকে তাকাও।
একটা ছাউনির দরজা ফাঁক হয়ে আছে। সেটা দিয়ে চুপি চুপি বেরিয়ে এল একটা ছায়ামূর্তি।
কী করছে ও? মাংস চুরি?
জানি না, তাকিয়ে আছে কিশোর। তবে ওর ভাবভঙ্গি সুবিধের মনে হচ্ছে না। শয়তানি মতলব আছে। চলো তো দেখি।
ওদের দেখে ফেলল লোকটা। ছুটতে শুরু করল। ছাউনির পাশ ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ঢাল বেয়ে যত দ্রুত সম্ভব ছাউনির কাছে নেমে এল কিশোর ও মুসা। কোথাও দেখল না লোকটাকে।
বুঝলাম না, চারপাশে তাকাতে তাকাতে বলল বিস্মিত মুসা, কোথায় উধাও হলো?
ফিরে তাকাল কিশোর। দেখল লোকটাকে। পাহাড়ের ওপরের বনে ঢুকে যাচ্ছে। ওই যে যাচ্ছে! বলেই দৌড় দিল ও। মুসা ছুটল ওর পিছনে।
পাঁচ মিনিট পর হাল ছেড়ে দিল ওরা। ওদের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে লোকটা। পিছু নিয়ে এখন ধরা অসম্ভব। তা-ও যদি নেকড়েগুলোর কাছ থেকে পালাতে গিয়ে শক্তি খরচ করে না ফেলত, এক কথা ছিল।
ধূর, গেল চলে! হাঁপাতে হাঁপাতে বলল মুসা। ছাউনিতে কী করছিল?
কিছু একটা কুমতলব তো নিশ্চয় ছিল, নইলে পালাল কেন? জবাব দিল কিশোর। ভালমত দেখেছ?
দেখেছি। সবুজ পার্কা। সামান্য এই সূত্র দিয়ে ওকে চিনতে পারব বলে তো মনে হচ্ছে না। কী করতে ঢুকেছিল, ছাউনিটাতে ঢুকে দেখা দরকার।
মাথা নাড়ল কিশোর। চুরি করে অন্যের ঘরে ঢোকাটা ঠিক হবে। তবে ছাউনিটা কার, সেটা জানা যেতে পারে। জেফরি আঙ্কেলকে জিজ্ঞেস করব।
কেবিনে ফিরে শুধু মুনকে পেল ওরা। মুন জানাল, বাবার শরীর ঠিক হয়ে গেছে। ঘরে বসে থাকতে ভাল লাগছিল না, মাকে নিয়ে তাই মিটিঙে গেছে। আমিও রওনা হচ্ছিলাম। যাবে নাকি?
কীসের মিটিং? জানতে চাইল মুসা।
ভোটের আগের শেষ মিটিং। শহরের সব লোক যাবে অ্যাসেম্বলি হলে, থিম পার্ক নিয়ে আলোচনার জন্য। জোসি কই? সে-ও তো যেতে চেয়েছিল।
রেড লাইট দড়ি ছিড়ে পালিয়েছে। ওকে খুঁজতে গেছে, কিশোর জানাল।
সর্বনাশ! কুকুরটাকে না পেলে মস্ত ক্ষতি হয়ে যাবে। রেড লাইট ওর দলের সবচেয়ে ভাল কুকুরগুলোর একটা। ইডিটারোড রেসেরও আর দেরি নেই। এ সময় রেড লাইটকে খোয়ালে খুব বেকায়দায় পড়ে যাবে।
পার্কা পরে বেরিয়ে এল মুন। অ্যাসেম্বলি হলে রওনা হলো তিনজনে। হাঁটতে হাঁটতে বন্ধুকে বলল মুসা, ওকে কি ওখানে পাওয়া যাবে?
কাকে? বুঝতে পারল না কিশোর।
যাকে আমরা তাড়া করেছিলাম।
কী জানি। যদি যায়ও ও, চিনতে পারব না। শহরের অনেকেই সবুজ পার্কা গায়ে দেয়। কোনজন আমাদের লোক বুঝব কীভাবে?
অ্যাসেম্বলি হলে এসে দেখল লোকে ভরে গেছে। পিছনের সারিতে সিট পেল ওরা। নেতা গোছের একজন সভা আরম্ভ করার নির্দেশ দিলেন। তাঁকে চেনে না কিশোররা।
মিস্টার সিউল, টেডের বাবা, ফিসফিস করে বলল মুন।
প্রথমে বিগসকে কিছু বলার অনুরোধ জানালেন মিস্টার সিউল।
গ্লিটারে থিম পার্ক হলে শহরবাসী কী কী সুবিধে ভোগ করবে, তার ওপর বক্তৃতা দিল বিগস্। ঘুম পাচ্ছে কিশোরের। হাততালির শব্দে চমকে জেগে গেল। দেখে বিগ বসে পড়েছে। গোল্ড ফেরানি উঠে দাঁড়িয়েছে। বক্তৃতা শুরু করল। পুরো সজাগ এখন কিশোর। কান খাড়া করে শুনতে লাগল।
গ্লিটারে আমাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম আমরা করে যেতে পারব, কোনটাই বন্ধ হবে না, গোল্ড বলছে। আমি খনিতে কাজ করতে পারব, শিকারীরা শিকার করতে পারবে, জেলেরা মাছ ধরতে পারবে। অমানুষিক পরিশ্রম করেও কোনমতে টিকে আছি এখন আমরা। অবস্থা যা দেখা যাচ্ছে, আর কিছুদিন পর না খেয়ে থাকতে হবে। খনিতে এখন আর সোনা মেলে না। সোনা এখন টুরিস্টের পকেটে, ডলার হয়ে ঢুকে গেছে। ওদের পকেট থেকে ওগুলো বের করে আনতে না পারলে আমাদের উন্নতি হবে না। কিন্তু বের করার জন্য গ্লিটারে ওদেরকে ডেকে আনা দরকার। থিম পার্ক কোম্পানি নিজেরাও টাকা কামাতে চাচ্ছে, আমাদেরও ভাগ দিতে চাচ্ছে, তাহলে সমস্যাটা কোথায়? এ সুযোগ আমাদের হাতছড়া করা উচিত হবে না।