মুসাও দেখল দড়িটা। সুতোর ছেড়া মাথাগুলো এত মসৃণ কেন? দাঁত দিয়ে কাটলে কিংবা টানাটানি করে ছিড়লে তো এত সমান হয় না।
ঠিকই বলেছ, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ধারাল ছুরি দিয়ে কাটার মত। মানে বুঝতে পারছ? দড়ির বেশির ভাগটাই কেটে রেখেছিল কেউ। কুকুরটা দুই-চার টান দিতেই বাকিটুকু ছিড়ে গেছে।
দূর থেকে আবার শোনা গেল নেকড়ের ডাক। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচানো শুরু করল কুকুরগুলো। জোসি বলল, ইজি, বয়েজ, ইজি।
তুমি ওদেরকে শান্ত করো, জোসিকে বলল কিশোর। আমি আর মুসা গিয়ে রেড লাইটকে খুঁজে আনি।
বাধা দিতে গিয়েও কী ভেবে দিল না জোসি।
রেড লাইটের পায়ের ছাপ অনুসরণ করে বনের মধ্যে এসে ঢুকল কিশোর ও মুসা।
কুকুরটা অনেক বড়। থাবাও বড়। তুষারে গভীর হয়ে ডেবে গেছে। অনুসরণ করা সহজ।
নীচের দিকে চোখ নামিয়ে হাঁটছে দুজনে। কিশোর বলল, আমরা যখন মোড়ের অন্যপাশে, কুকুরগুলো তখন চেঁচাননা শুরু করেছিল। মনে আছে?
মাথা ঝাঁকাল মুসা। হ্যাঁ।
আমার ধারণা, ওই সময়ই দড়ি ছিড়ে বনের দিকে দৌড় দেয় রেড লাইট। আর তাই যদি হয়ে থাকে, বেশি দূরে যায়নি ও।
পায়ের ছাপ ধরে এগোতে থাকল ওরা। বন থেকে বেরিয়ে ছোট্ট এক টুকরো খোলা জায়গা পেরিয়ে আবার বনে ঢুকে গেছে কুকুরটা।
কাঁপা কাঁপা তীক্ষ্ণ চিৎকার থেমে থেমে ভেসে এল বনের ভিতর থেকে। পরস্পরের দিকে তাকাল কিশোর-মুসা। সাবধান হয়ে গেল।
কাছেই নেকড়েগুলো, কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল মুসা। তারমানে কুকুরটাও আছে।
বনের ভিতর দিয়ে এগোতে এগোতে গাছপালার ফাঁক দিয়ে সামনে ছোট্ট আরেক টুকরো খোলা জায়গা চোখে পড়ল ওদের। ওরা বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল ডাকাডাকি।
বরফের মত জমে গেল যেন দুজনে। বাতাস স্তব্ধ। কোথাও কোন শব্দ নেই। ভূতুড়ে লাগল এই হঠাৎ নীরবতা। গায়ে কাঁটা দিল।
আস্তে করে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল বাদামি-ধূসর একটা মাদী নেকড়ে। বড় জাতের কুকুরের সমান। দাঁড়িয়ে গেল ওদের দিকে তাকিয়ে।
১০
একটু পর আরও তিনটে নেকড়ে বেরোল বন থেকে। পাশাপাশি প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিশোর-মুসার দিকে। নেকড়েগুলোর হাঁ করা মুখের ভিতর থেকে লম্বা জিভ বেরিয়ে ঝুলে পড়েছে। কিশোরের মনে হলো, শিকারের অসহায়ত্ব দেখে নীরব হাসি ফুটেছে ওদের মুখে। খুব সামান্য লেজ নড়ানো বাদ দিলে একেবারেই মূর্তি।
কিশোর, কী করব? বিড়বিড় করল মুসা।
ওদের বলল, আমরা যুদ্ধে বিশ্বাসী নই, শান্তি চাই। ওদের নেতার কাছে নিয়ে যেতে বলো, বিড়বিড় করেই জবাব দিল কিশোর।
রসিকতা ছাড়ো। বাঁচার কোন বুদ্ধি আছে?
আছে। নড়বে না। ওদের মতই মূর্তি হয়ে যাও। আমরা ওদের হামলা করতে পারি, এ ধারণাটা যাতে কোনমতেই ওদের মাথায় না ঢোকে। আমরা যে ভয় পেয়েছি, সেটাও বুঝতে দেবে না।
বুঝলাম।
পিছিয়ে গিয়ে দেখতে পারি ওরা কী করে, কিশোর বলল। খুব ধীরে।
সাবধানে এক পা পিছনে সরল দুজনে। আরেক পা ফেলল। ওদের সঙ্গে যেন অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা রয়েছে নেকড়েগুলো, টান লেগে ঠিক ততখানিই এগোল, ওরা যতখানি পিছিয়েছে। তারপর দুই পাশের দুটো নেকড়ে ডানে-বাঁয়ে একটুখানি করে সরে গেল।
চলে যাবে? মুসার প্রশ্ন।
ভুলেও ভেবো না, সতর্ক করল কিশোর। আমাদের ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। এভাবেই হামলা চালায় নেকড়েরা।
বাহ্, দারুণ একটা খবর শোনালে। কিন্তু তুমি তো নেকড়ে গবেষক নও। ওরা কী করবে জানলে কীভাবে?
বই পড়ে আর ন্যাশনাল জিওগ্রাফি দেখে।
নেকড়েগুলো আকারে হাস্কি কুকুরের চেয়ে বড়। দূর অতীতে কোনও এক সময় বোধহয় একই গোত্রের প্রাণী ছিল ওরা, রক্তের সম্পর্ক রয়েছে। কুকুরের তুলনায় নেকড়েগুলো অনেকটাই রোগাটে, ছিপছিপে। চোখে রাজ্যের খিদে। কিশোর জানে, কুকুরের চোয়ালের চেয়ে নেকড়ের চোয়াল দ্বিগুণ শক্তিশালী।
কিশোর, মুসা জিজ্ঞেস করল, ওরা যেভাবে আমাদের ঘিরে ফেলতে চাইছে, একেই কি সাঁড়াশি আক্রমণ বলে?
জানি না। তবে ওরা যা চাইছে, সেটা ঘটতে দেয়া যাবে না।
ঠেকাব কীভাবে?
ভাবছে কিশোর। ভোলা জায়গায় রয়েছে ওরা। বনের ভিতর কি নিরাপদ? না বিপদ আরও বেশি? বনে ঢোকা ছাড়া আর কোন উপায়ও দেখছে না। বন পেরিয়ে শহরের সীমানায় চলে যেতে হবে। কিন্তু তাতেও কি রক্ষা পাবে? সত্যিই কি শহরের সীমানায় ঢোকে না নেকড়েরা? সন্দেহ আছে কিশোরের।
মুসা, ডানে দেখো! ফিসফিস করে বলল মুসা।
ডান দিকের বন থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা বড় হাস্কি। দুলকি চালে হেঁটে আসতে লাগল ওদের দিকে।
ওটাই বোধহয় রেড লাইট, কিশোর বলল।
মনে হয়, মুসা জবাব দিল। রেড লাইট হোক বা না হোক, ওটা আমাদের পক্ষে থাকলেই আমি খুশি।
নেকড়েগুলোর কাছাকাছি এসে থেমে গেল কুকুরটা। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গরগর শুরু করল। চাপা, ভয়ঙ্কর শব্দ। থেমে গেল নেকড়েগুলো। তুষারে ঢাকা বনের এই মরণ-নাটকের নতুন অভিনেতার দিকে নজর দিল।
এটাই সুযোগ, কিশোর বলল। পিছাতে থাকো। বনের মধ্যে ঢুকেই দেবে দৌড়।
কয়েক সেকেণ্ডেই বনে ঢুকে পড়ল দুজনে। একটা মুহূর্ত আর দেরি করল না। দৌড়ানো শুরু করল। বুটের চাপে ভাঙছে পাতলা তুষারের স্তর। জুতো ডেবে যাওয়াটা একটা অসুবিধে। আরেক অসুবিধে, দৌড়ালে হাঁপাতে হয়। দ্রুত শ্বাস টানার সময় নাক দিয়ে ঢুকে যায় কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস। এ রকম আবহাওয়ায় এভাবে দ্রুত বাতাস টানার কারণে ফুসফুস জমে গিয়ে মানুষ মারা যাওয়ার গল্প শুনেছে কিশোর। তবে সেটা পরের ভাবনা। আপাতত নেকড়ের আক্রমণ থেকে বাঁচতে হবে।