তা তো জানেই, ডিউক বলল। ও, বুঝতে পারনি তা হলে, জানানোর জন্যই তো শহরের ওপর দিয়ে চক্কর দিয়ে এলাম। ব্যাগেজ কম্পার্টমেন্ট খুলে কিশোর-মুসার ডাফেল ব্যাগগুলো বের করে বরফের ওপর নামিয়ে রাখল ও।
গ্লিটার টাউন, চারপাশে তাকাতে তাকাতে বিড়বিড় করে নিজেকেই প্রশ্ন করল কিশোর, আজৰ নাম। নেটিভ আমেরিকান
শহরগুলোর সাধারণত এ রকম নাম হয় না।
ফ্রেইট কম্পার্টমেন্ট থেকে নানা রকম বাক্স আর প্যাকেট টেনে নামাতে শুরু করল ডিউক। সেই গোল্ড রাশের যুগে… গোন্ড রাশ বোবো তো?
যে সময়টায় সোনার খোঁজে খেপা হয়ে গিয়েছিল মানুষ, কিশোর জবাব দিল। পাগলের মত সোনা খুঁজে বেড়াত, স্বর্ণসন্ধানের সেই যুগটাকে বলে গোন্ড রাশ। স্বর্ণসন্ধানীদের বলে প্রসপেক্টরস।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল ডিউক। একশো বছর আগে সেই গোন্ড রাশের যুগে হাজার হাজার খনি-শ্রমিক আর প্রসপেক্টরস এসে হানা দিয়েছিল এখানকার পাহাড়-পর্বতগুলোয়। চকচকে সোনা-বোধহয় এই কথাটার ওপর ভিত্তি করেই ওরা শহরটার নাম রেখেছিল গ্লিটার টাউন। ভীষণ পছন্দের জায়গা ছিল এটা ওদের কাছে। কিন্তু সব কিছুরই শেষ আছে। ধীরে ধীরে এখানকার সোনা শেষ হয়ে এল। চলে গেল বাইরে থেকে আসা খনি-শ্রমিকেরা প্রায় সবাই…।
কিশোর! নদীতীরের দিকে আঙুল তুলল মুসা, দেখো, ও জোসি না?
ওর মতই তো লাগছে, কিশোরের কণ্ঠে উত্তেজনা।
প্রায় এক শ গজ দূরে মাঝারি উচ্চতার একটা গাট্টাগোট্টা মূর্তিকে দ্রুত এগিয়ে আসতে দেখা গেল বরফে ঢাকা নদীতীর ধরে। পার্কার হুড পিছনে নামানো। চওড়া মুখ, উঁচু চিবুক আর কালো চুল দেখে দূর থেকেও বন্ধুকে চিনতে পারল মুসা।
টান দিয়ে যার যার ব্যাগ তুলে নিল কিশোর ও মুসা। প্রায় ছুটতে শুরু করল জোসির দিকে।
কিশোর! মুসা! চিৎকার করতে করতে জোসিও ছুটে এল। কাছে এসে হাত মেলাল। পিঠ চাপড়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ?
ভাল, জবাব দিল কিশোর।
রবিন আসেনি?
নাহ্, আসতে পারেনি। নিউ ইয়র্কে।
আহহা, তাই। ও এলে খুব ভাল হতো।
তা তো হতোই। কিন্তু কী আর করা।
পথে কোন অসুবিধে হয়নি তো?
হয়েছে কি না টেরই পাইনি, এতই কুঁদ হয়ে ছিলাম। দেখার মত জায়গা।
ডিউকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জোসির পিছু পিছু শহরের দিকে হেঁটে চলল কিশোর-মুসা। গ্লিটারকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেল। দুই সারি পাহাড়ের মাঝখানে উপত্যকায় গড়ে উঠেছে শহরটা। ছড়ানো ছিটানো কাঠের কেবিনগুলো জড়সড় হয়ে আছে তীব্র শীতে। ধাতব স্টোভের পাইপ বেরিয়ে গেছে কেবিনের ছাত ফুড়ে। সেগুলো দিয়ে সাদা ধোয়া উঠে যাচ্ছে সুমেরুর পরিষ্কার নীল আকাশে।
জোসি বলল, তোমাদের কেবিনের স্টোভটা চালু করা দরকার। ঠিক আছে নাকি কে জানে। অনেকদিন চালু করা হয় না। আগে ওটা আমার কেবিন ছিল। আব্বা-আম্মা ফেয়ারব্যাংকসে জুততার ফ্যাক্টরিতে চাকরি করতে চলে যাবার পর থেকে বহুদিন ঢুকিও না ওখানে, দেখাও হয় না। এখন ওদের বড় কেবিনটায় আমি থাকি। চাচা-চাচীর ওখানে খাই।
জোসি জানাল, ওর চাচার নাম জেফরি, চাচী এরিনা।
চলতে চলতে শহরের একমাত্র দোতলা বাড়িটার দিকে চোখ পড়ল মুসার। এটাও কাঠের তৈরি। সামনের দিকে কাঠের সাইনবোর্ডের লেখাগুলো জোরে জোরে পড়ল ও, জেনারেল স্টোর, প্রোপ্রাইটরলুক স্টার্লিং। বলল, সিনেমায় দেখা পুরানো ওয়াইল্ড ওয়েস্টের মত করে লিখেছে।
হাসল জোসি। তা ঠিক। পুরানো আমলে বুনো পশ্চিমের মতই স্টেজকোচ আর ওয়্যাগন ট্রেন আসত এখানেও, এখন আসে ডিউকের এরোপ্লেন। ফেয়ারব্যাংকসে মালের অর্ডার দেয় লুক। ওর দোকানে যদি কিছু না পাও, গ্লিটারের আর কোথাও সেটা পাবে না, ওই জিনিসটা ছাড়াই চালাতে হবে তোমাকে।
নদীর দিক থেকে ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল। ফিরে তাকাল তিন কিশোর।
ডিউক চলে যাচ্ছে, জোসি বলল। সপ্তাহে একবার করে মালপত্র আর ডাক নিয়ে আসে ও।
নদীর দুই তীরে প্রুস গাছের সারি। মাঝখানের বরফে ঢাকা নদীর ওপরের অস্থায়ী রানওয়ে ধরে ছুটতে শুরু করল প্লেনটা। হঠাৎ লাফিয়ে উঠল বিশাল রাজহাঁসের মত। মোড় নিয়ে উড়ে গেল পশ্চিমে।
শহরের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সাদা একটা বাড়ি দেখাল জোসি। ছোট ছোট জানালা। অ্যাসেম্বলি রুম। পুরানো আমলে গোল্ড রাশের দিনে ওটাকে ড্যান্স হল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখন শহরের লোকে ওখানে সভাটভা করে।
বাড়িটার প্রবেশ পথের একপাশে বুলেটিন বোর্ড। তাতে বড় বড় দুটো পোস্টার লাগানো। একটা পোস্টার ভাল কাগজে মেশিনে ছাপা। গ্লিটার টাউনের ভবিষ্যৎ উন্নতিতে যারা বিশ্বাসী, তাদেরকে হ্যাঁ ভোট দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। আরেকটা পোস্টার সস্তা কাগজে, হাতে লেখা। যারা লিখেছে তাদের স্লোগান শহর বাঁচাতে চাইলে না ভোট দিন।
কী ব্যাপার? পোস্টার দুটো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, শহরে নির্বাচন নাকি?
নির্বাচন না, জোসি জানাল, থিম পার্ক কর্পোরেশন নামে একটা কোম্পানি গ্লিটারকে টুরিস্ট স্পট বানাতে চায়। এ ব্যাপারে এখানকার জনগণের মতামত যাচাইয়ের জন্য এই ভোটের ব্যবস্থা।
ডিজনি ওয়ার্ল্ডের মত কোন কিছু? জড়সড় হয়ে কুঁকড়ে থাকা কেবিনগুলোর দিকে তাকাল মুসা।
হাসল জোসি। কেন, আইডিয়াটা খারাপ মনে হচ্ছে? এ রকম একটা আদিম জায়গাকে থিম পার্ক বানাবে, বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়, তাই না?