কেটলিতে চাপানো ওষুধ নাড়তে নাড়তে ফিরে তাকালেন এরিনা। নিশ্চয় প্লেনে করে এনেছে। আমরা মনে করেছিলাম আমাদের কেবিনের শোক ভোলাতে, আমাদের খুশি করতে ফলগুলো উপহার দিয়েছে বিগস্।
দেয়ার সময় কিছু বলেছে? জানতে চাইল মুসা।
ও নিজে নিয়ে আসেনি, এরিনা জানালেন।
টেডকে দিয়ে পাঠিয়েছে, মুন বলল।
এক মিনিট এক মিনিট, ভুরু কুঁচকে গেছে কিশোরের। টেড সিউল? ও আনতে গেল কেন?
মুন বলল, লুক স্টার্লিঙের অনুরোধে।
এরিনা বললেন, লুকের কাছ থেকে অর্ডার পেলে খাবার আর অন্যান্য জিনিস ফেয়ারব্যাংকস থেকে নিয়ে আসে ডিউক আইকহ্যাম। লুক তখন সেগুলো নিজেই যার যার ঠিকানায় পৌছে দেয় কিংবা টেডের মত কাউকে দিয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করে।
আরও প্রশ্ন করার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিল কিশোর, হাত তুলে বাধা দিলেন এরিনা। মোটা একজোড়া দস্তানা পরে নিয়ে গরম কেটলিটা ধরে উঁচু করলেন। একটা মাটির পাত্রের মুখে পরিষ্কার এক টুকরো কাপড় রাখল মুন। তাতে কেটলির তরল পদার্থ ঢালতে লাগলেন এরিনা। কাপড়টা ছাঁকনি হিসেবে কাজ করল। মাটির পাত্র থেকে সেই তরল পদার্থ আবার বড় হাতায় করে চিনামাটির মগে নিলেন তিনি। তাতে সামান্য ঝর্নার পানি ঢেলে, অল্প একটু মধু মিশিয়ে ঠাণ্ডা করে নিয়ে গেলেন জেফরির কাছে।
বাবাকে বিছানায় উঁচু করে ধরল মুন। মগটা জেফরির ঠোটের কাছে ধরলেন এরিনা। ওষুধ খেয়ে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লেন জেফরি।
এরিনাকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, আচ্ছা, আন্টি, ফলের যে ঝুড়িটা দিয়ে গেল, তার মধ্যে কি নাম লেখা কোন কার্ড বা নোট ছিল?
ড্রেসারের ওপর থেকে একটা কার্ড নিয়ে এলেন এরিনা। কিশোরের হাতে দিলেন। দেখার জন্য কাত হয়ে এল মুসা। লেখা রয়েছে ইলকিস বিগস, ফিল্ড রেপ্রেজেনটেটিভ, থিম পার্ক। কার্ডের উল্টো দিকের সাদা অংশে হাতে লেখা কথাটার বাংলা মানে করলে দাঁড়ায়: অনেক শুভেচ্ছা। ইলকিস।
হ্যাঁ, কার্ডটা বিগসেরই, কোন সন্দেহ নেই, কিশোর বলল। কিন্তু জেফরি আঙ্কেলের নাম তো নেই কোথাও। এমনও তো হতে পারে কার্ডটা অন্য কাউকে দিয়েছিল বিগস। বিগসই উপহার পাঠিয়েছে বোঝানোর জন্য সেই লোক কার্ডটা ফলের ঝুড়িতে ভরে দিয়েছে।
টেড সিউলের মত কেউ? মুসার প্রশ্ন।
হতে পারে।
কিশোরের দিকে তাকাল জোসি। তুমি বলতে চাও ফলগুলোতেই গোলমাল?
ল্যাবরেটরি টেস্ট না করে শিওর হওয়া যাবে না। কিন্তু কোন কিছুর বিনিময়েই ওই আপেলে কামড় বসাতে রাজি নই আমি।
রাগে লাল হয়ে গেল জোসির মুখ। টেড যদি ভেবে থাকে আমার পরিবারের ওপর হামলা চালিয়ে, তাদের ক্ষতি করে ইডিরাটোড রেসে আমার অংশ নেয়া বন্ধ করাবে, মস্ত ভুল করছে ও। ওকে আমি ছাড়ব না।
ওর বাহুতে হাত রাখল মুন। জোসি, না জেনে কাউকে দোষারোপ করা ঠিক না। অন্য কেউও তো এ সব শয়তানি করে থাকতে পারে? টেড সিউলকে দোষী বানানোর জন্য।
ওর কথায় যুক্তি আছে, মনে মনে স্বীকার করল কিশোর।
পারলে কিছু একটা করো, এরিনা বললেন। আরও খারাপ কিছু ঘটে যাবার আগেই।
টেবিল থেকে ওষুধের মগটা তুলে নিয়ে আবার জেফরির কাছে গেলেন এরিনা। কেমন লাগছে এখন?
কোলাব্যাঙের স্বর বেরোল জেফরির গলা দিয়ে, ভাল।
আরেকটু দেব?
চোখ-মুখ কুঁচকে জেফরি বললেন, তোমার ওই ভয়াবহ জিনিস!
হাসলেন এরিনা। স্বাদটা খারাপ, তবে ওষুধ হিসেবে খুবই ভাল, অস্বীকার করতে পারবে না।
উঠে বসার চেষ্টা করলেন জেফরি। কাঁধ চেপে ধরে শুইয়ে দিলেন এরিনা। রেস্ট নাও। তোমার এখন বিশ্রাম দরকার।
সন্ধ্যার পর এরিনা বললেন, মুজের মাংসের কাবাব বানাব। আনতে পারবে?
উঠে দাঁড়াল মুসা। পারব।
কোথায় রেখেছেন? জানতে চাইল কিশোর।
আমাদের কেবিনের পিছনের ছাউনিতে, এরিনা বললেন। হুকে ঝোলানো আছে, আস্ত একটা রান। ছুরি, করাত সবই পাবে ওখানে।
লণ্ঠন জ্বেলে দিল জোসি। বাতি হাতে বাইরের অন্ধকারে বেরিয়ে এল কিশোর ও মুসা। উজ্জ্বল বড় বড় তারা মেরুর আকাশে ঘন হয়ে ফুটে আছে। কাছেই একটা পেঁচা ডাকল। মানুষের সাড়া পেয়ে ঝোপের মধ্যে ছুটে পালাল ছোট কোন জানোয়ার।
এ রকম সাধারণ একটা ছাউনির মধ্যে মাংস রাখে! মুসা বলল।
হাসল কিশোর। ভয় নেই। শীতকাল। নষ্ট হবে না। ছাউনির ভিতরের তাপমাত্রা এখন ডিপ ফ্রিজের চেয়ে কম নয়।
তারমানে মাংস জমাট বেঁধে বরফের মত শক্ত হয়ে গেছে। করাত ছাড়া কাটা যাবে না।
পোড়া কেবিনটার কাছে পৌঁছল ওরা। এখনও ধােয়ার গন্ধ বেরোচ্ছে। পাশ দিয়ে ঘুরে আসতে ছাউনিটা চোখে পড়ল। দরজা খুলল মুসা। ভিতরে ঢুকল দুজনে।
লণ্ঠন উঁচু করে ঘরের মধ্যে খুঁজতে লাগল কিশোর। বাঁয়ে একটা কাঠের বাক্স। তার ওপর রাখা চামড়ার স্তুপ, ফাঁদ পেতে ধরা হয়েছিল বুনো জানোয়ারগুলোকে। জমে শক্ত হয়ে গেছে। পিছনের দেয়ালে ঝোলানো কাঠ চেরাই করার একটা অনেক বড় করাত। চালাতে দুজন লাগে। বড় একটা বেতের ঝুড়িতে রাখা প্রয়োজনীয় নানারকম যন্ত্রপাতি।
সবই তো আছে দেখছি, কিন্তু মাংস কোথায়? চারপাশে তাকিয়ে খুঁজতে লাগল মুসা।
লণ্ঠনটা আরও উঁচু করে ধরল কিশোর। বিম থেকে বড় একটা হুক ঝুলছে। নিশ্চয় ওটাতেই ঝোলানো ছিল মাংসের টুকরো।
তাহলে এখন গেল কোথায়… কিশোর, দেখো!
মুসার কণ্ঠস্বর চমকে দিল কিশোরকে। চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল। ছাউনির কাঠের দেয়ালে কালো রঙ দিয়ে আঁকা একটা হৃৎপিণ্ড। মাঝখানে একটা ছুরি গাঁথা।
৮
স্তব্ধ হয়ে ছুরিটার দিকে তাকিয়ে আছে দুজনে। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কেটে গেল। অবশেষে মুখ খুলল মুসা, মাংসের টুকরোটা হুক থেকে খুলে নিয়ে গেছে কেউ।