ইজি, ডায়মণ্ড, ইজি! মোলায়েম স্বরে আদেশ দিল জোসি।
দৌড়াননা বাদ দিয়ে হেঁটে চলেছে কুকুরগুলো। চোখে অস্বস্তি। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
ইজি, ডায়মণ্ড, সাবধান করল জোসি।
থেমে গেল ডায়মণ্ডহার্ট। চারপাশে তাকাতে লাগল।
হাইক! হাইক! চিৎকার করে উঠল জোসি। নদীর কিনারের দিকে সরে যেতে চায়।
কিছু যদি ঘটে… বলতে গেল জোসি।
বন্দুকের গুলি ফোটার মত শব্দ হলো। ঝট করে ফিরে তাকাল কিশোর। স্লেজের ডান পাশের বরফে চওড়া একটা ফাটল চোখে পড়ল। তীরের কাছে নিরাপদ জায়গায় পৌছে গেছে কুকুরগুলো। কিন্তু নদীর মাঝখানের পাতলা বরফ স্লেজের ভার সইতে পারছে না।
জোসি, কী করব আমরা? চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। নেমে যাব?
না-না! চেঁচিয়েই জবাব দিল জোসি। বসে থাকো, যেভাবে আছ!
জমাট বাতাসে প্রতিধ্বনি তুলল যেন তীক্ষ্ণ একটা শব্দ। অনেকটা বন্দুকের গুলির মত, তবে আরও জোরে। বরফের স্তর ভেঙে গেছে। লাফিয়ে নামল জোসি। রেইল চেপে ধরে স্লেজটাকে আটকানোর চেষ্টা করল।
বরফের ভাঙা স্তরের সঙ্গে সঙ্গে ডান পাশে কাত হয়ে যাচ্ছে, স্নেজু। পিছলে নেমে যেতে শুরু করল পানির দিকে।
৬
উঠে দাঁড়াল মুসা। দুই হাত দুই পাশে ছড়িয়ে দিয়ে ভারসাম্য বজায়ের চেষ্টা করল। কাজ হলো না। স্লেজের রেইল এসে ওর গোড়ালি ধরে টান মারল। পিছনে উল্টে পড়ল ও। ফুসফুসের সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গেল। বরফ-শীতল পানি যেন গিলে নিল ওকে।
বরফের কিনার খামচে ধরার চেষ্টা করল ও। বরফের নীচে আটকে পড়ে বাস্তবে কাউকে মরতে দেখেনি, তবে সিনেমায় দেখা ভয়ঙ্কর দৃশ্যগুলো ফুটে উঠল চোখের সামনে। নদীর তলায় জুতো ঠেকল। পানি বেশি না। সোজা হয়ে দাঁড়ালে বুক পানি হয়। দশ ফুট চওড়া একটা ফোকর তৈরি হয়েছে বরফে। কিশোর আর জোসির নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে লাগল।
ভয় নেই, দাঁড়িয়ে থাকো, জবাব দিল কিশোর। তোমাকে তুলে আনার ব্যবস্থা করছি আমরা।
বরফের মত ঠাণ্ডা পানি মারাত্মক বিপজ্জনক। দেহের অতি মূল্যবান উত্তাপ শুষে নিয়ে দ্রুত শীতল করে ফেলছে দেহটাকে। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে, নিজেকে বোঝাল মুসা। ওপরে ওঠার জন্য দাপাদাপি করলে আরও দ্রুত ফুরাবে জীবনীশক্তি।
ধীরে ধীরে পানি আর ভাঙা বরফের টুকরো বুক দিয়ে ঠেলে কিনারের দিকে এগোতে পারে, কিন্তু সাহস করল না। স্রোতের টানে বা অন্য কোনভাবে যদি ডুবে গিয়ে বরফের স্তরের নীচে চলে যায়, আর বেরোতে পারবে না।
দাঁড়িয়ে রইল ও। গায়ের চামড়ায় সুচ ফুটাচ্ছে ভীষণ ঠাণ্ডা পানি।
ওদিকে জেটাকে আটকে ফেলেছে কুকুরের দল, পানিতে পড়তে দেয়নি–স্লেজের মধ্যে পাগলের মত কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে কিশোর ও জোসি। অমন করে কী খুঁজছে ওরা, বুঝতে পারছে না মুসা। অবশেষে সোজা হয়ে দাঁড়াল জোসি। হাতে একটা কুড়াল। দৌড় দিল বনের দিকে।
ও এখন যাচ্ছে কোথায়? আমি এদিকে জমে মরছি! চিৎকার করে বলল মুসা।
তোমাকে বাঁচানোর জিনিস আনতে গেছে, কিশোর বলল। নড়াচড়া কোরো না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো।
পা অবশ! সাড়া পাচ্ছি না! দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাচ্ছে মুসার।
হামাগুড়ি দিয়ে মুসার দিকে এগোতে শুরু করল কিশোর। দূরত্ব মাত্র কয়েক ফুট, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সেটাও অনেক। চড়চড় শব্দ করে উঠল বরফ।
ফিরে যাও, কিশোর! চিৎকার করে উঠল মুসা। বরফ তোমার ভার সইতে পারছে না।
চুপ করে থাকো। আমার কাজ আমাকে করতে দাও।
তুমিও যদি পানিতে পড়ে যাও, তাতে আমার কোন উপকার হবে। তারচেয়ে জোসির জন্য অপেক্ষা করো। ও জানে, এখন কী করা দরকার, আমরা জানি না।
ঠিকই বলেছে মুসা। অনিচ্ছাসত্ত্বেও পিছিয়ে গেল কিশোর। বার্চের একটা লম্বা ডাল হাতে ছুটে বেরোতে দেখা গেল জোসিকে। দৌড়ে আসতে লাগল।
কিশোর, নদীর পাড়ে পা রেখে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ো, জোসি বলল। শক্ত করে আমার গোড়ালি চেপে ধরে রাখবে।
কী করতে চাও?
বরফের স্তরে দেহের ওজন সমানভাবে ছড়িয়ে দেয়া গেলে সহজে ভাঙবে না বরফ। উপুড় হয়ে শুয়ে খুব সাবধানে ইঞ্চি ইঞ্চি করে মুসার দিকে এগোতে শুরু করল জোসি। ডালটা সামনে বাড়িয়ে দিল। মুসা, দেখো তো নাগাল পাও নাকি?
ডান হাত যতটা সম্ভব লম্বা করে দিল, মুসা। আঙুলের মাথা থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে রয়েছে ডালের মাথা। কিন্তু এখন এটাকেও বিশাল দূরত্ব মনে হচ্ছে। পারছি না তো!
আরেকটু আগে বাড়ল জোসি। বিপজ্জনক জায়গায় চলে এসেছে। এখন?
আবার হাত বাড়াল মুসা। ডালের মাথা এখনও ওর নাগালের বাইরে।
প্রাণপণে জোসির গোড়ালি চেপে ধরে রেখে প্রায় ককিয়ে উঠল কিশোর, চেষ্টা করো, মুসা। ডালটা ধরো।
বড় করে দম নিল মুসা। দেহের শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসছে।
ডালটা আরও ইঞ্চি দুয়েক ঠেলে দিল জোসি। এবার?
ডালের মাথায় লক্ষ্য স্থির করল মুসা। তারপর প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে ঝাপ দিল। হাত ফসকালে সোজা চলে যেত বরফের তলায়, কিন্তু শেষ মুহূর্তে ধরে ফেলল ডালের মাথা। পা উঠে গেল ওপরে। তাতে দেহটা পুরোই ডুবে গেল বরফ-শীতল পানিতে। শরীর অবশ হয়ে যাওয়াতে ঠাণ্ডাও আর অতটা টের পাচ্ছে না। বুঝতে পারছে, মোটেও ভাল লক্ষণ নয় এটা।
এই তো পেরেছ! ধরে রাখো! খবরদার, ছাড়বে না! চিৎকার করে উঠল কিশোর।
দুই হাতে ধরো, জোসি বলল।
বড় করে দম নিল মুসা। নদীর পিচ্ছিল মাটিতে পা ঠেকাল আবার। ভালমত ধরতে না পারলে ডাল থেকে হাত ছুটে যাবে। অন্য হাতটাও বাড়িয়ে দিল। ডালের গায়ে শক্ত হয়ে চেপে বসল ওর আঙুল।