কিন্তু মুজ তো আর গজাল ঠুকে নৌকা ফুটো করতে পারবে না, কিশোর বলল। জোর নৌকাটা যে নষ্ট করেছে সে মানুষ। জানে, রাতে বেরোলে কারও চোখে পড়বে না। সহজেই কাজ সেরে চলে যেতে পারবে।
আচ্ছা, জোর নৌকা নষ্ট করা, টিনুকদের কেবিনে আগুন লাগানো আর জোসির ঘরে লাকড়ি ছুঁড়ে মারার মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই তো?
থাকতে পারে, চিন্তিত ভঙ্গিতে জবাব দিল কিশোর। কাকতালীয় ঘটনা আমি বলব না একে। কী রকম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এখানে বাস করে মানুষ, দেখেছ? একটানা দীর্ঘ শীত। সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন। কর্মহীন ঘরে বসে থাকা। স্নায়ুতে ভীষণ চাপ পড়ে। মাথায় গোলমাল হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। আর পাগল হয়ে গেলে কী না করে মানুষ। যাদের দেখতে পারে না তাদের ওপর আক্রোশ মেটানোর চেষ্টা যদি করে থাকে এ রকম কোনও পাগল, আমি অবাক হব না।
ভাবছি, ব্ৰিণ্ডল জ্যাকের সঙ্গে জো সারটনের সম্পর্কটা কেমন? নিজেকেই প্রশ্ন করল মুসা। জোসি হয়তো বলতে পারবে।
অর্ধেক পথ এসে জোসির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ওদের। জোসি বলল, এলে। আমি তো আরও ভাবলাম, হারিয়েই গেলে বুঝি তোমরা।
জো সারটনের নৌকাটার কথা জোসিকে জানাল মুসা। তারপর জ্যাক আর জোর সম্পর্ক নিয়ে যে কথাটা ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল এতক্ষণ, সেটা বলল।
বহু বছর ধরেই ওদের সম্পর্ক ভাল না, জোসি জানাল। তবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। জ্যাকের সম্পর্ক কারও সঙ্গেই ভাল না, একমাত্র টেডের বাবা মিস্টার সিউল ছাড়া।
কিশোরের মনে পড়ল, জো বলছিল ইডিটারোড নিয়ে নানারকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে ওকে। ডগজে রেসের সঙ্গে জো কোনভাবে জড়িত কি না, জোসিকে জিজ্ঞেস করল।
ও একজন প্রথম শ্রেণীর রেসার, জোসি বলল। আশপাশের পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে ওর মত মাশার নেই। হাস্কি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান। তবে এখন আর মাশিং করতে পারে না। কয়েক বছর আগে ছেলের অপারেশনের টাকা জোগাড়ের জন্য বাধ্য হয়ে গাড়িসহ কুকুরগুলোকে বিক্রি করে দিয়েছিল। বেচারা!
দুঃখজনক! আফসোস করল মুসা। কিন্তু সে যদি আর রেসে অংশ গ্রহণ না-ই করে, লোকে ইডিটাররোড রেসের ব্যাপারে ওকে প্রশ্ন করে কেন?
করবেই তো। সে রেস বিষেশজ্ঞ। সম্ভবত, কার ওপর বাজি ধরা উচিত সেটা বুঝতে চায় লোকে। ইডিটারোডের ডগ রেস এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় রেস। বহু টাকার জুয়া চলে। প্রতি বছর বহু লোক ধনী হয়, আবার বহু লোক সর্বস্বান্তও হয়। আমার আর টেডের ওপরও গ্লিটারের লোকে এবার বাজি ধরবে, জানা কথা।
কথা বলতে বলতে কেবিনে পৌঁছল ওরা। বাক্স নিয়ে ভিতরে ঢুকল। জোসি জিজ্ঞেস করল, আরেকবার প্র্যাকটিস রানে গেলে কেমন হয়? পরিশ্রম না করালে চর্বি জমে যাবে কুকুরের গায়ে, অলস হয়ে পড়বে ওরা।
ভালই তো হয়,মুসা বলল। আমি রাজি।
কিশোর বলল, আমারও কোন আপত্তি নেই।
কুকুরের গলায় লাগাম পরাতে জোসিকে সাহায্য করল দুজনে। নদীতে উঠে গতি বাড়াল কুকুরগুলো। লেজ উঁচু করে দিয়েছে। হাঁ করা চোয়ালের এক কোণ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে লাল জিভ।
যাচ্ছি কোথায়? কিশোরের প্রশ্ন।
মিঙ্ক রিভারে, জোসি জানাল। স্লেজের পিছনের রেইলে দাঁড়িয়েছে ও। বার বার পা নামিয়ে ঠেলা দিচ্ছে স্লেজের গতি বাড়ানোর জন্য। বেশি দূরে না।
কত দূর? মুসা জানতে চাইল।
এই পাঁচ মাইল। হাস্কির জন্য এটা কোন দূরত্বই না।
তা তো বুঝতেই পারছি, কিশোর বলল। ইডিটারোড রেসে এগারোশো মাইল দৌড়াবে যারা, তাদের জন্য পাঁচ মাইল আর কী। কটা দল অংশ নিচ্ছে এবার?
নদীর ওপরের বরফের স্তর মসৃণ নয় মোটেও। অসমতল। এবড়ো-খেবড়ো। টিলা-টক্করও আছে। লাফিয়ে উঠল স্লেজ। টিলা পেরিয়ে আসার পর কিশোরের কথার জবাব দিল জোসি, সত্তরআশিটা দল হবে।
হিসেব করল মুসা, সত্তর-আশিটা দলে অন্তত হাজারখানেক কুকুর। অ্যাংকারেজে একটা দেখার মত দৃশ্য হবে
নদীর ওপাড়ে তাকাল ও। পাহাড়ে তো তেমন তুষার দেখছি না। গলে যায় নাকি?
থাকলে তো গলবে, জোসি বলল। শুনে অবাক হবে, আমাদের এদিকটা আসলে এক ধরনের মরু অঞ্চল। বছরে বারো ইঞ্চির বেশি তুষারপাত হয় না। এই বরফ তো তৈরি হয়েছে নদীর পানি জমে।
সামনে রাস্তাটা দুই ভাগ হয়ে গেছে। চেঁচিয়ে উঠল জোসি, জি, ডায়মণ্ড, জি!
দলের কুকুরগুলোকে নিয়ে ডান দিকের পথটা ধরে ছুটল ডায়মণ্ডহার্ট।
আরও মাইল দুই এগোনোর পর ইউকন থেকে সরে এল জোসি, অপেক্ষাকৃত সরু আরেকটা নদীর ওপর দিয়ে স্লেজ ছোটাল। বন্ধুদের জানাল, মিংক রিভারে যাবার এটা শর্টকাট।
মিনিট দশেক পর গতি কমিয়ে দিল কুকুরগুলো। চিন্তিত মনে হলো জোসিকে।
কী হয়েছে? জানতে চাইল কিশোর। দ্বিধা করছে জোসি। সামনে নরম বরফ।
বকের মত গলা বাড়িয়ে দিয়ে সামনে তাকাল কিশোর। ওর চোখে বরফের স্তরে কোন তফাৎ ধরা পড়ল না।
নদীর তলায়ও ঝর্না আছে এখানে, জানো বোধহয়। বরফের স্তর পাতলা হয়ে যাওয়ার কারণটা ব্যাখ্যা করল জোসি, সেগুলো থেকে গরম পানি বেরিয়ে নীচের দিকের বরফ গলিয়ে দেয়। বছরের এ সময়টাতেই এ ঘটনা বেশি ঘটে।
সামনে তো আর এগোনো যাবে না বোঝা যাচ্ছে, মুসা বলল। কী করবে এখন? গাড়ি ঘোরাবে?
এমন একটা জায়গায় চলে এসেছে, ঘোরানোটাও আর সহজ নয়, বুঝে গেছে কিশোর। এখন কুকুরগুলোকে ঘোরাতে হলে পাতলা বরফে উঠতেই হবে।