জেনারেল স্টোরের চেহারাটা মুসার অনুমানের সঙ্গে মিলল না। এত কিছু দেখবে আশা করেনি। ঘরের মাঝখানে পেটমোটা বিরাট একটা কালো রঙের লোহার স্টোভ বসানো। সামনে রাখা দুটো পুরানো কাঠের চেয়ার। দেয়ালের অসংখ্য তাক জিনিসপত্রে বোঝাই। টিনের খাবার থেকে শুরু করে ঘড়ি, হাতুড়ি, হারিকেন, সব আছে। কাপড়ের বস্তায় ভরা ময়দা, চাল আর পোষা জানোয়ারের খাবার ঘরের কোণে স্থূপ করে রাখা। কাঠের একটা কেবিনেট আছে, তাতে ভর্তি উলের শার্ট, প্যান্ট, দস্তানা, মোজা আর লাল রঙের প্লেইড ক্যাপ। ঘরের পিছনে বুনো জানোয়ারের রোমশ চামড়ার স্থূপ। শিকারিদের কাছ থেকে কেনা।
কাউন্টারের ওপাশ থেকে বেরিয়ে এলেন যিনি, একেবারে খাপে খাপে মানিয়ে গেছেন এই পরিবেশের সঙ্গে। বয়েস পঞ্চাশ। হাড্ডিসর্বস্ব লম্বা শরীর। মস্ত টাক। শার্ট আর টাইয়ের ওপরে নীল-সাদা ডোরাকাটা অ্যাপ্রন।
জোসেফ টিনুকের বন্ধু তোমরা, দোকানী বললেন, লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে এসেছ। আমি লুক স্টার্লিং। আমাকে মিস্টার স্টার্লিং ডেকে জিভে ব্যথা করার দরকার নেই। শুধু লুক বলবে।
এখানে কি কেউ মিস্টার শব্দটা সহ্য করতে পারে না নাকি? প্রশ্ন না করে পারল না মুসা।
না, পারে না। এই বুনো প্রকৃতির মধ্যে ওই শব্দটা খুব বেমানান, রীতিমত কানে পীড়া দেয়। তো, কী কী জিনিস দরকার?
এরিনার দেয়া লিস্টটা বের করে দেখাল কিশোর।
নিজেরাই তুলে নাও, লুক বললেন।
মুসাকে ইশারা করল কিশোর। লিস্ট মিলিয়ে তাক থেকে জিনিসগুলো তুলে নিতে লাগল মুসা।
সাংঘাতিক কাণ্ড, বুঝলে, ওই আগুন লাগার কথা বলছি, ওপরের তাকে রাখা কিছু টিনের খাবার নামিয়ে আনার জন্য একটা মই বেয়ে উঠে গেলেন লুক। সে-কারণেই বলি, নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকা দরকার। এমনই দরিদ্র অবস্থা শহরটার, ছোটখাট একটা দমকলবাহিনী পোরও সামর্থ্য নেই। তবে, থিম কোম্পানি যদি আসে…
আপনি কি ওদের আসা চান, মিস্টার স্টার্লিং? মুসা জিজ্ঞেস করল।
বলেছি না মিস্টার বলার দরকার নেই। শুধু লুক। হ্যাঁ, তোমার প্রশ্নের জবাব হলো, আমি নিরপেক্ষ। আমি হলাম দোকানদার। আমার জন্য সব সমান। পক্ষপাতিত্ব করে কাস্টোমারদের বিরাগভাজন হতে চাই না। দলাদলিটা ওরাই করুক। শহরবাসী যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেটাই আমি নির্দ্বিধায় মেনে নেব। তবে ইলকিস বিগৃসের কথায়ও যুক্তি আছে, অস্বীকার করতে পারব না। ওর কোম্পানি আলাস্কার বহু জায়গাতেই এ ধরনের টুরিস্ট স্পট বানিয়েছে। লোকে কী চায় ওরা জানে…
দরজার ঘণ্টা বাজল। থেমে গেলেন তিনি। ঘরে ঢুকল একটা লোক, এখানকার রোদ আর বরফের সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছে, দেখেই বোঝা যায়। গায়ে পুরানো মলিন পার্কা। কাউন্টারে রাখা বড় একটা বয়েম দেখিয়ে পঁচিশ সেন্ট দামের ক্যাণ্ডি চাইল।
ক্যাণ্ডি বের করে দিলেন লুক। লোকটার হাত থেকে পাঁচ সেন্টের পাঁচটা মুদ্রা নিয়ে ঝনাৎ করে ড্রয়ারে ফেললেন। লোকটা বেরিয়ে গেলে বললেন, ওর নাম জো সারটন। চার ছেলেমেয়ের বাপ। ওদের মুখে খাবার যোগাতে হয়। কাপড়ের অবস্থা দেখেই তো বুঝলে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। থিম পার্ক হলে ভাল চাকরি পাবে। টাকা আসবে। অবস্থা ফিরে যাবে।
তারমানে থিম পার্কের পক্ষে ভোট দিচ্ছে ও? কিশোর বলল।
অন্যদিকে চোখ ফেরালেন লুক। উঁহু। জো স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে হ্যাঁ ভোটের মধ্যে সে নেই। কিন্তু ভাল থাকতে চাইলে ওর হ্যাঁ ভোটই দেয়া উচিত।
এরিনার লিস্টের সমস্ত জিনিসপত্র দুটো কার্ডবোর্ডের বাক্সে প্যাকেট করে দিলেন লুক। একটা কাচের বাক্স ভর্তি অ্যাথাবাস্কান হস্তশিল্পের দিকে মুগ্ধ চোখে কিশোরকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন, অনেক দামি ওগুলো। নেবে?
মেরিচাচীর জন্য একটা শো-পিস নেয়ার কথা ভাবছে কিশোর। হাসল। এখন না। পরে। জিনিসগুলো খুব সুন্দর।
ক্যালকুলেটর বের করে জিনিসের দাম হিসেব করলেন লুক। বিল বানালেন। টিনুকদের বাকির খাতায় লিখে রাখব। তোমরা এসো আবার। বাড়ি ফেরার আগে এসো। সস্তায় ভাল কী দেয়া যায়, চিন্তা করে দেখব।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, লুক, কিশোর বলল।
দুটো বাক্স নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এল মুসার পিছন পিছন।
বাইরে আসতেই বিগসের সঙ্গে দেখা। বলল, এমন কোনও জিনিস নেই যা লুকের দোকানে পাবে না। সব ধরনের খবরাখবর আর মন্তব্যও পাবে, বিনে পয়সায়। সম্ভব হলে এর জন্যও পয়সা নিত। মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, কিন্তু ভীষণ লোভী। থিম পার্কের কথা কিছু বলল নাকি? পক্ষে না বিপক্ষে?
পক্ষে-বিপক্ষে বোঝা গেল না, মুসা জানাল। তবে থিম পার্ক হলে শহরের গরিব মানুষদের দুঃখ ঘুচবে, এ কথাটা জোর দিয়েই। বললেন।
বিগ বলল, আমাদের নিজেদের স্বার্থ তো আছেই। তবে সত্যি সত্যি আমরা গিটারের মানুষকে সাহায্য করতে চাই। বাইরের সাহায্য ওদের প্রয়োজন।
কিন্তু আপনার কোম্পানি থিম পার্ক বানাতে গেলে তো অনেক কিছু বদলাবে, তাতে জায়গাটার মৌলিকত্ব নষ্ট হবে, কিশোর বলল।
হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে উন্নতি যে হবে, এটাও তো ঠিক। যে কোনও পরিবর্তনের কথা শুনলেই ভয় পায় লোকে, নতুন কিছুকে গ্রহণ করতে শঙ্কিত হয়। আমার কাজ হলো ওদের বুঝিয়েশুনিয়ে ভুল ভাঙাননা, থিম পার্কের পক্ষে ভোট দিতে রাজি করানো; বোঝননা, এখানে থিম পার্ক হওয়াটা ওদের জন্য কতটা জরুরি।