কিন্তু মোড় নিয়ে অন্য পাশে এসে হতভম্ব হয়ে গেল ওরা।
লোকগুলো উধাও!
খাইছে। হাপাতে হাপাতে বিমূঢ়ের মত এদিক ওদিক তাকাচ্ছে মুসা।
আমরা যে পিছু নিয়েছি নিশ্চয় বুঝে ফেলেছে, অনিতা বলল।
কিংবা হয়তো গাড়িটাড়ি কিছু রাখা ছিল এখানে। তাতে উঠে চলে গেছে, ডলি বলল।
কিংবা হরিণে টানা স্লেজ, ব্যঙ্গ করে বলল রবিন। যে গাড়িতে চড়ে চলাফেরা করে ফাদার ক্রিস্টমাস।
কিন্তু এ মুহূর্তে এ রসিকতায় হাসতে পারল না কেউ। ভীষণ হতাশ হয়ে বব বলল, তারমানে ওদের সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্যে কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। হেনরির দোকান যখন খোলে।
কিন্তু হঠাৎ করেই জোরে হাত নেড়ে বন্ধুদের সাবধান করে দিল কিশোর। ঠেলে, ধাক্কা দিয়ে সবাইকে নিয়ে চলে এল একটা পার্ক করে রাখা গাড়ির আড়ালে। ওই যে ওরা! কয়েক মিনিটের জন্যে ওই অফিস বাড়িটায় ঢুকেছিল।
তাই তো মনে হচ্ছে নিচু স্বরে বলল বব। পোশাক খোলার জন্যে হবে। হয়তো।
দেখলে? চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে ফারিহা। মোটেও অপরাধী মনে হচ্ছে না এখন ওদেরকে।
অনিতাও হা হয়ে গেছে। বয়েসও তো আমাদের চেয়ে তেমন বেশি না।
খানিক দূরে একটা অফিস বিল্ডিঙের সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে দুজন তরুণ। বগলে দুটো লাল-সাদা রঙুের পোশাক।
ওখানে ঢুকেছিল পরনের ফাদার ক্রিস্টমাসের আলখেল্লা খোলার জন্যে, মুসা বলল। নিচে তো একেবারে সাধারণ পোশাক।
কিন্ত ওই পোশাক এ ভাবে খোলাখুলি নিয়ে যাচ্ছে কেন? মানুষে দেখলে যে চিনে ফেলবে সেই পরোয়াও করছে না নাকি? আনমনে বিড়বিড় করল কিশোর। ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না আমার।
পিছু নেব নাঁকি ওদের? জিজ্ঞেস করল রবিন। তাহলে হয়তো আরও কিছু জানা যাবে। কি, নেব?
অতএব রওনা হয়ে গেল ওরা। পার্ট করে রাখা গাড়িগুলোর আড়ালে আড়ালে বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে অনুসরণ করে চলল লোকগুলোকে।
একের পর এক রাস্তা পেরিয়ে যেতে লাগল ওরা। শহরের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া নদীটার পাড় ধরে এগোল খানিক। তারপর একটা বাগানওয়ালা চত্বরে চুকল। এক সারি সামনে গিয়ে কথা বলতে লাগল দুজনে।
বাগানে ঢুকে পড়া উচিত আমাদের, কিশোর বলল। পাতাবাহারের আড়ালে আড়ালে ওদের অনেক কাছে চলে যেতে পারব।
দ্রুত একটা ঝোপের আড়ালে এসে লুকাল ওরা, লোকগুলোর খুব কাছে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে বলেই রাত কাবার করবে নাকি? ফিসফিস করে বলল ডলি। উফ, ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি আমি!
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না ওকে। হাত মেলাল লোকগুলো, তারপর দুজন দুদিকে হাটতে শুরু করল।
সবে পা বাড়াতে যাবে ওরা, এই সময় বড় একটা কালো গাড়ি এসে ঘ্যাচ করে থামল ওদের পাশে। পাকা চত্বরে রবারের চাকা ঘষার শব্দ মিলানোর আগেই লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এল দুজন লোক।
আরে, সেই গালকাটা! দম বন্ধ করে ফেলল অনিতা।
এতটাই চমকে গেল দুই ফাদার ক্রিস্টমাস, বাধা দেয়ার কথাও যেন মাথায় এল না। সহজেই ওদের কাবু করে ফেলা হলো।
স্তব্ধ হয়ে গেছে গোয়েন্দারা। হা করে তাকিয়ে দেখছে পাতাবাহারের ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থেকে।
এত দ্রুত ঘটে গেল ঘটনাটা, টু শব্দটি করার সুযোগ পেল না ফাদার ক্রিস্টমাসেরা। তাদের একজনকে ধাক্কা দিয়ে তুলে দেয়া হলো গাড়িতে। কিন্তু দ্বিতীয়জনকে তোলার আগেই হঠাৎ ঝাড়া দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়েই দৌড় মারল সে। পালিয়ে গেল। দোকানের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ফটো তোলে যে লোকটা, এ সে-ই।
এক দৌড়ে গিয়ে ফ্ল্যাটগুলোর মাঝে ঢুকে হারিয়ে গেল সে। ওর অাক্রমনকারীরা দ্বিধা করল। বুঝতে পারল, আর তাড়া করে লাভ নেই। গাড়িতে বসল দুজনে। ইঞ্জিন চালু করেই রেখেছে ড্রাইভার। ওরা উঠে বসতেই গাড়ি ছেড়ে দিল।
পুরো ঘটনাটা ঘটতে মিনিটখানেকের বেশি লাগল না। আশেপাশে আর দ্বিতীয় কোন লোক নেই যে দেখবে। গোয়েন্দাদের চোখের সামনে নির্বিবাদে একজন ফাদার ক্রিস্টমাসকে কিডন্যাপ করে নিয়ে চলে গেল ওরা।
দুই হাতে চেপে ধরে আছে কিশোর টিটুর চোয়াল।
চিৎকার করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে কুকুরটা।
গাড়ি চত্বর থেকে বেড়িয়প যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়া দিয়ে কিশোরের হাত থেকে মুখ ছুটিয়ে নিল টিটু।
হউ! হউ! হউ। হউ! টানাটানি করে শিকল ছুটানোর চেষ্টা করছে। পাকা চত্বরে তার নখ ঘষা লাগার শব্দ হচ্ছে।
থাম, টিটু! চুপ কর! শান্ত হ! তুই গিয়ে আর এখন কিছু করতে পারবিনে!
কোনমতেই ছাড়ল না ওকে কিশোর। তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল মুসা আর বব। অবশেষে শান্ত হলো টিটু।
ঘটনাটা নিয়ে আলোচনার সুযোগ পেল গোয়েন্দারা।
কোথায় নিয়ে গেল লোকটাকে? মুসার প্রশ্ন।
লোকটা কে? রবিন জানতে চাইল।
কিন্তু কেউ ওদের কথার জবাব দিতে পারল না।
অন্ধকার হয়ে আসছে। চত্বরটা এখনও নির্জন। দুটো ষ্ট্ৰীট ল্যাম্পের আলো পড়ছে রাস্তায়। দিনের আলো পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি বলে উজ্জল হতে পারছে না আলোটা। অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ঠাণ্ডা।
ধস্তাধস্তিটা হয়েছে যে জায়গায়, সেখানে এসে দাঁড়াল গোয়েন্দারা। ফাদার ক্রিস্টমাসের একটা লাল-সাদা পোশাক পড়ে থাকতে দেখল ফারিহা পানি নিষ্কাশনের ড্রেনের মধ্যে। বাতাসে উড়ছে তুলোর তৈরি সাদা লম্বা দাড়ি। তুলে নিল সে।
ডলির দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাচ্ছে। শীতে না যতটা, তারচেয়ে বেশি ভয়ে।