একমত হয়ে মাথা নাড়াল সবাই।
ভেতরে কি আছে দেখা দরকার, মুসা বলল তখন।
কি করে? ডলির প্রশ্ন।
অবশ্যই একটাকে কেটে ফেলে। জবাব দিল রবিন।
ওহ, মাথা নাড়ল কিশোর, একটা নয়, দুটোকে। বেশির ভাগ মুদ্ৰাই যেহেতু
চোদ্দ গ্রাম ওগুলোকেই স্বাভাবিক ধরব আমরা। স্বাভাবিক একটাকে কাটব প্রথমে, তারপর হালকা একটাকে। দুটোর তুলনা করতে পারব তাহলে।
মুহূর্ত দেরি না করে দেয়ালের ছকে ঝোলানো একটা লোহাকাটা করাত খুলে নিয়ে এল সে। আরও বেশ কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ঝোলানো রয়েছে ওখানে।
ওগুলো রাখার সময় কিশোর বলেছিল, কোনটা যে কখন দরকার হয়ে যাবে, কেউ বলতে পারে না। সে-জন্যেই রাখলাম।
প্রথমে ভারীটা কেটে দেখা যাক, বব বলল।
ভাইসে আটকে নেয়া উচিত না? রবিন বলল। ধাতব জিনিস। হাত দিয়ে
ধরে কাটা বিপজ্জনক হয়ে যাবে।
ভাইসও একটা আছে। কোন অসুবিধে নেই। রীতিমত একটা ওঅর্কশপ এই ছাউনিটা। চোদ্দ গ্রামের একটা মুদ্রা ভাইসে আটকে নিয়ে কাটা শুরু করল কিশোর।
জোরাল ঘ্যাচর ঘ্যাচর আওয়াজ। ঘুমিয়ে পড়েছিল টিটু। চমকে একটা কান
খাড়া করে ফেলল। কিন্তু চোখ মেলল না সে। খাওয়ার আগে আর মেলবে বলেও মনে হয় না।
অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে বাকি সবাই। কিশোরের হাতের দিকে তাকিয়ে
আছে।
মিনিটের পর মিনিট পার হয়ে যাচ্ছে। কাটা আর শেষ হয় না।
করাতের দাতের ঘষায় ধোয়ার মত উড়ছে ধাতুর সূক্ষ্ম কণা।
শেষ হয়ে এসেছে, তাই না? তর সইছে না আর রবিনের।
হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে মুদ্রাটা দুই টুকরো হয়ে একটা টুকরো মাটিতে।
পড়ে ঠন করে উঠল।
যাক, হলো শেষ পর্যন্ত! উত্তেজিত ভঙ্গিতে মাটি থেকে টুকরোটা তুলে নিয়ে দেখতে লাগল কিশোর। তারপর বাড়িয়ে দিল রবিনের দিকে। হাতে হাতে ঘুরতে থাকল ওটা। সবাই দেখল। করাতে কাটা সমান, মসৃণ ধারটায় আভুল বোলাল ডলি।
কিশোর, কি বোঝা যাচ্ছে এতে? আমার তো মনে হচ্ছে খামোকা কাটা হলো, মাঝাখান থেকে পঞ্চাশ পেন্স গরীব হয়ে গেলাম আমি।
একটু ধৈর্য ধরো, মুসা বলল, বাকিটারও একই গতি করা যাক। তারপর বোঝা যাবে লাভটা কি হলো। কি বলো কিশোর?
মাথা ঝাকাল কেবল কিশোর।
নিজের দুটো মুদ্রার মধ্যে হালকা মুদ্রাটা বের করে ডলিকে দেখাল রবিন।
এই যে, তোমার মত আমিও পঞ্চাশ পেন্স গরীব হতে চলেছি। মুদ্রাটা নিজেই ভাইসে লাগিয়ে কাটা শুরু করে দিল সে।
এবার আর আগেরটা কাটার মত এত শব্দ হলো না, কাটাও অত কঠিন হলো না। যে রকম তাড়াতাড়ি কেটে ফেলছ, ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে মুসা, মনে হচ্ছে ধাতুটাই নরম, তাই না?
মাথা ঝাকাল রবিন। কোন সন্দেহ নেই তাতে। আগেরটার চেয়ে অনেক
তাড়াতাড়ি এটা কেটে ফেলল রবিন। কিশোর যেটা কেটেছে তার অর্ধেক সময়
লাগল।
ভাইসে আটকানো টুকরোটার দিকে এক নজর তাকিয়েই চিৎকার করে উঠল,
দেখো, ধাতুর দুটো স্তর!
হাঁ, তাই তো, মাটিতে পড়ে যাওয়া টুকরোটা তুলে নিয়ে বলল অনিতা।
বাইরের আস্তরটা একেবারে পাতলা। ভেতরেরটা পুরু, তবে অন্য রকম, কালো
রঙের।
হালকা, সস্তা কোন ধাতু দিয়ে তৈরি, গম্ভীর মুখে কিশোর বলল।
কেন, সস্তা কেন? প্রশ্ন করল ফারিহা।
কারণ, এই মুদ্রাগুলো জাল! জবাব দিল কিশোর। আসল মুদ্রার মত দামী
ধাতু দিয়ে তৈরি করে জালিয়াতদের কোন লাভ নেই, সেজন্যে সস্তা ধাতু ব্যবহার করে।
জালিয়াত স্তদ্ধ হয়ে গেল ডলি। কিন্তু আমার কয়েনটা জাল হতেই পারে
না। নিজের হাতের হালকা মুদ্রাটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল সে, আমার আপা এটা দিয়েছে আমাকে।
তোমার আপার কোন দোষ নেই, ডলি, তাকে বোঝাল রবিন। এটা তো
আর তিনি নিজে বানাননি। অন্য কেউ তাকে দিয়েছে। যে দিয়েছে সে আবার
কারও কাছ থেকে পেয়েছে, সেই জন আবার অন্য কারও কাছ থেকে-এ ভাবেই। হাত বদল হতে থাকে কয়েন। আমার প্রশ্ন, প্রথম কার হাত থেকে বেরোল এটা?
হ্যাঁ, ঠিক আমারও প্রশ্ন সেটা, উত্তজিত স্বরে কিশোর বলল। এবং
প্রশ্নটার জবাব খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। রবিন আর ডলির প্রথম কাজ
হলো এখন মুদ্রা দুটো কার কার হাত ঘুরে এসেছে যতটা সম্ভব সেটা জানার চেষ্টা করা। আমরাও ঘুরে ঘুরে খোজ-খবর নিয়ে দেখব কিছু জানা যায় কিনা।
আপাতত এটাই আমাদের প্রথম কাজ।
মীটিং শেষ হলো। ছাউনি থেকে বাগানে বেরিয়ে এল সবাই। চারটেও
বাজেনি, কিন্তু এখনই দিনের আলো মুছে যেতে আরম্ভ করেছে। ধূসর আকাশটা যেন অনেক নিচে নেমে এসে খুলে রয়েছে। তুষার পড়া শুরু হবে মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ, পড়বে, কিশোর বলল।
সাইকেলে চেপে সবার উদ্দেশে হাত নেড়ে চলে গেল বব।
একে একে সবাই চলে গেল বিদায় নিয়ে। বাগানের গেটটা লাগিয়ে দিল
কিশোর। রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আনমনে নিচের ঠোঁটে চিমটি
কাটল একবার সে। বিড়বিড় করে বলল, মনে হচ্ছে রহস্য আরেকটা পেয়ে গেলাম!
বাড়ি ফিরে সোজা মার দিকে এগিয়ে গেল রবিন। আগের দিন যে যুদ্রাটা তাকে দিয়েছেন তিনি, সেটার কথা জিজ্ঞেস করার জন্যে। কার কাছ থেকে নিয়েছেন, বলতে পারলেন না। তবে তার আগের দিন কোন কোন দোকানে জিনিস কিনতে গিয়েছিলেন, সেটা মনে করতে পারলেন। যত্ন করে নোটবুকে তালিকাটা লিখে নিল রবিন।
ডলিও একই কাজ করল। তার বড় বোনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল গত
চব্বিশ ঘণ্টায় কোথায় কোথায় গিয়েছিল। ডলির বড় বোন জানাল, পাশের শহরটাতে হেয়ারড্রেসারের দোকানে গিয়েছিল চুল ঠিক করতে। তারপর গিয়েছিল একটা পোশাকের দোকান আর কেমিস্টের দোকানে। গায়ে ফিরে যায় পোস্ট অফিসে, সেখান থেকে মুদীর দোকান আর বেকারিতে।