অবশেষে সেই জায়গাটায় পৌঁছে গেল গোয়েন্দারা, যেখানে ডগলাসের ফার্মটা পাওয়া যাওয়ার কথা। একপাশে খোলা মাঠ, আরেক পাশে বন। বন আর মাঠের মাঝখান দিয়ে রাস্তা চলে যাওয়ার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে।
মেঘে ভারী হয়ে আছে আকাশ। সীসার মত রঙ। দিনের আলোটাও কেমন বিচিত্র। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা তুষারের কারণে। শামুকের গতিতে তুষার সাফ করতে করতে চলেছে তুষার কাটার যন্ত্রটা। সোজা চলে যাচ্ছে। পাশের গলিপথে নামার কোন ইচ্ছে নেই।
খোলা মাঠে অনেক বেশি পুরু হয়ে পড়েছে তুষার। তার মধ্যে সাইকেল।
নামানোর চেষ্টা করল মুসা। মুহূর্তে অর্ধেক চাকা দেবে গেল। মজা করার জন্য তার মধ্যেই প্যাডাল করে সাইকেল চালানোর চেষ্টা করল সে। কিন্তু গেল কাত হয়ে তুষারের মধ্যে পড়ে। সবাই হাসতে লাগল। উঠে দাঁড়িয়ে কাপড় থেকে তুষার ঝেড়ে ফেলল মুসা।
সাইকেল থেকে নেমে পড়ল কিশোর। একটা গাছের নিচে রেখে, সৰাইকে রাখুতে বলল। মুসার অবস্থা দেখেই বোঝা গেছে, গলিপথে সাইকেল চালানো কঠিন ব্যাপার হবে।
গাছের নিচে থাকলে অন্তত ভিজবে না সাইকেলগুলো। আকাশের দিকে তাকাল কিশোর। চেহারা দেখেছ? আবার শুরু হবে তুষারপাত।
তার কথা শেষ হতে না হতেই এক কণা তুষার এসে পড়ল নাকের ডগায়।
চলো, যাওয়া যাক! হাটতে শুরু করল সে।তুষার মাড়িয়ে হাটতে লাগল ওরা। রাস্তার চিহ্নও চোখে পড়ছে না। গাছের ডালপালা সব নুয়ে পড়েছে তুষারের ভারে। নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় ওদের মাথায় খসে পড়ে, শব্দ করে ভেঙে ছিটকে যাচ্ছে চতুর্দিকে। দেখতে দেখতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত সাদা পাউডারের মত তুষারে সাদা হয়ে গেল ফারিহা।
আজকে আর কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না। খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার সামিল! ডলি বলল। সবার পেছনে পড়ে গেছে সে। ক্লান্তি আর ঠাণ্ডায় কাহিল।
আরে এত তাড়াতাড়িই হতাশ হয়ে যাচ্ছ কেন? বব বলল। কি ঘটবে।
আগে থেকে কেউ বলতে পারে না। ফার্মটা পাবই আমরা।
ডলিকে উৎসাহ জোগানোর চেষ্টা করলেও কথাটা নিজেই বিশ্বাস করতে পারল না বব।
কিন্তু কিশোর সহজে দমার পাত্র নয়। এগিয়েই চলল সে ঘন হয়ে পড়ছে এখন তুষার। সীমিত করে দিচ্ছে দৃষ্টিশক্তি। সামনে কয়েক হাতের বেশি নজরে আসছে না। সেজন্যেই গাড়িটাকে দেখার অনেক আগেই ওটার ইঞ্জিনের শব্দ কানে এল ওদের।
খাইছে! বলে উঠল মুসা। এ রাস্তা দিয়েই আসছে মনে হচ্ছে? মিছিলের আগে আগে হাটছে সে। আমাদের দিকেই আসছে!
জলদি লুকাও! সাবধান করে দিল কিশোর, গাড়িতে যে-ই থাক, আমাদেরকে তার দেখে ফেলা চলবে না।
সবাই একমত হলো তার সঙ্গে। ওদের মনে হতে লাগল গাড়িটার মধ্যে বিপদ রয়েছে। কিন্তু কেন, সে-প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না কেউ। তুষারের মধ্যে দিয়ে যত দ্রুত পারল, দৌড়ে ঢুকে পড়ল আবার জঙ্গলে। গাছের নিচে ঘাপটি মেরে বসে রইল। বাড়ছে ইঞ্জিনের শব্দ।
অবাক কাণ্ড! মুসা বলল। আসার পথে চাকার দাগ তো কোথাও দেখলাম না।আর এ রাস্তাটা থেকে অন্য কোন দিকে কোন রাস্তা বেরোয়নি।সোজা চলে গেছে-ডগলাস ফার্মই হোক, বা অন্য যে কোনখানেই হোক।
নজরে এল গাড়িটা। বড় কাল একটা গাড়ি। একজন আরোহীকে দেখেই চিনে ফেলল অনিতা গাছের গোঁড়া আরও সেঁটে গেল। লোকটার চোখে পড়তে চায় না।
তুষারের জন্যে ধীরে চলতে বাধ্য হচ্ছে গাড়িটা। চলে গেল পাশ দিয়ে।
ধরা পড়ার ভয়ে তুষারের মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে থাকল গোয়েন্দারা। টিটুর মুখ চেপে ধরে রাখল কিশোর, যাতে শব্দ করতে না পারে। ইঞ্জিনের শব্দ পুরোপুরি মিলিয়ে যাবার পর খুব সাবধানে মাথা তুলল।
গেছে!উঠে দাঁড়াল সে। দেখলে? কাল যে তিনজনকে দেখেছিলাম, ওরাই গেল কোথায়? ফারিহার প্রশ্ন।
নিশ্চয় হেনরির দোকানে, একসঙ্গে বলে উঠল বব আর অনিতা।
সর্বনাশ! আঁতকে উঠল ডলি। রবিন আছে না ওখানে।
আছেই তো! অত ভয় পাবার কিছু নেই! কিশোর বলল। এ সব কাজে নতুন নয় সে। নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা তার আছে। আমাদের কাজ আমরা করতে থাকি। ফার্মে গিয়ে জালিয়াতদের গোপন আস্তানা খুঁজে বের করা দরকার।
টনিকেও উদ্ধার করে আনতে হবে।
হ্যাঁ, একমত হয়ে মাথা দোলাল মুসা। ওদের এই শয়তানি খেলা যত তাড়াতাড়ি পারা যায় বন্ধ করা দরকার।
তারমানে বলতে চাইছ কিশোরের দিকে তাকাল বব, ডগলাস ফার্মের দিক থেকেই ওরা এসেছে?
মাথা ঝাকাল কিশোর।
এবং তারমানে, অনিতা বলল, গাড়ির চাকার দাগ অনুসরণ করে গেলেই পেয়ে যাব ফার্ম হাউসটা? কপালটা খুলতে আরম্ভ করেছে মনে হয়!
কিন্তু আমাদের পায়ের ছাপের কি হবে? মনে করিয়ে দিল ফারিহা। ওদের চোখে পড়ে যাবে না সেগুলো?
তা তো পড়তেই পারে, জবাব দিল মুসা। কিন্তু যে হারে তুষার পড়ছে, দেখতে দেখতে ঢেকে যাবে। তা ছাড়া গাড়ি চালানোর সময় সর্বক্ষণ ওয়াইপার চালাতে হয়। সামনে হাতি দাঁড়িয়ে থাকলেও এর মধ্যে দিয়ে দেখাটা কঠিন। তাছাড়া দাগ থাকতে পারে সন্দেহ করলে তবে তো দেখার চেষ্টা করবে।
হ্যাঁ, একমত হয়ে মাথা দোলাল কিশোর। হয়তো তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু সাবধানের মার নেই। সুতরাং কোন রকম ঝুকি নিতে আমি নারাজ। রাস্তা ছেড়ে এখন থেকে বনের ভেতর দিয়েই এগোব।
যাত্রা শুরুর ইঙ্গিত পেয়ে লাফ দিয়ে গিয়ে আবার টবোগানে চড়ল টিটু। তাকে টেনে নেয়ার পালা এখন ববের। বনের ভেতর দিয়ে চলতে রাস্তার চেয়ে খাটনি কম লাগল। তুষার কম। গাছপালা থাকায় রাস্তার মত পুরু হয়ে পড়তে পারেনি। প্রায় মাইল দেড়েক এগোনোর পর খামারবাড়িটার চালা চোখে পড়ল ওদের।