‘কী রকম? আজ শনিবার, ব্যস্ততা বেশি, তাই সাধারণ কাপড়চোপড় পরেছেন।’
‘আমি তাঁর পোশাকের কথা বলছি না। চামড়ার রঙ এমন কেন? মনে হয় যেন এই পৃথিবীর মানুষ নন, অন্য গ্যালাক্সি থেকে এসেছেন!’
আমার দিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকাল মহিলা। ‘বেশি বেশি সাইন্স ফিকশন সিনেমা দেখো তুমি, তাই না? সেজন্যই মানুষকে ভিনগ্রহের মানুষ কল্পনা করো। আমি তো তাঁর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখলাম না।’
একজন কাস্টোমার ঢুকল দোকানে। আমাকে মহিলা বলল, ‘তোমার কাজ তো শেষ, এখন তুমি যেতে পারো। হ্যাঁ, শোনো, বাড়ি গিয়ে মাকে বলো, তাড়াতাড়ি যেন ভাল সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যান। কিংবা চোখের ডাক্তারও দেখাতে পারো। আমাদের এখানেও ডাক্তার বসেন, তাঁকেও দেখাতে পারো। চোখ খারাপ হলেও উল্টোপাল্টা দেখবে।’ তারপর হেসে স্বাগত জানাল নতুন কাস্টোমারকে।
ঘুরে দরজার দিকে রওনা হলাম।
বাইরে এসে চারপাশে তাকালাম। সব কিছুই খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। কিন্তু খটকাটা গেল না আমার। বার বার মনে হচ্ছে, কিছু একটা ঘটছে এই শপিং মলকে ঘিরে।
চশমা নিয়েছি। এখন প্রেশার কুকারের ওয়াশার কিনতে হবে। তারপর নিনার পুতুল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেনাকাটাগুলো সেরে পালাতে হবে এখান থেকে।
প্রেশার কুকারের দোকানটা চারতলায়। আবার এসকেলেটরে চড়লাম। দুইবার এসকেলেটর বদলে চারতলায় পৌছলাম। প্রেশার কুকারের দোকানে ঢুকলাম। সেলসম্যানকে প্রেশার কুকারের ওয়াশার দিতে বললাম।
সেলসম্যান একজন তরুণ। ওয়াশার এনে দিল। এই লোকটাও রেজিস্টারে বিল লিখতে লাগল। রেজিস্টারটা দেখতে পাচ্ছি। যেখানে সংখ্যাগুলো লেখা হয়, তা-ও চোখে পড়ছে।
তাকিয়ে আছি। আমার চোখের সামনে ক্যাশ রেজিস্টারটা একটা চেহারায় রূপ নিতে শুরু করল। মুখ, চোখ, দাঁত। মাথায় বড় বড় সবুজ লোম গজাচ্ছে। লিখে চলেছে সেলসম্যান। রেজিস্টারের পরিবর্তনটা যেন চোখেই পড়ছে না ওর!
রেজিস্টারটা নড়ছে, জ্যান্ত প্রাণীর মত। তারপর হাসতে লাগল। আমার বহুবার শোনা সেই অট্টহাসি।
এই সময় আমার পিছন থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠল, ‘জোসেফ, কেমন আছো?’
‘আরে, স্কারপিনি, কী খবর?’ তরুণ সেলসম্যান জিজ্ঞেস করল।
ফিরে তাকালাম। দরজায় দাঁড়ানো লোকটাকে দেখে চমকে উঠলাম। সেই লোকটা, শপিং মলের মেকানিক, যার বুকে ট্যাগে লেখা রয়েছে হিরাম স্কারপিনি। কাল আমাকে এসকেলেটর থেকে নামিয়ে দিয়েছিল।
লেখা শেষ করে আমার কাছ থেকে বেল্টের দাম নিল জোসেফ। ওয়াশারটা প্যাকেট করে দিল
আবার তাকালাম হিরাম স্কারপিনির দিকে। এখনও দরজায় দাঁড়িয়ে আছে আমার দিকে তাকিয়ে। ঠোঁটে পাতলা এক চিলতে অদ্ভুত হাসি, আন্তরিক নয় মোটেও। ফিরে তাকালাম ক্যাশ রেজিস্টারটার দিকে। আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে ওটা, সবুজ মুখটা গায়েব।
বেল্টের প্যাকেটটা নিয়ে পা বাড়ালাম দরজার দিকে। হিরাম স্কারপিনির পাশ দিয়ে বেরোনোর সময় ওর হাসি শুনলাম। জোরাল সেই অট্টহাসি!
এগারো
নিনার পুতুল কেনা বাকি এখনও। ওটা কিনে আর এক মুহূর্ত দাঁড়াব না। সোজা বেরিয়ে যাব এই শপিং মল থেকে। কোনদিন কোনও কারণেই আর ফিরে আসব না এখানে। কিশোর আর মুসাকে বলে যাব, আমার মাথা ধরেছে, বাড়ি চলে যাচ্ছি, ওদের সঙ্গে লাঞ্চ খেতে পারব না। একবার গেটের বাইরে বেরোতে পারলেই হয়—নিজেকে বললাম—স্কেট পরে এমন ছোটা ছুটব, পিছন ফিরে তাকাব না আর।
আবার এসকেলেটরে চড়লাম। উঠে এলাম পঞ্চম তলায়। গ্রেগ জনসনের দোকানে ঢুকলাম। ভয় পাচ্ছি। ‘এইচ’ ফ্লোরে ওকেই কি দেখেছিলাম? পুতুলের দোকানের ছোটখাট এই টাকমাথা মানুষটিই কি নীচতলায় দানবে পরিণত হয়েছিল? নাকি পুরো ব্যাপারটাই আমার কল্পনা?
কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন মহিলা। দোকানে গ্রেগ জনসনকে না দেখে তিনি কোথায় জিজ্ঞেস করলাম। মহিলা জানাল, হঠাৎ করেই মিস্টার জনসন অসুস্থ হয়ে পড়ায় দোকানে আসতে পারেননি। আমার কী চাই, জিজ্ঞেস করল।
‘আমি একটা এভিয়েটর ডল চাই,’ মহিলাকে বললাম। ‘কাল এসেছিলাম, পাইনি। মিস্টার জনসন আজ দুপুরে আসতে বলেছেন। আজ নাকি পুতুল আসবে।’
হাসিমুখে মহিলা বলল, ‘এসেছে তো।’
পিছনের দরজা দিয়ে ভিতরের ঘরে চলে গেল ও। ফিরে এল হাতে একটা বাক্স নিয়ে।
‘আজ আমার কাজিনের জন্মদিন,’ মহিলাকে বললাম। ‘উপহার দেব। রঙিন কাগজ দিয়ে প্যাক করে দিলে ভাল হয়।’
‘নিশ্চয়ই,’ মহিলা বলল।
ঠিক এ সময় অতিরিক্ত উজ্জ্বল হয়ে গেল দোকানের আলো। কয়েক মুহূর্ত পর আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল।
‘বাতির আলো এত বাড়ল কেন?’ ভীত চোখে চারপাশে তাকাতে লাগলাম।
‘ও কিছু না, ভোল্টেজ বেড়ে গিয়েছিল,’ মহিলা বলল। ‘শপিং মলের ইলেকট্রিশিয়ান বলেছে ওয়্যারিঙে নাকি গোলমাল হয়েছে। সেটা ঠিক করছে। বলেছে, মেরামতের সময় মাঝে মাঝে এ রকম হতে পারে।’
রঙিন কাগজ দিয়ে পুতুলের বাক্সটা সুন্দর করে মুড়ে দিল ও।
‘কী, আলোর সমস্যা নেই তো আর?’ সামনের দরজার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করল একটা কণ্ঠ। পরিচিত মনে হওয়ায় ফিরে তাকালাম। মেকানিক হিরাম স্কারপিনি।
‘না, নেই,’ মহিলা জবাব দিল। ‘হঠাৎ আলো কিছুটা বেড়ে গিয়েছিল, তারপর ঠিক হয়ে গেছে।’
মাথা ঝাঁকিয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে হাসল স্কারপিনি, সেই অদ্ভুত হাসি। পুতুলের বাক্সটা নিয়ে তাড়াতাড়ি ওর পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম।