‘ভালই হয়েছে,’ মুসা বলল। ‘লাইনে দাঁড়াতে হলো না। সেন্টারে তো লাইন ছাড়া কথা নেই।’ আবার জিজ্ঞেস করল আমাকে, ‘কী দেখাবে, বলো তো?’
‘একটু অপেক্ষা করো, দেখতেই পাবে,’ আবারও একই জবাব দিলাম।
এলিভেটর এল। দরজা খুলে গেল।
শূন্য এলিভেটর। একজন লোকও নেই ভিতরে।
মুসা বলল, ‘আশ্চর্য! এখানে কি সবাই এসকেলেটরে চড়ে? এলিভেটরে কেউ ওঠে না?’
মুচকি হেসে বললাম, ‘আশ্চর্যের এখনই দেখেছ কী। আরও কত কিছু বাকি।
কিশোর ও মুসাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। আর কেউ উঠল না। শুধু আমরা তিনজন।
দরজাটা লেগে গেল।
বোতামের সারির কাছে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর।
বললাম, ‘এইচ লেখা বোতামটা টেপো। তাহলেই শুরু হয়ে যাবে খেল।’
‘টিপতে পারলে তো খুশিই হতাম,’ কিশোর জবাব দিল। ‘কিন্তু এইচ লেখা বোতাম কই?’
প্যানেলের দিকে তাকালাম। বোতামের সারিতে ‘এইচ’ লেখা বোতামটা খুঁজছে আমার চোখ।
কিন্তু নেই!
গেল কোথায়?
আশ্চর্য!
নয়
‘বললাম তো, ছিল ওখানে!’ বোতামের সারির ঠিক যেখানটায় বোতামটা ছিল, সেখানে হাত বোলালাম। ‘তোমাদের কী ধারণা, আমি বানিয়ে বলেছি, পুরো ব্যাপারটা আমার কল্পনা?’
‘বানিয়ে গল্প লিখে তুমি ফার্স্ট হয়েছ,’ চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল। ‘সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছ। হয়তো বেশি কল্পনা করতে করতে এমনভাবেই কল্পনার জগতে ঢুকে পড়ো, বাস্তবতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলো। হতে পারে না এরকম?’
জবাব খুঁজে পেলাম না। এলিভেটরের ভিতরের আয়নায় দেখলাম, মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে আমার। রীতিমত একটা গাধা মনে হচ্ছে নিজেকে। কী জবাব দেব, বুঝতে পারছি না।
‘আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ কী?’ মুসা বলল। বোতাম টিপল ও।
খুলে গেল এলিভেটরের দরজা। বেরিয়ে এলাম তিনজনে।
‘আমি আরকেডে যাচ্ছি,’ কিশোর বলল। লাইন হয়তো এখনও তেমন লম্বা হয়নি। তাড়াতাড়িই সুযোগ পেয়ে যাব আবার।’
‘তুমি কী করবে, রবিন?’ আমার মুখচোখের অবস্থা দেখে সহানুভূতির সঙ্গে জিজ্ঞেস করল মুসা।
‘মা কয়েকটা জিনিস নিতে বলে দিয়েছে,’ বোতামটা না পাওয়ায়, বন্ধুদের দেখাতে না পারায় খুব হতাশ লাগছে আমার। ‘সেগুলো কিনতে যাব।’
‘ঠিক আছে, যাও। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে রুবিনা’স হট ডগে চলে এসো,’ কিশোর বলল। ‘ওখানে লাঞ্চ খাব। তারপর প্লে এরিয়ায় গিয়ে রাইডে চড়ব। নতুন কয়েকটা রাইড এসেছে শুনলাম।’
ওরা ফিরে গেল ওদের আরকেডে, আমি রওনা হলাম জিনিসপত্র কিনতে। এবার আর এলিভেটরে চড়লাম না। এসকেলেটরের দিকে এগোলাম। ভাবতে ভাবতে চলেছি। হয়তো কিশোরের কথাই ঠিক। অতি কল্পনা করতে করতে এখন কল্পনার জগতেই বেশির ভাগ সময় ঘুরে বেড়াই আমি। মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছি হয়তো। মাকে বলে একজন ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করার কথাও ভাবলাম। তারপর দুশ্চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে কাজের কথায় মন দিলাম। প্রথমে মা’র চশমাটা নিতে হবে, তারপর প্রেশার কুকারের ওয়াশার, সবশেষে নিনার পুতুল।
দোতলায় ওঠার এসকেলেটরে চড়লাম। চশমার দোকানটা ওখানেই। কোন ঝামেলা করল না এসকেলেটর। নেমে সোজা এসে দোকানে ঢুকে কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালাম।
‘কি লাগবে, বলো?’ জিজ্ঞেস করল কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়ানো মহিলা।
রশিদ বের করে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘চশমার কাঁচ লাগাতে দিয়ে গেছে মা, আজ দেয়ার কথা।’
‘এক মিনিট,’ বলে রশিদটা নিয়ে চলে গেল মহিলা। ফিরে এল ঠিক এক মিনিট পরেই। হাতে একটা ছোট বাক্স। সেটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমি টাকা দিলাম। কিছু ভাঙতি পাব। ক্যাশ রেজিস্টারে লিখতে লাগল মহিলা। কত টাকা বিল হয়েছে, আমি ওকে কত দিয়েছি, কত টাকা ভাঙতি পাব, সব খুঁটিয়ে লিখছে। ভাঙতি টাকার জন্য অপেক্ষা করছি আমি।
‘দেরি হবে?’ আমার পিছন থেকে ধমকে উঠল একটা অধৈর্য কণ্ঠ। ‘আমার তাড়া আছে, সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না।’
‘এক মিনিট, সার,’ মহিলা বলল। ‘এই যে, হয়ে গেছে।’ একটা বাক্স থেকে আমাকে ভাঙতি টাকা বের করে দিল মহিলা। টাকা হাতে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। লোকটার ওপর চোখ পড়তে ← থমকে দাঁড়ালাম। পরনে প্যান্ট, শার্ট, জ্যাকেট। চামড়ার রঙ সবুজ, ঠেলে বেরোনো লাল চোখ, আর দুই কান থেকে বেরিয়ে থাকা বড় বড় লোম!
দশ
একপাশের দেয়ালের দিকে সরে গেলাম। ওখানে শোকেসে সাজানো চশমা দেখার ভান করলাম। আসলে লোকটার ওপর নজর রাখছি। ও কী করে দেখতে চাইছি। দোকানে আমি ছাড়া আর কোন ক্রেতা নেই। শুধু আমরা তিনজন—আমি, ওই মহিলা, আর লোকটা।
কাউন্টারের ওপর একটা চশমা রাখল ও। ঠিকমত নাকে বসে না, তাই ফ্রেমটা ঠিক করে দিতে হবে। ধমক খেয়েও হাসিমুখে কথা বলছে মহিলা, যেন কিছুই হয়নি।
আজব লোকটা বেরিয়ে গেলে কাউন্টারের সামনে ফিরে এলাম। মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘উনি কে?’
আমার দিকে মুখ তুলে তাকাল মহিলা। ‘ও, তুমি এখনও বেরোওনি। ভাঙতি টাকা তো দিয়ে দিলাম, আর কোনও সমস্যা?’
সমস্যা তো বটেই। বিরাট সমস্যা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ ওই ভদ্রলোককে দেখেছেন?’
‘দেখব না কেন? আমাদের কাস্টোমার। মিস্টার ওয়েভারলি। তা ছাড়া এই শপিং মলের মালিকও তিনিই।’
‘এই শপিং মলের মালিক?’ নিজের কানে প্রতিধ্বনির মত শোনাল যেন আমার কথাগুলো। মনে হলো, পা দুটো রবার হয়ে গেছে আমার। হাঁটু ভাঁজ হয়ে আসছে। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। ‘দেখতে কি সব সময়ই ওরকম উনি?’