মাথা ঝাঁকাল মা। তবে আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করল বলে মনে হলো না। এতক্ষণে চোখ পড়ল আমার হাতের দিকে। ‘পুতুল কোথায়?’
এবার কী জবাব দেব? দোকানে আজ পুতুল নেই। দোকানদার বলেছে, আগামীকাল দুপুরে আসবে। কিন্তু সত্যি কথাটা বললে কাল আবার আমাকে শপিং মলে যেতে হবে, জোর করে পাঠাবে মা, অথচ আমি কোনমতেই যেতে চাই না।
‘ওদের কাছে এভিয়েটর ডল নেই,’ জবাব দিলাম। ‘শেষ হয়ে গেছে।’ আগামী দিন আসার কথাটা চেপে গেলাম।
কিন্তু মা এত সহজে ভোলার পাত্র নয়। বলল, ‘শেষ হয়ে গেছে, আসবে। এত চাহিদা যে জিনিসের, সেটা না এনে বসে থাকবে না। কাল দুপুরে গেলেই পেয়ে যাবে, আমি বললাম, দেখো।’
‘কী জানি, হয়তো পাব,’ ভ্রূকুটি করলাম।
আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে মা। ‘রবিন, কিছু হয়েছে নাকি? পুতুলের টাকাটা খরচ করে ফেলেছ? নাকি হারিয়ে ফেলেছ?’
‘না, মা, টাকা আছে,’ বের করে দেখালাম। ‘আসলে, কাল আমি শপিং মলে যেতে চাই না।’
‘কিন্তু যেতে হবে তো,’ মা বলল। পার্স থেকে আরও কিছু টাকা বের করে দিল। ‘এই নাও। পুতুল ছাড়াও আরও দুটো জিনিস আনতে হবে।’
‘কী?’ কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম।
‘ফ্রেডসন’স আই কেয়ার থেকে আমার চশমাটা আনতে হবে। ফ্রেম কিনে কাঁচ লাগাতে দিয়ে এসেছিলাম, কাল ডেলিভারি দেয়ার কথা। আর প্রেশার কুকারের একটা ওয়াশারও আনতে হবে, ওখানকার একটা দোকানে ছাড়া পাওয়া যায় না—অনেক জায়গায় খুঁজেছি।’
আমার হাতে আরও কিছু টাকা দিল মা।
‘মা, এতগুলো কাজ আমাকে দিয়ে করাবে?’
‘এত কাজ কোথায় দেখলে? একটা পুতুল, একটা চশমা, আর একটা ওয়াশার; ভারিও নয়, ছোট একটা ব্যাগের মধ্যেই ধরে যাবে। এত গাঁইগুঁই করছ কেন? শপিং মলে যেতেই বা এত আপত্তি কীসের?’
‘কী জানি, জানি না!’ বিরক্তকণ্ঠে বললাম। ‘হয়তো শপিং মলে যাওয়া, বাজারসদাই, এসব আমার ভাল লাগে না!’
‘ভাল না লাগলেও যেতে হবে,’ মা বলল। ‘অনেক কাজই ভাল লাগে না আমাদের, তা-ও করতে হয়। বাজার করা নিয়ে এত বিরক্ত হলে চলে না। আমি তো সব সময় থাকব না। কখনও না কখনও তোমার নিজের বাজার নিজেকেই করতে হবে।’
বাসনপেয়ালা ধুতে চলে গেল মা। মনে মনে স্থির করলাম, কাল শপিং মলে যদি যেতেই হয় আমাকে, একা যাব না। কিশোর আর মুসাকে সাথে নিয়ে যাব। ওদের অন্তত বোঝাতে হবে, শপিং মল সম্পর্কে আমার ভয়টা অমূলক কিংবা অতিকল্পনা নয়। ‘এইচ’ লেখা বোতাম, খেলনার দোকানের মালিক গ্রেগ জনসনের মত দেখতে দানবটা, কিংবা জ্যান্ত পুতুল কোনটাই আমার কল্পনা নয়।
ওপরতলায় এসে কিশোর আর মুসাকে ফোন করলাম। পরের দিন দুপুরবেলা আমার সঙ্গে শপিং মলে যেতে রাজি হলো দুজনেই। অনেকটা স্বস্তি পেলাম। বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাতের প্রথম দিকটায় ভালই ঘুম হলো। তারপর শুনলাম সেই ভয়ঙ্কর অট্টহাসি!
ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত দুটো বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। হাসিটা থেমে গেছে। নিশ্চয় স্বপ্নে দেখেছি। চোখ বুজলাম। আবার শোনা গেল হাসি। না শোনার ভান করে চোখ বুজে পড়ে রইলাম। লাভ হলো না। থেকে থেকেই শোনা যেতে থাকল অট্টহাসি। মনে হলো, বাইরে বা অন্য কোথাও নয়, আমার মগজের ভিতরেই হেসে চলেছে কেউ।
বাকি রাতটা বিছানায় গড়াগড়ি আর ছটফট করে কাটালাম। বুঝে গেছি, শপিং মল রহস্যের একটা কিনারা না করা পর্যন্ত শান্তি পাব না আমি। ভোরের দিকে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। এবং যথারীতি দুঃস্বপ্ন দেখলাম।
আট
দুপুর ঠিক বারোটায় স্কেটিং করে পৌঁছলাম শপিং মলের প্রধান ফটকের কাছে। আজ শনিবার, তাই প্রচুর ভিড়। একেবারে ঠাসাঠাসি অবস্থা। কেন যে এখানে এত ভিড় করে লোকে, বুঝি না। কোনও জিনিসের দাম তো কম নেয় না। জেনেশুনেও বেশি দাম দিয়ে যেন ঠকতে আসে। যেন পতঙ্গের মত এর আলোর আকর্ষণে ছুটে আসে এই মানুষগুলো।
স্কেট দুটো খুলে নিয়ে ব্যাকপ্যাকে ভরলাম। হেলমেটটা মাথা থেকে নামিয়ে ফিতেয় ঝুলিয়ে রেখে দিলাম। বুকের দিকটায় গলার কাছে ঝুলে রইল ওটা।
ভিতরে ঢুকলাম। গার্ডের পাশ কাটালাম, আগের দিনও এই লোকটাই পাহারায় ছিল। একটা মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থেকে অন্য দিকে চোখ ফেরাল। আরকেড এরিয়ায় কিশোর আর মুসা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সময় কাটানোর জন্য কম্পিউটার গেম খেলছে ওরা।
‘স্পেশাল কী জিনিস দেখাতে এখানে এনেছ আমাদের?’ মুসা জিজ্ঞেস করল। লেজার ম্যান-এর গেমটা সবে শেষ করেছে ও। পয়েন্ট পেয়েছে ১,০০,০০০।
‘নিজের চোখেই দেখো,’ আমি বললাম।
‘এখন এখান থেকে সরলে আর খেলার চান্স পাব না, ফিরে এসে দেখব এক মাইল লম্বা লাইন হয়ে গেছে,’ কিশোর বলল।
‘আমি যা দেখাতে এনেছি, সেটা দেখলে কম্পিউটার গেমের কথা
আর মনে থাকবে না তোমাদের,’ আমি বললাম।
‘কোথায় যেতে হবে?’ মুসা জিজ্ঞেস করল। ‘চলো, এসকেলেটরে করে যাই। এসকেলেটরে চড়তে এলিভেটরের চেয়ে ভাল লাগে আমার।’
‘না, যা দেখাতে চাই, সেটা দেখতে এলিভেটরে করেই যেতে হবে,’ আমি বললাম।
আগের দিন যে এলিভেটরটায় চড়েছিলাম, সেটার কাছে নিয়ে এলাম ওদেরকে। শপিং মলে এত লোকের ভিড়, কিন্তু এলিভেটরের কাছে কেউ নেই। ব্যাপারটা আমার কাছে আগেও অদ্ভুত লেগেছে, বলেছি।