‘এইচ’ বোতামটা টিপেছি আমি। কে, কেন টিপিয়েছে আমাকে দিয়ে, জানি না। গ্রাউণ্ড ফ্লোর পার হয়ে আরও নীচে নামতে লাগল এলিভেটর। ‘বি’ লেখা বোতামটা টিপটিপ করে জ্বলতে-নিভতে শুরু করল। মনে হলো বেযমেন্ট, অর্থাৎ মাটির নীচের ঘরে নেমে যাচ্ছি।
‘জি’ দিয়ে ‘গ্রাউণ্ড’, ‘বি’ দিয়ে ‘বেযমেন্ট’, কিন্তু ‘এইচ’ দিয়ে কী হয়? হঠাৎ কেউ আমার মনের ভিতর যেন ঢুকিয়ে দিল জবাবটা : ‘এইচ’ মানে ‘হোম’। তবে কী অদ্ভুত কোনও উপায়ে এই এলিভেটর দিয়ে ক্রেতাদেরকে ওদের বাড়ি পৌঁছে দেয়া হয়? নাহ্, অসম্ভব! এলিভেটর কখনও কারও বাড়িতে যেতে পারে না।
হঠাৎ করেই এলিভেটরের ভিতরের আলো কমে গেল। গতি কমতে কমতে থেমে গেল এলিভেটর। কিন্তু দরজা খুলল না।
‘এই যে, কেউ আছেন!’ চিৎকার করে ডাকলাম। ‘কেউ শুনছেন?’
সাড়া এল না। দরজা খুলল না। প্রায় অন্ধকার একটা এলিভেটর-কারের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে আছি আমি। বেরোব কী করে এখান থেকে?
হঠাৎই ‘এইচ’ লেখা বোতামটা উজ্জ্বল হয়ে গেল আবার। দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছি। ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে এলিভেটরের দরজা।
হঠাৎ তীব্র আলো ঝাঁপিয়ে এসে পড়ল যেন চোখে। অন্ধ করে দিল আমাকে। দুঃস্বপ্নে দেখা সেই রকম আলো, আজ ভোরেই যা দেখেছি।
‘কে ওখানে?’ কপালে হাত রেখে তীব্র সাদা আলো আড়াল করে চেঁচিয়ে উঠলাম। চলে গেল আলোটা। চারপাশে তাকালাম।
যা দেখছি, সবই অবাস্তব লাগল। মনে হলো, আবার স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। কিন্তু এটা স্বপ্ন নয়, বাস্তব, আমি ভাল করেই জানি। বাস্তবে ঘটছে ঘটনাটা।
বিষণ্ন, একটা ভূতুড়ে বনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি আমি। মস্ত বড় একটা বট গাছের কাছে। এলিভেটরটা দেখতে পাচ্ছি না। পিছন থেকে কর্কশ অট্টহাসি শুনে চমকে গেলাম।
ফিরে তাকালাম। টাকমাথা, বেঁটে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। থ্যাবড়া নাক, কোঁচকানো বুড়োটে চামড়া, নিষ্পলক চোখ। চেনা চেনা লাগছে।
‘আমাদের স্বর্গে স্বাগতম, রবিন,’ বলল আজব মানুষটা।
স্বর্গ! শপিং মলের তৈরি নতুন কোনও থিম পার্ক নাকি এটা? ছোটদের আকষর্ণ করার কৌশল? যেটাই হোক, জায়গাটা ভয় ধরায়, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
‘শুনুন,’ জিজ্ঞেস করলাম লোকটাকে, ‘আমার নাম জানলেন কী করে?’
আবার হেসে উঠল অদ্ভুত লোকটা। আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। একটা বাক্সের দিকে হাত বাড়াল। ‘আমি জানি তুমি পুতুল খুঁজছ।’ বাক্স থেকে বের করে আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘চলবে এটাতে?’
আমার নাকের কাছে ধরে রেখেছে জিনিসটা। ভীষণ কুৎসিত চেহারার একটা পুতুল। হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে উঠল পুতুলটা। আমার দিকে হাত বাড়াল। অট্টহাসি হেসে বলল, ‘স্বাগতম, রবিন।’
পিছিয়ে গেলাম। ধাক্কা খেলাম গাছের গায়ে। পুতুল কথা বলে! জীবনে শুনিনি! তা ছাড়া আমার যে পুতুল দরকার, এই অদ্ভুত লোকটা জানল কী করে? কেন চেনা চেনা লাগছিল লোকটাকে, এতক্ষণে বুঝলাম। ওকে দেখতে অনেকটা ডল এম্পোরিয়ামের মালিক গ্রেগ জনসনের মত লাগছে। দোকানেও ঠিক স্বাভাবিক ছিল না, কিন্তু অনেক বেশি অদ্ভুত আচরণ করছে এখানে।
‘কী হচ্ছে বলুন তো?’ জিজ্ঞেস করলাম। ভয়ে বার বার কাঁটা দিচ্ছে গায়ে। ‘এখানে তো আসতে চাইনি আমি। আমি নামতে চেয়েছিলাম গ্রাউণ্ড ফ্লোরে।’
গ্রেগ জনসনের চেহারার লোকটা এক পা এগোল আমার দিকে। ওর হাতের পুতুলটা হাত থেকে ছুটে গিয়ে শূন্যে লাফিয়ে উঠল। উড়ে এল আমার দিকে।
সমস্বরে কথা বলে উঠল ওই লোক আর পুতুলটা, ‘এই স্বর্গটা তোমার ভাল লাগবে, রবিন। আমাদেরকে তুমি সহযোগিতা করবে। তোমাকে যা করতে বলা হবে তা-ই তুমি করবে!’
‘না!’ চেঁচিয়ে উঠলাম। ঘুরে দৌড় দিয়ে পালাতে চাইলাম। কিন্তু বট গাছটা বাধা হয়ে দাঁড়াল। ওটার মস্ত শিকড়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম।
হঠাৎ গাছের গায়ে দরজা তৈরি হলো। খুলে গেল হাঁ হয়ে। ভিতরে এলিভেটর-কারটা দেখলাম। গ্রেগ জনসনের দানব আর পুতুলটা আমাকে ধরার আগেই লাফ দিয়ে এলিভেটরে উঠে পড়লাম। খালি এলিভেটর, আমি ছাড়া আর কেউ নেই। মৃদু আলো জ্বলছে। ‘ইমার্জেন্সি’ লেখা বোতামটা টিপে দিলাম। কিছুই ঘটল না। তারপর ‘জি’ বোতামটা চোখে পড়ল। মনে মনে খোদাকে ডাকতে ডাকতে আঙুল রাখলাম ওটাতে। টিপে ধরে রাখলাম। ঝাঁকি দিয়ে চলতে শুরু করল এলিভেটর।
সাত
এলিভেটরের দরজা খুলে যেতেই একটা মুহূর্ত দেরি না করে লাফিয়ে পড়লাম বাইরে। শপিং মলে লোকের ভিড়। এটা আরেক আশ্চর্য! কখনও দেখছি, মানুষজন কেউ নেই, আমি একা। আবার কখনও প্রচুর লোকজন। কোনটা স্বাভাবিক?
বেশি ভাবার সময় নেই। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে হবে এখান থেকে। নতুন বিপদ হাজির হবার আগেই। সোজা দৌড় দিলাম গেটের দিকে। বাইরে এসে স্কেট দুটো বের করে দ্রুত পরে ফেললাম। ছুটলাম বাড়ির দিকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি পৌঁছে স্বস্তি পেতে চাই।
বাড়ি ফিরে দেখি রাতের খাওয়া প্রায় শেষ করে এনেছে মা, বাবা ও নিনা।
‘এত দেরি করলে যে?’ মা জিজ্ঞেস করল। ‘আমার তো দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। জলদি হাতমুখ ধুয়ে এসো। খাবার এখনও গরম আছে। বেড়ে দিই।’
কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না আমার। বললাম, ‘আমি খেয়ে এসেছি, মা।’
আমার দিকে তাকিয়ে আছে মা। ‘খেয়েছ? কোথায়?’
‘শপিং মলে হট ডগ খেয়েছি। পেট ভর্তি হয়ে আছে।’