আমার দিকে এমন করে তাকিয়ে আছে লোকটা, যেন আমি একটা আজব প্রাণী। নিশ্চয় গেঁয়ো ভূত ভাবছে আমাকে। হয়তো ভাবছে, এসকেলেটরে চড়তেও জানি না আমি।
ফিরে তাকালাম এসকেলেটরটার দিকে। চলছে ওটা। স্বাভাবিক গতিতে।
মাথা ঝাড়া দিলাম। ফিরে তাকালাম দোকানের কাঁচের ভিতর দিয়ে। লোকটাকে দেখলাম না। দোকানের সাইনবোর্ডের ওপর চোখ পড়ল। লেখা রয়েছে : ডল এম্পোরিয়াম। হয়তো ওই লোকটাই গ্রেগ জনসন, অবাক দৃষ্টিতে যে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।
লম্বা দম নিলাম। ঢুকে পড়লাম দোকানে। আমি ছাড়া আর দুজন ক্রেতা আছে। একজন মহিলা, সঙ্গে ছোট একটা ছেলে। নতুন কোনও কম্পিউটার গেম এসেছে কি না খোঁজ নিচ্ছেন। আর বছর পনেরো বয়েসের এক কিশোরী গানের সিডি বাছাই করছে।
পুতুল রাখা হয় যেখানে, সেদিকে তাকালাম। হঠাৎ পিছন থেকে কথা শোনা গেল, ‘পুতুল লাগবে, ইয়াং ম্যান?’
চমকে গিয়ে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। সেই লোকটাই, সেই টাকমাথা। শার্টের বুকপকেটে একটা ধাতব চৌকোনা প্ল্যাস্টিকের ট্যাগ লাগানো, তাতে লেখা : গ্রেগ জনসন, দোকান মালিক। বুকে এভাবে নিজের নাম-পরিচয় লেখা ট্যাগ ঝোলানো এই শপিং মলের নিয়ম। লোকটার দু’চোখের শাণিত দৃষ্টি চিরে ঢুকে যাচ্ছে যেন আমার মগজে। এবং যতক্ষণ তাকিয়ে রইলাম, একটিবারের জন্য চোখের পলক ফেলতে দেখলাম না লোকটাকে।
‘হ্যাঁ,’ জবাব দিলাম। ‘একটা সুপার কিড এভিয়েটর ডল কিনতে এসেছি।’
আমার ওপর থেকে চোখ সরাচ্ছে না লোকটা। ‘কেন, পুতুল তোমার খুব পছন্দ নাকি? পুতুল জমাও?’ কথা বলার সময় মুখের ভাবের কোন পরিবর্তন হলো না ওর।
‘না, আমার বোন জমায়। আগামীকাল ওর জন্মদিন। ওকে একটা পুতুল উপহার দিতে চাই।’
‘ও। তবে তোমার জন্য খারাপ-ভাল দুরকম খবরই আছে, লোকটা বলল। ‘খারাপ খবরটা হলো, আজ আমাদের স্টকে একটা এভিয়েটর ডলও নেই। আর ভাল খবরটা হলো, কাল অনেকগুলো পুতুল আসছে, অর্ডার দিয়ে রেখেছিলাম। কাল দুপুর নাগাদ এলে পেয়ে যাবে।’
এই ভয়ানক শপিং মলে কাল আবার আসতে হবে শুনে দমে গেলাম। জবাব না দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম দরজার দিকে। বেরোনোর আগে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, একভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা। দোকান থেকে বেরিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। মনে হলো, গ্রেগ জনসন আর ওর দোকানে অদ্ভুত কিছু একটা রয়েছে।
এবার আর ওপরে ওঠার এসকেলেটরটার দিকে না গিয়ে নীচে নামে যেটা, সেটার দিকে এগোলাম। বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে আছি। প্রায় ছ’টা বাজে। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমার বয়েসী যারা, স্কুলে পড়ে, কখন বাড়ি চলে গেছে, এতক্ষণে রাতের খাবার খেতে বসেও গেছে নিশ্চয় কেউ কেউ।
এসকেলেটরের কাছে এসে থামলাম। পা রাখার আগে ভাল করে দেখে নিলাম। স্বাভাবিক গতিতে চলছে। কিন্তু আমি পা রাখতেই আমচকা ঝাঁকি দিয়ে থেমে গেল।
‘এসকেলেটর নষ্ট হয়ে গেছে, আপাতত আর চলবে না,’ পিছন থেকে বলল একটা কণ্ঠ। ফিরে তাকালাম। কথা বলল যে লোকটা, ওকে কোথায় যেন দেখেছি। হয়তো আমার কোনও দুঃস্বপ্নে। বড় বড় ধারাল শ্বদন্ত নেই বটে ওর, ঠেলে বেরোনো বড় বড় চোখ, সবুজ চামড়া, কিংবা গা ভর্তি লোমও নেই—কিন্তু চেহারাটা অবিকল আমার স্বপ্নে দেখা শপিং মলের দানবটার মত লাগছে।
গায়ে শপিং মলের ইউনিফর্ম, বুকের কাছে ট্যাগ ঝোলানো। তাতে লেখা : হিরাম স্কারপিনি, মেকানিক, ওয়েভারলি মল।
ওর পরিষ্কার টলটলে চোখ আমাকে দেখছে। এক পা পিছিয়ে গেলাম। যে ব্যাপারটা বেশি অবাক করল, তা হলো খেলনার দোকানের মালিকের মতই এই লোকটার চোখেও পলক পড়ছে না। ‘এলিভেটরে চড়ে নীচে যেতে হবে তোমাকে।’
‘ঠিক আছে,’ বলে এসকেলেটর থেকে উঠে এলাম ল্যাণ্ডিং-এ।
ঘুরে দাঁড়াল লোকটা। আমার দিকে পিছন ফিরে একটা টুল বক্সের ওপর ঝুঁকল। সেটা থেকে একটা রেঞ্চ বের করল। ‘যাও, সাবধানে যেয়ো।’ আমাকে বলল ও। আমার দিকে তাকাল না। হাসল। শিউরে উঠলাম। দুঃস্বপ্নের সেই অদ্ভুত হাসি!
বারান্দা ধরে এগোলাম। এলিভেটরটা রয়েছে আরেক মাথায়। তাড়াহুড়া করে হেঁটে চললাম। শপিং মলের এই ফ্লোরে এখন আমি ছাড়া আর কোন কাস্টোমার নেই। অন্য সময় হলে অবাক লাগত, এত তাড়াতাড়ি সবাই শপিং মল থেকে চলে গেল? কিন্তু এখন বাড়ি ফেরা নিয়ে এত বেশি অস্থির আমি, ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না।
এলিভেটরের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। এলিভেটর আসার বোতাম টিপলাম। দশ সেকেণ্ড অপেক্ষা করার পর দরজা খুলল। কেউ নামল না। শূন্য এলিভেটর।
আমি একা এলিভেটরে চড়লাম।
বোর্ডের বোতামের সারির দিকে তাকালাম। সবচেয়ে নীচের বোতামটার নীচে লেখা ‘জি’। তারমানে, ‘গ্রাউণ্ড’।
বোতাম টিপতে হাত বাড়ালাম। হঠাৎ করেই যেন অদৃশ্য একটা হাত ধাক্কা দিয়ে আমার হাতটা ‘জি’-এর কাছ থেকে সরিয়ে দিল | অবাক হয়ে দেখলাম, ‘এইচ’ লেখা একটা বোতাম টিপছি, প্যানেলে যে আছে ওটা, চোখেই পড়েনি আগে।
‘এইচ’ দিয়ে কী হয়?
কোথায় যাবে এখন এলিভেটর?
বোতামটা আমাকে দিয়ে কে টেপাল?
ছয়
তীব্র গতিতে নীচে নেমে চলল এলিভেটর। আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন গলার কাছে উঠে চলে এসেছে। প্রতিটি ফ্লোর পার হচ্ছি, আর আরও বেশি শক্ত হয়ে যাচ্ছি। কিছুই করতে পারছি না। আমার হাতটাকে অনড় করে দিয়েছে কে যেন।