‘আছি, সার।’ লকার থেকে আমার কাপড়গুলো বের করে পরতে পরতে বললাম।
‘সত্যি ভাল আছো?’ শঙ্কিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছেন সার।
‘কেন, সার, ভালই তো আছি।’
‘যাক, বাঁচা গেল!’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। ‘আমাদের কেয়ার-টেকার বলল, গরম পানি সাপ্লাই দেয়ার পাইপটা নাকি ফেটে গেছে বাথরুমের ভিতর। বাষ্প বেরোনোর কথা। বাইরে থেকে চাবি বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে আমি তোমাকে বাথরুমে ঢুকতে দেখেছি। ওর কথা শুনে তাই ছুটে এসেছিলাম, তোমাকে সাবধান করে দিতে।’
‘বাষ্প বেরিয়েছিল, সার, তবে আমার কোন ক্ষতি হয়নি। একটু দমবন্ধ লাগছিল অবশ্য।
‘ভাগ্যিস তোমার কোন ক্ষতি হয়নি। নাহ্, এসব ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে এরপর থেকে। কেয়ারটেকারকে ভালমত বলে দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে। ভাগ্য ভাল, শাওয়ার দিয়ে গরম পানি বেরোয়নি। তাহলে তো পুড়ে মরতে!’
গরম পানির পাইপ ফাটলে বাষ্প বেরোতেই পারে। কিন্তু তার সঙ্গে ওই অদ্ভুত হাসির কী সম্পর্ক, বুঝতে পারলাম না। হাসি আর কথা যে শুনেছি, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আরেকটা কাকতালীয় ব্যাপার, পাইপ ফাটার আর সময় পেল না, আমি যখন বাথরুমে শাওয়ার নিচ্ছি, ঠিক তখন ফাটল কেন?
ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন আমাকে নিয়ে খেলা করছে। আমাকে ভয় দেখাতে চাইছে। কিংবা তারচেয়ে খারাপ কিছু করতে চাইছে। ভাবনাটা মনে চেপে রাখলাম। কোচকে জানালাম না। বললে হয়তো আরও অনেকের মত তিনিও আমার অতিকল্পনাকেই দায়ী করবেন।
আর কিছু না বলে, চুপচাপ কাপড় পরে হাঁটতে শুরু করলাম। বেরিয়ে এলাম স্কুলের সামনের দরজা দিয়ে। সূর্য ডুবছে। পশ্চিম আকাশে বিশাল একটা আগুনের গোলার মত।
আমার স্কেট পায়ে দিলাম। হাঁটুতে নি-প্যাড লাগিয়ে মাথায় হেলমেট পরলাম। ব্যাকপ্যাকটা পিঠে বাঁধলাম। তারপর স্কেটিং করে গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় পড়লাম।
শপিং মলটা নতুন, মাত্র কয়েক বছর আগে বানানো হয়েছে। শহরের একপ্রান্তে, স্কুল থেকে মাইলখানেক দূরে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই চোখে পড়ল বিল্ডিংটা।
দূর থেকেও ভূতুড়ে দেখাচ্ছে। অনেক বড়, ঝকঝকে পরিষ্কার, প্রচুর বাতি, কিন্তু তবু ওটার দিকে তাকিয়ে গায়ে কাঁটা দিল আমার। কালো কাঁচ লাগানো থাকায় দূর থেকে কেমন অবাস্তব লাগছে, আমার কাছে মনে হচ্ছে ভিনগ্রহবাসীদের বিশাল একটা স্পেসশিপের মত। বাইরে থেকে দেখে মনেই হয় না ওখানে খারাপ কিছু ঘটতে পারে। কিন্তু আমি জানি—আমার ধারণা—ওটার গভীরে কোনখানে সাংঘাতিক কিছু ঘটছে। আমি আরও জানি, আমার অপেক্ষায় রয়েছে অশুভ কোনও দানব, যেটা বার বার আমার স্বপ্নে দেখা দেয়। আমার মন বলছে, আমার ক্ষতি ওটা করবেই। তাই তৈরি থাকতে হবে আমাকে, যাতে সময় এলে ওটার মোকাবেলা করতে পারি।
শপিং মলের প্রধান প্রবেশপথের সামনে পৌছে মন থেকে এসব কথা দূর করে দিতে চাইলাম। পা থেকে স্কেট দুটো খুলে নিয়ে ব্যাকপ্যাকে ভরলাম। তারপর ঢুকে পড়লাম গেট দিয়ে ভিতরে।
আমি ঢোকার সময় নীল ইউনিফর্ম পরা একজন গার্ড ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। ওর পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম।
সবখানেই ক্রেতার ভিড়। দোকানের ভিতরে, বাইরে, বারান্দায়, সব জায়গায় আছে। কেউ ঢুকছে, কেউ বেরোচ্ছে, কেউ কেউ এসকেলেটরে চড়ে ওপরে উঠছে, কিংবা নীচে নামছে। গ্রেগ জনসনের ‘ডল এম্পোরিয়াম’টা পাঁচতলায়।
এলিভেটরের সামনে অনেক লোক লাইন দিয়েছে, তাই তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য এসকেলেটরকেই বেছে নিলাম।
উঠে পড়লাম তাতে। দ্রুত আমাকে দোতলায় পৌঁছে দিল ওটা। নেমে, পরের এসকেলেটরে চড়ে উঠলাম তিনতলায়। আবার নেমে আরেকটায় চড়ে চারতলায়। আবার এসকেলেটর বদল করলাম। এসময় লক্ষ করলাম, এই এসকেলেটরটাতে আমি একা। আর কেউ নেই। পাঁচ তলায় উঠে যাচ্ছে। হঠাৎ খুব দ্রুত চলতে শুরু করল ওটা।
এটাও কী আমার কল্পনা? না সত্যিই ঘটছে?
ভারসাম্য হারালাম। হাত বাড়িয়ে থাবা দিয়ে একটা পাশ ধরে ফেলার চেষ্টা করলাম। রোলার কোস্টারের চেয়ে দ্রুত চলছে এসকেলেটর।
সামনেই পাঁচতলা। ভয়ঙ্কর গতিতে সেদিকে এগোচ্ছে এসকেলেটর। চিৎকার করে উঠলাম। এত দ্রুত চলছে, নামার সুযোগ দেবে না, আমাকে স্রেফ ছুঁড়ে ফেলে দেবে পাঁচতলার ল্যাণ্ডিং-এ।
পাঁচ
শক্ত করে ফেললাম দেহটাকে। এসকেলেটর আমাকে শূন্যে ছুঁড়ে ফেললে ডিগবাজি খেয়ে পায়ের ওপর খাড়া হয়ে নামার চেষ্টা করব। কিন্তু পিঠে বাঁধা ব্যাকপ্যাকটা ঝামেলা করবে, জানি, তবু চেষ্টা করে দেখতে হবে।
ওপরে পৌঁছে গেছি।
দেহটাকে শক্ত করে রেখেছি।
এসকেলেটর আমাকে শূন্যে ছুঁড়ে দেয়ার অপেক্ষায় আছি।
আচমকা কোনরকম জানান না দিয়ে থেমে গেল ওটা! এ রকম কিছু ঘটার জন্য তৈরি ছিলাম না। উড়ে গিয়ে ল্যাণ্ডিং-এর ওপর পড়লাম। দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে, একটা বিজ্ঞাপনের ডিসপ্লের ওপর পড়লাম। স্ট্যাণ্ডের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখা বিজ্ঞাপনের বোর্ডটাকে নিয়ে কাত হয়ে পড়লাম বারান্দায়। একটা দোকানের সামনে।
মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি, রুক্ষ চেহারার টাকমাথা একজন ছোটখাট মানুষ দোকানের কাঁচের দেয়ালের ভিতর দিয়ে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে।
হাসার চেষ্টা করে উঠে দাঁড়ালাম। ভান করলাম, যেন কিছুই হয়নি। বিজ্ঞাপনের বোর্ডটাকে তুলে আগের মত খাড়া করে রাখলাম। টেনেটুনে কাপড়-চোপড় ঠিক করতে লাগলাম।