‘খাইছে, কাকে প্রথম ধরবেন ম্যাডাম?’ আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল মুসা।
আমি ঘাবড়ালাম না। কারণ, জানি, আমি খারাপ লিখিনি। স্কেটিং-এর ওপর রচনা লিখতে দেয়া হয়েছে আমাকে, আমার প্রিয় বিষয়। খুব ভাল করে মন দিয়ে লিখেছি। স্কেটিং একটা খুব ভাল ব্যায়াম, কীভাবে দেহমনের উন্নতি করে, এসব কথা আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছি। তবে মাথায় আর হাঁটুতে নি-প্যাড না পরে কোনমতেই স্কেটিং করা উচিত হবে না, জোর দিয়ে বলেছি একথা। অ্যাক্সিডেন্ট করলে হেলমেট মাথা রক্ষা করবে, আর নি-প্যাড হাঁটু। গল্পের মত করে লিখেছি রচনাটা। একটা কিশোর বয়েসী ছেলে কীভাবে স্কেটিং করে সারা আমেরিকা ভ্রমণ করেছে, সেটার কল্পিত কাহিনি।
যাই হোক, প্রথমেই আমার দিকে তাকালেন মিস কলিনস। ‘রবিন, তোমার লেখাটাই প্রথম পড়ো। তোমারটা সবচেয়ে ভাল হয়েছে।’
উঠে দাঁড়িয়ে সিটের সারির মাঝের সরু রাস্তা দিয়ে সামনে এগোলাম। ম্যাডামের ডেস্কের কাছে এসে তাঁর বাড়িয়ে ধরা খাতাটা হাতে নিয়ে ক্লাসের দিকে মুখ করে দাঁড়ালাম। খাতার ওপর বড় করে একটা ইংরেজি ‘এ’ অক্ষর লিখে দিয়েছেন ম্যাডাম। তারমানে সর্বোচ্চ গ্রেডটাই দেয়া হয়েছে আমাকে।
পাতা ওল্টালাম। খাতার দিকে তাকিয়ে দম বন্ধ হয়ে এল আমার। আমি শিরোনাম লিখেছিলাম : ‘স্কেটিং করে আমেরিকা ভ্রমণ’। কিন্তু আমার হাতে ধরা খাতাটায় লেখা : ‘শপিং মলের দানব’।
রোমশ দেহ ও বড় বড় লাল চোখওয়ালা ভয়ঙ্কর চেহারার একটা দানব কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। কালো কাঁচের দেয়ালওয়ালা শপিং মলটার সামনে দাঁড়ানো ওটা!
তিন
ক্লাসে পিনপতন নীরবতা। কেউ কথা বলছে না। তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার রচনা শোনার অপেক্ষা করছে। আমি তো এদিকে ভয়ে পাথর।
‘কী হলো, রবিন, পড়ছ না কেন?’ ম্যাডাম বললেন। ‘পড়ো!’
‘ম্যাডাম, এই রচনা আমি লিখিনি,’ ঢোক গিলে বললাম।
ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন তিনি। ‘তুমি লেখনি মানে? এটা তোমার হাতের লেখা, আমি ভাল করে চিনি।’
‘কিন্তু আমি তো লিখেছি স্কেটিঙের ওপর, একটা ছেলে কীভাবে সারা আমেরিকা ঘুরে বেড়ালো। জঘন্য একটা শপিং মলের গল্প লিখিনি।’
‘রবিন, ভাল করে খাতার দিকে তাকিয়ে দেখো,’ এমন ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকালেন ম্যাডাম, যেন আমি মঙ্গল গ্রহ থেকে নেমে আসা কোনও প্রাণী। ‘স্কেটিঙের গল্পই লিখেছ তুমি।’
খাতার দিকে তাকাতে ভয় লাগছে আমার। জোর করে চোখ নামালাম আবার। অবাক হয়ে দেখলাম, সত্যিই লেখা রয়েছে : ‘স্কেটিং করে আমেরিকা ভ্রমণ’। লেখকের নামের জায়গায় আমার নাম—রবিন মিলফোর্ড।
আবার কি আমার অতিকল্পনা আমাকে হ্যালুসিনেশন দেখিয়েছে? আবার জেগে জেগে শপিং মলের দুঃস্বপ্ন দেখেছি? তবে হাতের খাতাটায় আবার স্বাভাবিক শিরোনাম দেখে স্বস্তি বোধ করলাম।
জোরে জোরে পড়তে আরম্ভ করলাম।
পড়া শেষ হলে সবাই প্রশংসা করল।
‘সত্যিই খুব ভাল হয়েছে, রবিন,’ মিস কলিনস বললেন। ‘আমেরিকার সমস্ত জায়গায় নিশ্চয় যাওনি তুমি, অথচ এই লেখার মাধ্যমে সারা দেশ ঘুরিয়ে এনেছ আমাদের। একজন সাংঘাতিক স্টোরি টেলার তুমি, কল্পনাশক্তি অসাধারণ।’
মৃদু হেসে নিজের সিটে ফিরে এলাম।
এরপর বাকি দিনটা নিরাপদেই কেটে গেল, অস্বস্তিকর আর কিছু ঘটল না। স্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছি কেবল, তারপরই এমন একটা ঘটনা ঘটল, রীতিমত ঘাবড়ে গেলাম।
বেসবল প্র্যাকটিস সেরে বাথরুমে ঢুকেছি। শাওয়ারে গোসল সেরে, শরীরের ঘাম ধুয়ে নেয়ার জন্য। তাড়াহুড়ো করছি, কারণ এখান থেকে বেরিয়ে শপিং মলে যেতে হবে।
শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে পানি ছেড়ে দিয়ে ভিজতে লাগলাম। খানিকক্ষণ শরীর ভিজিয়ে নিয়ে সাবান মাখাচ্ছি, হঠাৎ লক্ষ করলাম, বাষ্পে ভরে যাচ্ছে ঘরটা।
বেসিনে ঠাণ্ডা-গরম, দুই রকম পানিরই ব্যবস্থা আছে। নিশ্চয় গরম পানির কলটা খুলে দিয়েছে কেউ। তবে কখন ঢুকল, কে ঢুকল, কিছু লক্ষ করিনি।
ভীষণ গরম হয়ে গেছে বাথরুমের বাতাস। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। কেশে উঠলাম।
‘অ্যাই, কল কে খুলেছ?’ চিৎকার করে বললাম, ‘বন্ধ করো!’
কেউ জবাব দিল না। বদ্ধ জায়গায় প্রতিধ্বনি তুলল আমার চিৎকার। যেন আবারও দুঃস্বপ্নের মধ্যে রয়েছি। স্বপ্নের সেই জোরাল কণ্ঠটাকে কথা বলতে শুনলাম, কানের কাছে যেন গমগম করে উঠল, ‘রবিন! রবিন মিলফোর্ড! আমার হাত থেকে মুক্তি নেই তোমার। হাহ্ হাহ্ হাহ্!’
চার
আরও ঘন হচ্ছে বাষ্প।
দম আটকে আসছে আমার।
মরিয়া হয়ে দেয়াল ঘেঁষে বসানো বেসিনের কাছে এসে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে প্রচণ্ড গরম হয়ে গেছে ঘরের বাতাস।
মোচড় দিলাম ‘হট’ লেখা কলটার চাবিতে।
কিন্তু বন্ধই তো রয়েছে ওটা!
পানিও পড়ছে না!
তাহলে ঘর গরম হলো কীভাবে?
আর বাষ্পই বা এলো কোথা থেকে।
ধীরে ধীরে কমে গেল বাষ্প, পরিষ্কার হয়ে এল বাতাস।
পায়ের শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। মেঝেতে বসে পড়লাম। হাঁপাচ্ছি আর দম নিচ্ছি।
চারপাশে তাকালাম। কেউ নেই। মস্ত গোসলখানাটায় আমি একা।
কয়েক সেকেণ্ড বিশ্রাম নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বড় তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছে, গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে এলাম বাথরুম থেকে।
লকার রুমের দিকে এগোলাম।
দৌড়ে আসছেন আমাদের বেসবল কোচ মিস্টার জোনস। ‘রবিন!’ চিৎকার করে বললেন তিনি। ‘তুমি ভাল আছো তো?’