‘না, ভুলিনি। আমার স্কেটের চাকার জন্য এক কৌটা তেল।’
‘ও যে তোমার জন্মদিনের তারিখটা মনে রেখেছে, এটা আমার খুব ভাল লেগেছিল।’
‘আমারও লেগেছিল। কিন্তু ওই তেল কেনার জন্য ওকে কষ্ট করে শপিং মলে যেতে হয়নি, তা-ও আবার স্কুল ছুটির পর, বেসবল প্র্যাকটিসের কথা নাহয় বাদই দিলাম; পাড়ার দোকান থেকেই কিনেছিল। স্কেটের চাকায় সেলাই মেশিনের তেল দিলেই হয়, আর এসব তেল যে কোন স্টেশনারি দোকানে পাওয়া যায়।’
‘তোমাকে তো এত কথা বলতে বলিনি,’ রান্নাঘরের দিকে মুখ ফেরাল মা। চুলায় কিছু বসিয়ে এসেছে বোধহয়। ‘পুতুলটা কিনে আনবে, ব্যস। আর হ্যাঁ, কাল একটা জন্মদিনের পার্টি দিচ্ছি আমরা, মনে রেখো। কোথাও আবার স্কেটিং প্রতিযোগিতায় চলে যেয়ো না।’
‘ঠিক আছে,’ অনিচ্ছাসত্ত্বেও বললাম। জানি, একবার যখন পুতুল এনে দিতে বলেছে আমাকে মা, যেতেই হবে আমাকে, না গিয়ে পারব না। উহ্, মা-টা বড় নাছোড়বান্দা!
খারাপ হয়ে গেছে মেজাজটা। সামনের দরজা খুলে ঘরের বাইরে পা রাখলাম। হঠাৎ বিকট এক চিৎকার। ধড়াস করে উঠল বুকের ভিতর। ফিরে তাকিয়ে দেখি, ভয়ঙ্কর চেহারার একটা প্রাণী বেরিয়ে আসছে পাশের ঝোপ থেকে।
দুই
এতই ভয় পেলাম, পিছাতে গিয়ে উল্টে পড়লাম।
খিলখিল হাসি শোনা গেল। ঝোপ থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এল নিনা। হাতে ধরা কুৎসিত চেহারার পুতুল। ঝোপের ভিতর থেকে এমনভাবে বাড়িয়ে রেখেছিল, হঠাৎ দেখে আমি ভেবেছি ভয়ঙ্কর কোনও প্রাণী।
‘সুন্দর দেখতে, তাই না?’ পুতুলটা আমার চোখের সামনে নাচিয়ে হেসে বলল নিনা
উঠে দাঁড়ালাম। গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘দেখো, এসব বিশ্রী রসিকতাগুলো বাদ দিতে পারলে ভাল হয়। এত হাসির কিছু নেই। যা করলে, সেটা অতিরিক্ত ছেলেমানুষী। মনে রেখো, কাল থেকে বয়েস এক বছর বেড়ে যাচ্ছে তোমার। সত্যি বলতে কী, এই বয়েসে পুতুল নিয়ে খেলাটাও মানায় না আর!’
‘তুমি আসলে আমাকে হিংসে করো, নিনা বলল, ‘এত রকমের পুতুল নেই তো তোমার, তাই।’ ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে রওনা হলো ও। বাড়িতে ঢোকার আগে ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘পুতুলের মত ভাল খেলনা আর নেই।’
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগলাম। তারপর প্যান্টে লাগা ময়লা আর কুটো ঝেড়ে ফেলে স্কুলে রওনা হলাম।
আমাদের গেট দিয়ে বেরিয়ে বড় রাস্তায় পড়লাম। দূরে শপিং মলের এগারো তলা বিল্ডিংটা চোখে পড়ল। বড় বড় কালো কাঁচ দিয়ে তৈরি সামনের দেয়াল। দেখলেই কেন যেন গা ছমছম করে আমার। মনে হতে থাকে, এর মধ্যে ঢোকা যায়, কিন্তু বেরোনো যায় না; একবার ঢুকলেই গিলে নেবে চিরকালের জন্য। হয়তো আমার অতিকল্পনা—ওই যে বললাম, কিছুদিন থেকে হচ্ছে; এতদূর থেকে বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়েও গায়ে কাঁটা দিল আমার। আগে এরকম হতো না। তবে কখনোই ওখানে যেতে ভাল লাগে না আমার, যদিও ছোটদের আকৃষ্ট করার জন্য নানারকম ব্যবস্থা রয়েছে ওটার ভিতরে, অসংখ্য লোভনীয় জিনিসও কিনতে পাওয়া যায়।
স্কেটিং করে চলেছি। আমাদের স্কুলটা যেমন আধুনিক, তেমনি অনেক বড়। প্রাইমারি, হাই স্কুল, এমনকী কলেজও আছে—এইচ এস সি পর্যন্ত পড়ানো হয়।
স্কুলে পৌছলাম। স্কেটিং করেই ঢুকলাম গেট দিয়ে। স্কুলের প্রধান বারান্দার কাছে এসে থামলাম।
সামনের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতেই দেখা হয়ে গেল আমার বন্ধু কিশোরের সঙ্গে।
‘বেসবল প্র্যাকটিসে থাকছ তো?’ জিজ্ঞেস করলাম ওকে।
‘নিশ্চয়ই,’ কিশোর বলল।
একসঙ্গে ক্লাসে ঢুকলাম দুজনে। হাত তুলে ডাকল আমার আরেক বন্ধু মুসা। ওর কাছে গিয়ে বসলাম। আমি মাঝখানে, একপাশে কিশোর, অন্যপাশে মুসা। স্কুল শুরুর ঘণ্টা পড়ল। আমাদের ক্লাস টিচার মিস্টার টমাস ক্লাসে ঢুকে হাজিরা খাতা দেখে আমাদের নাম ডাকলেন।
আমার নাম ডাকা হতেই, ‘ইয়েস সার’ বললাম। তারপর ফিসফিস করে কিশোরকে বললাম, ‘কাল নিনার জন্মদিন। তাই প্র্যাকটিসের পর আমাকে শপিং মলে যেতে হবে। আমার সঙ্গে যাবে?’
‘প্র্যাকটিসের পর?’ আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল কিশোর। ‘পাঁচটা বেজে যাবে। না ভাই, পারব না, বাড়িতে কাজ আছে। ঠিক সাড়ে-পাঁচটায় হাজির থাকতে বলে দিয়েছে চাচী। সরি।’ আরেক পাশ থেকে মুসা জিজ্ঞেস করল, ‘ওই শপিং মলে যেতে এখনও ভয় পাও তুমি, তাই না, রবিন?’
‘না, ঠিক ভয় না! তবে কেমন অস্বস্তি লাগে,’ জবাব দিলাম। ‘ঢুকলেই গা ছমছম করে। আগেও তো কতবার গেছি, এমন হয়নি। মাথামোটা গার্ডগুলো চোখ কটমট করে তাকিয়ে থাকে—দেখে মনে হয় যেন শুধু আমার দিকেই।’
কিশোর বলল, ‘আসলে ওই স্বপ্ন দেখাটাই তোমার কাল হয়েছে। দানবের দুঃস্বপ্ন।’
‘হ্যাঁ, বিড়বিড় করল মুসা। ‘রবিনের আর দোষ কী। ওরকম ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখলে আমিও ভয় পেতাম।’
শপিং মলের দানবের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে প্রথম ঘণ্টাটা পার হয়ে গেল, বলতে পারব না। ক্লাসে সার কী পড়িয়েছেন, কিছুই শুনিনি। পিছন দিকের একটা সিটে বসেছি আমি। তাই বোধহয় আমার অন্যমনস্কতা সার খেয়াল করেননি। ঘণ্টা পড়ার শব্দে যেন চমকে বাস্তবে ফিরলাম। এরপর ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাস, আমার খুব প্রিয় সাবজেক্ট।
হাতে খাতার বোঝা নিয়ে ক্লাসে ঢুকলেন মিস কলিনস। ধড়াস করে টেবিলের ওপর রাখলেন সেগুলো। পুরো ক্লাসে চোখ বোলালেন একবার। তারপর বললেন, ‘আমি তোমাদের খাতাগুলো দেখেছি। সবচেয়ে ভাল রচনা যারা লিখেছ, তার কয়েকটা এখন ক্লাসে পড়ে শোনাতে হবে।’