‘কী লাগবে?’ জিজ্ঞেস করল একটা কণ্ঠ।
ফিরে তাকালাম। গ্রেগ জনসন! মুখে কথা সরছে না আমার। তাকিয়ে আছি। শেষবার যখন দেখা হয়েছে, আমার ছুঁড়ে দেয়া ব্যাকপ্যাকের আঘাতে ব্যথায় পেট চেপে ধরে কাতরাচ্ছে ও। এত তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হলো কী করে!
‘কী খুঁজছ? এভিয়েটর ডল?’ আমাকে পুতুলটার দিকে তাকাতে দেখেছে নিশ্চয় গ্রেগ জনসন। হেসে বলল, ‘নিতে পারো। এ পুতুলের খুব চাহিদা। প্রচুর বিক্রি হয়।’
গ্রেগ জনসনের আচরণে মনেই হলো না, এর আগে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার। চিনতেই পারল না যেন আমাকে। ওর ভাবসাবও আমূল বদলে গেছে। আন্তরিক, হাসিখুশি ভঙ্গি। সাবলীল কথাবার্তা।
আমিও হাসলাম। স্কারপিনিকে রশ্মির আঘাত হানার পর নিশ্চয় এমন কিছু ঘটেছে, গোলামদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে ও। আর তাতে স্বাভাবিক হয়ে গেছে গ্রেগ জনসন।
তবু ভয় গেল না আমার। তাই বেশি দেরি করতে চাইলাম না। তাড়াতাড়ি একটা পুতুল কিনে নিয়ে বেরিয়ে এলাম দোকান থেকে।
তারপর প্রেশার কুকারের ওয়াশার যে দোকানে পাওয়া যায় সেটাতে ঢুকলাম। সেই মহিলা দাঁড়িয়ে আছে কাউন্টারের ওপাশে, একটু আগেও যে দানব হয়ে ছিল। কিন্তু এখন ওর উষ্ণ হাসি দেখে মনেই হলো না, কিছুক্ষণ আগে ইলেকট্রিক গান হাতে আমাকে গুলি করার জন্য তাড়া করেছিল ও। গ্রেগ জনসনের মতই এই মহিলাও যেন চিনতে পারল না আমাকে। আচরণও খুব স্বাভাবিক। আর মাথার চুলের জায়গায় চুলই আছে, সাপ নয়।
একটা ওয়াশার কিনে বেরিয়ে এলাম। তারপর ঢুকলাম চশমার দোকানে। নতুন একটা ফ্রেম নিলাম, অবিকল সেটার মত, মা যেটা রেখে গিয়েছিল। চশমায় কাঁচ লাগাতে সময় লাগবে। আমাকে বসতে বলল মহিলা। বসতে আপত্তি নেই আমার, কিন্তু সমস্যাটা হলো, মা’র চোখের পাওয়ার কত, সেটা জানব কীভাবে? মহিলাকে বললাম, আগের চশমাটা হারিয়ে ফেলেছি। প্রেসক্রিপশন আনতেও ভুলে গেছি। তার খাতায় পাওয়ার লেখা আছে কি না, দেখতে অনুরোধ করলাম।
রেজিস্টার দেখে সহজেই বের করে ফেলল মহিলা। পনেরো মিনিটের মধ্যেই কাঁচ লাগিয়ে দিল চশমার কারিগর। ছোট পলিথিনের ব্যাগে চশমা, বেল্টের প্যাকেট, আর পুতুলের বাক্স ভরে নিয়ে হাতে ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলাম।
দুই-দুইবার একই জিনিস কিনতে গিয়ে আমার হাতখরচ থেকে জমানো সমস্ত টাকা খরচ করে ফেললাম। তবে তাতে বিন্দুমাত্র আফসোস নেই আমার। বেঁচে ফেরার আনন্দে মশগুল হয়ে আছি। এসকেলেটরের দিকে এগোলাম।
শপিং মলের ইউনিফর্ম পরা একজন মেকানিক পিছন ফিরে স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে কাজ করছে। স্কারপিনি না তো! পিছন থেকে তো লোকটাকে স্কারপিনির মতই লাগছে!
বুকের ভিতর কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল আমার। ঘুরে দৌড় দেয়ার কথা ভাবলাম। কিন্তু প্রচণ্ড কৌতূহল এসকেলেটরের দিকে টেনে নিয়ে গেল আমাকে।
স্কারপিনি কি আমাকে চিনতে পারবে? নাকি আর সবার মতই স্বাভাবিক হয়ে গেছে, আমাকে আর চিনতে পারবে না?
এসকেলেটরের কাছে চলে এসেছি, হঠাৎ আমার দিকে ঘুরে বসল লোকটা। চোখাচোখি হলো আমাদের।
না, ও স্কারপিনি নয়। ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় পিছন থেকে স্কারপিনির মত লাগছিল। এ অন্য লোক। বয়েসও অনেক কম। আগে কখনও দেখিনি একে। এসকেলেটর মেরামত করছে।
‘এসকেলেটর তো চলবে না এখন,’ লোকটা বলল আমার দিকে তাকিয়ে। ‘স্ক্রু ঢিলে হয়ে আছে। সেগুলো টাইট করে তারপর চালু করব আবার। এলিভেটর দিয়ে নামো। ইচ্ছে করলে সিঁড়ি দিয়েও নামতে পারো।’
‘আপনি কি এখানে নতুন?’ জিজ্ঞেস করলাম। ‘আগে তো কখনও দেখিনি।’
‘হ্যাঁ, নতুন,’ হেসে জবাব দিল লোকটা। ‘আজই জয়েন করলাম।’
আগের মেকানিক স্কারপিনির কী হয়েছে?’
শ্রাগ করল ও। ‘ওর কোন খবর নেই। কাউকে কিছু না বলে কোথায় চলে গেছে। কিন্তু কাজ তো আটকে থাকতে পারে না। তাই আমাকে খবর দিয়ে আনানো হয়েছে।’
লোকটার বুকে লাগানো ট্যাগে নাম লেখা রয়েছে : জর্জ ডেনভার।
‘নাহ্, সিঁড়ি দিয়েই নামি,’ জর্জকে বলে ঘুরে দাঁড়ালাম। এই শপিং মলের এলিভেটরে চড়ার সাহস আর আমার নেই। যদিও আমি নিশ্চিত, এবার আর কোন বিপদ ঘটবে না। ‘এইচ’ লেখা বোতামটাও আর দেখতে পাব না। তবু এলিভেটরে চড়লাম না। সিঁড়ি দিয়েই চার তলায় নামলাম। সেখান থেকে এসকেলেটরে চড়ে গ্রাউণ্ড ফ্লোরে।
গেট দিয়ে বেরোনোর সময় শপিং মলের গার্ডের সঙ্গে চোখাচোখি হলো। আগেরবারের মত কটমট করে তাকাল না। একবার তাকিয়েই অন্যদিকে চোখ ফেরাল ও।
গেটের বাইরে এসে জুতো খুলে স্কেট পায়ে দিলাম। জুতোগুলো পলিথিনের ব্যাগে রাখতে গিয়ে আরেকটা ব্যাকপ্যাকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। আগেরটা কোনওদিন আর খুঁজে পাব না। কয়েকদিন পরেই আমার জন্মদিন। মা’র কাছে উপহার হিসেবে একটা ভাল ব্যাকপ্যাকের আবদার করব। আরেকটা পুরানো ব্যাকপ্যাক আছে আমার আলমারিতে, ততদিন সেটা দিয়ে চালিয়ে নিতে পারব।
রোদ ঝলমলে দিন। আকাশের দিকে তাকালাম। সাদা, পাতলা মেঘের ছোট ছোট খণ্ড পেঁজা তুলোর মত ভেসে চলেছে। চমৎকার আবহাওয়া। স্কেটিঙের জন্য আদর্শ দিন।
বাড়ি রওনা হলাম। অদ্ভুত এক আনন্দ মনে। মগজে জোর করে ঢোকানো স্কারপিনির ইলেকট্রিক স্রোতের প্রবাহ কেটে যাওয়ায় আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে ব্রেইনওয়েভ। মনের দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, ভয়, অতিকল্পনা সব কেটে গেছে। অনেক দিন পর আবার শান্তি লাগছে। স্কেটিং করে মহাআনন্দে ছুটে চললাম রাস্তা ধরে, আচরণে কোনরকম অস্বাভাবিকতা নেই, জড়তা নেই; আমার মত একজন কিশোরের যা করা উচিত, তা-ই করছি।