‘মনে হচ্ছে এখন আমার যাওয়া উচিত,’ স্কারপিনির আমাকে বিখ্যাত বানানোর পরিকল্পনা আমার মনে দাগ কাটতে পারল না। বরং আরও আতঙ্কিত করে তুলল। এক কদম পিছিয়ে গেলাম। ‘মা চিন্তা করবে। জরুরি জিনিস কিনতে শপিং মলে পাঠিয়েছিল। তাড়াতাড়ি বাড়ি না গেলে শেষে পুলিশকেও ফোন করতে পারে।’
পুলিশের কথায় কোনরকম ভাবান্তর হলো না স্কারপিনির। বলল, ‘না, রবিন, অন্য কোথাও আর যাওয়া হবে না তোমার। এখন থেকে এটাই তোমার আসল বাড়ি। এখানেই থাকবে চিরকাল।’ ওয়েভারলির দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠল, হাঁ করে দেখছ কী? এদিকে এসো! ঠেকাও একে!’
মুহূর্তে স্কারপিনির পাশে চলে এল ওয়েভারলি। ওর হাতে বেরিয়ে এসেছে একটা পিস্তলের মত জিনিস।’
‘বলুন, মালিক,’ ওয়েভারলি বলল।
‘মনে হচ্ছে, আমাদের এই কিশোর বন্ধুটির আরও খানিকটা মগজ ধোলাই দরকার,’ স্কারপিনি বলল। ‘অলটার লেখা বোতামটা টিপে দাও!’ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটা আমার আবিষ্কৃত ব্রেন-অলটারিং ইলেকট্রিক-গান। অনেক কাজ হয় এটা দিয়ে। তার মধ্যে একটা হলো, মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে পরিবর্তন করে দেয়া। যাতে সে আর তার নিজের ভাবনায় চলতে না পারে।’
আতঙ্কিত চোখে ইলেকট্রিক গানটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
গানের পাশে লাগানো কয়েকটা বোতামের একটা টিপল ওয়েভারলি। তারপর নলটা পিস্তলের মত তুলে ধরে তাক করল আমার কপালের দিকে। ট্রিগারে চাপ দিচ্ছে আঙুল!
ষোলো
ঝপ করে মাটিতে বসে গড়িয়ে সরে গেলাম একটা ঝোপের ভিতর। লুকিয়ে পড়লাম।
‘মিস করলে তো, গাধা কোথাকার!’ প্রচণ্ড রাগে ধমকে উঠল স্কারপিনি। ‘জলদি ধরো! কোনমতেই যেন পালাতে না পারে!’
হামাগুড়ি দিয়ে সরে যেতে লাগলাম ঝোপের সারির ভিতর দিয়ে। স্কারপিনি, ওয়েভারলি, গ্রেগ জনসন আর দানব-মহিলা, সবাই খুঁজছে আমাকে। চারজনের হাতেই এখন একটা করে ব্রেন-অলটারিং ইলেকট্রিক গান।
আতঙ্কিত হয়ে কোনমতেই এখন মগজ গরম করা চলবে না, নিজেকে বোঝালাম। পালানোর উপায় বের করতে হবে।
ঝোপের ভিতরে ভিতরে ওদের কাছ থেকে বেশ খানিকটা সরে এলাম। হামাগুড়ি দিতে দিতে ক্লান্তি লাগছে। সামান্য জিরিয়ে নেয়ার জন্য ঘন ঝোপের আড়ালে একটা গাছের গায়ে পিঠ দিয়ে বসলাম। একইসঙ্গে ভাবতে লাগলাম, পালানোর উপায়। বট গাছটার কথা মনে পড়ল। ওটার কাছে যেতে হবে আমাকে, যেভাবেই হোক। ওটা খুঁজে বের করতে হবে। ওটার ভিতরের এলিভেটরে চড়তে না পারলে ওপরের জগতে যেতে পারব না আমি।
ঘাড়ে হাত বোলালাম। ব্যাকপ্যাকের ভিতর স্কেট দুটো চাপ দিচ্ছে পিঠে
হঠাৎ ঝটকা দিয়ে সোজা হয়ে গেলাম।
স্কেট!
তাই তো! এগুলো পরে ছুটতে থাকলে আমার সঙ্গে দৌড়ে পারবে না ওরা। তা ছাড়া দূর থেকে ব্রেন-অলটারিং ইলেকট্রিক গান দিয়ে আমাকে নিশানা করাটা তখন অনেক বেশি কঠিন হয়ে যাবে ওদের জন্য।
স্কারপিনির কথা শোনা যাচ্ছে। কাছে চলে আসছে ওরা। জুতো জোড়া খুলে রাখলাম। ব্যাকপ্যাক থেকে স্কেট আর নি-প্যাড বের করে পরলাম। গলার কাছে ঝুলছে হেলমেটটা। সোজা করে বসালাম মাথায়।
তারপর উঠে দাঁড়ালাম। আমার কাছ থেকে কয়েক গজ দূরে রয়েছে গ্রেগ জনসন। এখনও দেখেনি আমাকে।
জানি, পারব না, তবু ঝোপ থেকে চুপি চুপি ওর চোখ এড়িয়ে বেরোনোর চেষ্টা করলাম।
কিন্তু পারলাম না। ঠিকই দেখে ফেলল আমাকে।
গ্রেগ জনসনের চিৎকার শোনা গেল, ‘ওই যে, ওই যে ও, মালিক।’
‘ট্রিগার টেপো, ট্রিগার টেপো, গাধা কোথাকার!
মুখ ফিরিয়ে পলকের জন্য দেখলাম, ইলেকট্রিক গান তুলে আমাকে নিশানা করছে গ্রেগ জনসন।
সতেরো
মাটি থেকে টান দিয়ে আমার ব্যাকপ্যাকটা তুলে নিয়ে গ্রেগ জনসনকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলাম।
থ্যাক করে ওর পেটে গিয়ে লাগল ব্যাগটা। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠে হাত থেকে ইলেকট্রিক গানটা ছেড়ে দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল ও।
‘কী, খুব ব্যথা লাগল! আর বদলাতে আসবেন মানুষের মগজ?’ রাগে চেঁচিয়ে বললাম।
লাফ দিয়ে ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে গ্রেগ জনসনের পাশ দিয়ে স্কেটিং করে ছুটলাম। আমার দিকে নজর দেয়ার অবস্থা নেই ওর। পেট চেপে ধরে গোঙাচ্ছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নিচু হয়ে ছোঁ দিয়ে মাটি থেকে তুলে নিলাম ইলেকট্রিক গানটা। ব্যাকপ্যাকটা তুলতে যাব, এ সময় কানে এল চিৎকার। তোলার আর সময় পেলাম না। ওটা নিতে না পারলে নিনার পুতুল, মা’র চশমা আর প্রেশার কুকারের ওয়াশারটা যাবে। তবে ওসব জিনিস আবার কিনতে পারব। কিন্তু প্রাণটা খোয়ালে আর ফেরত পাব না।
পাহাড়ের দিকে ছুটলাম। পাশের একটা গাছের আড়াল থেকে লাফ দিয়ে রাস্তায় এসে পড়ল দানব-মহিলা। হাতের ইলেকট্রিক গানটা তুলে ধরে আমি কাছে যাওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল।
গ্রেগ জনসনের ইলেকট্রিক গানটা দু’হাতে চেপে ধরে উঁচু করলাম। ছোটা বন্ধ করলাম না।
স্কেটিং করে যত দ্রুত সম্ভব ছুটছি। দানব-মহিলার কাছাকাছি চলে এসেছি। আরেকটু গেলেই গায়ের ওপর পড়ব। আমাকে লক্ষ্য করে বৈদ্যুতিক রশ্মি ছুঁড়তে শুরু করল ও।
মাথা নিচু করে, এদিকে সরে, ওদিকে সরে ওর নিশানা ব্যর্থ করে দিতে লাগলাম। ইলেকট্রিক গানের নল দিয়ে বেরোনো কিছু রশ্মি আমার হেলমেটে লেগে ফসকে গেল। আমার মাথায় ঢুকল না।
দানব-মহিলার পাশ কাটানোর সময় হা-হা করে হাসলাম। স্কেটিং করে চলে এলাম অন্যপাশে। ইলেট্রিক গানের কারেন্ট সামান্যতম প্রভাব ফেলতে পারেনি আমার মগজে। ঢোকেইনি, প্রভাব ফেলবে কী। তাতে সাহস ফিরে পেয়েছি। বাতাসের গতিতে ছুটে চলেছি স্কেটিং করে। আমার মগজ এখন পরিষ্কার। ঠিকমত ভাবতে পারছি। মুক্তির গন্ধ পাচ্ছি।