‘হ্যাঁ, মালিক, হ্যাঁ!’ তাড়াতাড়ি মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করে জবাব দিল ওয়েভারলি।
বুঝলাম, ক্ষমতা এখন সত্যি সত্যি স্কারপিনির হাতে চলে গেছে। ওয়েভারলির ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে। আরও যাদেরকে গোলাম বানিয়েছে ও, তারাও নিশ্চয় ওয়েভারলির পক্ষ নিয়ে ওয়েভারলিকে সহায়তা করেছে, স্কারপিনির ক্ষতি করেছে।
‘হুঁ, বুঝলাম,’ মাথা ঝাঁকালাম আমি। ‘ওদের অফিস আর দোকানের ভিতর বিশেষ কারেন্ট প্রবাহিত করে ওদের মগজ ধোলাই করেছেন, ওদের গোলাম বানিয়েছেন, কিন্তু ওদের চেহারার এই দুর্গতি কেন? সেটা বদলালেন কীভাবে?’
‘এটা আমি ইচ্ছে করে করিনি,’ জবাব দিল স্কারপিনি। ‘ওই কারেন্টের সাইড-এফেক্ট, অর্থাৎ, প্রতিক্রিয়া। আমি জানতাম না এমন হবে। তবে হওয়াতে আমি খুশিই হয়েছি। যেমন শয়তান ওরা, ওদের উপযুক্ত শাস্তি। আমার প্রতি যে ভয়ঙ্কর অন্যায় আচরণ করেছে ওরা, সেটাই এখন ওদের চেহারায় প্রকাশ পাচ্ছে।’
চারপাশে তাকালাম। আবার ঘন বনের প্রান্তে চলে এসেছি। শান্ত থাকার ভান করছি, তবে মনে প্রচণ্ড ভাবনার ঝড় চলেছে আমার। স্কারপিনির জায়গা দখল করে সেখানে শপিং মল বানানোয় ওর প্রতি আমার সহানুভূতি আছে, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে লোকটা উন্মাদ। কারণ, আমাকেও ধরে নিয়ে এসেছে। আমি তো ওর কোন ক্ষতি করিনি। এই উন্মাদটার কবল থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছি মনে মনে। পিছনে ছায়ার মত লেগে আছে ওয়েভারলি। ঘুরে যে পিছন ফিরে দৌড় দেব, তারও উপায় নেই। যদিও জানি, এই অদ্ভুত ফ্যান্টাসির জগতে শুধু দৌড় দিয়ে পালাতে পারব না স্কারপিনির হাত থেকে।
‘আপনার যুক্তি ঠিকই আছে, মিস্টার স্কারপিনি,’ আমি বললাম। জ্বলে উঠল ওর চোখ, বোধহয় আমি নাম ধরে ডাকাতেই। তাড়াতাড়ি শুধরে নিয়ে বললাম, ‘সরি, মালিক, আমি আপনাকে রাগাতে চাইনি।’ চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে গেল আবার স্কারপিনির। বললাম, ‘এই লোকগুলো নাহয় আপনার ব্যবসার ক্ষতি করেছে, কিন্তু আমি তো কিছু করিনি। আপনার সঙ্গে কোন শত্রুতা নেই আমার। এমনকী আপনাকে ভাল করে চিনিও না আমি।’
হাসল স্কারপিনি। ‘না, রবিন, তোমার সঙ্গে আমার কোন শত্রুতা নেই। বরং তুমি আমার জন্য একটা বিরাট সম্ভাবনা।’
‘সম্ভাবনা?’ বুঝতে পারলাম না।
‘তোমার স্কুলের রেকর্ড দেখেছি আমি, রবিন। তোমার মধ্যে ট্যালেন্ট আছে, গল্প বলার ট্যালেন্ট, খুব ভাল স্টোরি টেলার তুমি। গুছিয়ে গল্প বলতে পারো। বুঝলাম, তুমি আমার কাজে লাগবে। তাই তোমার ওপর নজর রাখতে শুরু করলাম। একদিন সবাই যখন তোমরা তোমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে, তোমার বেডরুমে ঢুকে তোমার টেবিল ল্যাম্পের বাল্বটা বদলে আমার তৈরি একটা স্পেশাল বাল্ব্ লাগিয়ে দিয়ে এসেছি। সেটা জ্বাললেই তোমার মগজের ওয়েভলেংথে ঢুকতে থাকে স্পেশাল কারেন্ট, তোমার কল্পনাকে বাড়িয়ে দেয়, অদ্ভুত সব জিনিস কল্পনা করতে থাকো। স্বপ্নে তো বটেই, অনেক সময় জেগে থেকেও ফ্যান্টাসির জগতে চলে যাও। উদ্ভট সব জিনিস দেখতে থাকো।’
এতক্ষণে পরিষ্কার হলো রহস্য। বুঝলাম, কিছুদিন থেকে হঠাৎ করে কেন এভাবে উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখা শুরু করেছি। জেগে থাকলে হ্যালুসিনেশন দেখি। শপিং মলের আরও কয়েকজনের মত আমিও স্কারপিনির উদ্ভাবিত ইলেকট্রিক যন্ত্রের শিকার। তবে ওদের মত আমাকে রোবট বানায়নি স্কারপিনি, আমার মগজ দখল করে আমার চিন্তাভাবনাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলেনি।
‘কেন?’ জিজ্ঞেস করলাম। ‘আমার ওপর আপনার কারেন্ট পরীক্ষা করতে গেলেন কেন?’
হাসল স্কারপিনি। কেমন অস্থির দেখাল হাসিটা। পাগলের হাসি। ‘রবিন, একটা জিনিস নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ, আধুনিক যে সব শপিং মলগুলো তৈরি হচ্ছে, সেগুলোতে জিনিস বিক্রির পাশাপাশি নানারকম ‘আকর্ষণ’ থাকে, মানুষকে বিনোদন দেয়ার জন্য। যে যত বেশি বিনোদনের ব্যবস্থা করতে পারে, তার শপিং মল তত বেশি চলে। আমারটাকে আমি সেরা বানাতে চাই। তুমিও সেখানে অংশ গ্রহণ করবে। তোমার বিনোদন শোটার নাম দেব আমি রবিন শো!’
‘মানে!’ চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘আমাকে শপিং মলের আকর্ষণ বানাবেন! লোকের বিনোদনের বস্তু বানাবেন আমাকে! তারমানে পুতুল বানিয়ে গেটের কাছে দাঁড় করিয়ে রাখতে চান?’
‘উঁহুঁ,’ মাথা নাড়ল স্কারপিনি। হাসল। ‘পুতুল না, হিউম্যান স্টোরি মেশিন! ছোটদের প্রধান আকর্ষণ হবে তুমি। বাবা-মা’রা তাদের বাচ্চাদের এই স্টোরি মেশিন দেখাতে নিয়ে আসবে। অনর্গল গল্প বলে যাবে তুমি। দারুণ আকর্ষণীয়, অদ্ভুত সব গল্প। শোনার জন্য ভিড় জমাবে ছেলেমেয়েরা, বাকি শপিং মলগুলোর ব্যবসা লাটে উঠবে!’
‘আপনি পাগল, মিস্টার স্কারপিনি!’ আর না বলে পারলাম না। ‘উন্মাদ!’
আমার কথায় রাগ করল না স্কারপিনি। বোঝানোর চেষ্টা করল আমাকে, ‘তুমি হবে একটা মস্ত হিট, রবিন! ভেবে দেখো। আমার মেশিন থেকে আরও একটু কারেন্ট সরাসরি তোমার মগজে প্রবাহিত করে দিলে দুনিয়ার সেরা গল্পকার হয়ে যাবে তুমি। সারা শহরের ছেলেমেয়েরা ভেঙে পড়বে তোমার গল্প শোনার জন্য। তুমি ওদের ভয়ের গল্প শোনাবে, ভূতের গল্প শোনাবে, ছোটরা যত ধরনের গল্প শুনতে পছন্দ করে, সব শোনাবে। আতঙ্কিত, বিমোহিত করে দেবে ওদের। নেশাগ্রস্ত করে ফেলবে। তোমার গল্প শোনার জন্য পাগল হয়ে যাবে ওরা। রোজ ছুটে চলে আসবে তোমার কাছে। রাতে শপিং মল যখন বন্ধ থাকবে, গল্পগুলো তুমি কম্পিউটারে কম্পোজ করে লিখে ফেলবে। সেসব ছেপে বই বানিয়ে বাজারে ছাড়ব আমি। বিখ্যাত হয়ে যাবে তুমি। আর আমি হব কোটি কোটি টাকার মালিক!’