ফিরে এল দানব-মহিলা।
‘নেমে এসো,’ বলল ও।
‘পারছি না তো, আমার সিটবেল্ট আটকে গেছে,’ জবাব দিলাম।
আমার মুখের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনাআপনি বাকল্স খুলে খসে পড়ল বেল্টটা। উঠে দাঁড়ালাম। পা ঝাড়া দিলাম। লাফিয়ে নামলাম মাটিতে।
‘এদিকে, প্লিজ,’ দানব-মহিলা বলল। পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল আমাকে খোলা জায়গাটা দিয়ে। দূরে একটা বাড়ি চোখে পড়ল।
‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘আমাদের মালিকের সঙ্গে দেখা করতে,’ দানব-মহিলা জবাব দিল।
‘এই মালিকটি কে?’
‘ওঁর সঙ্গে দেখা হলেই বুঝবে।’
চুপ হয়ে গেল দানব-মহিলা। আর একটি কথাও বের করতে পারলাম না ওর মুখ থেকে।
নীরবে হেঁটে চলেছি আমরা। মস্ত এক মাঠের ওপর দিয়ে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বন কেটে তৈরি করে মাটি সমান করা হয়েছে, ইদানীং।
বাড়িটার দিকে এগোচ্ছি আমরা। সাদা রঙ করা, ছোট একটা বাড়ি। প্ল্যাস্টিক দিয়ে তৈরি। অদ্ভুত এক ধরনের আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে দেয়ালগুলো থেকে, মনে হলো ভিতর থেকে আসছে আলোটা। কোনও দরজা-জানালা দেখলাম না বাড়িটার।
‘মালিক, আমরা এসেছি,’ বাড়িটার কাছে এসে ওটার দিকে তাকিয়ে দানব-মহিলা বলল।
একটা দরজা খুলে গেল। তারপর দ্রুত মিলিয়ে গেল পুরো বাড়িটা। যেন আলো দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল, সুইচ অফ করে নিভিয়ে দেয়া হয়েছে।
দানব-মহিলা যাকে ‘মালিক’ বলে ডাকল, সে বসে আছে একটা সিংহাসনের ওপর। পরনে ঢোলা আলখেল্লা। মাথায় সোনার মুকুট। আলোয় ঝলমল করছে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল ও। নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, ‘আমার রাজ্যে, তোমার নতুন বাড়িতে স্বাগতম, রবিন।’
হেসে উঠল ও।
ধড়াস করে এক লাফ মারল আমার হৃৎপিণ্ড। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। এই ‘মালিক’ শপিং মলের সেই মেকানিক, ছোটখাট মানুষটি, যার নাম হিরাম স্কারপিনি।
পনেরো
অন্যদের মত হিরাম স্কারপিনির চেহারার কোন পরিবর্তন হয়নি। যা ছিল, তা-ই আছে। ভাবলাম, ওপরের মানুষের জগতের মতই এখানকার জগতেও মনিব কিংবা মালিক হলে তাকে কোন কিছু বদলাতে হয় না। সে নিজের ইচ্ছেয় খেয়ালখুশিমত চলতে পারে।
‘কী ঘটছে ভেবে খুব অবাক হচ্ছ, তাই না? নিশ্চয় ভাবছ, তুমি যা দেখছ, তোমার বন্ধুরা কেন সেসব দেখছে না?’ হিরাম স্কারপিনি বলল।
আমি ওকে স্কারপিনিই বলব, মালিক বলতে রাজি নই।
আবার খোলা জায়গাটা ধরে হেঁটে চলেছি আমরা। কোথা থেকে যেন উদয় হয়েছে শপিং মলের মালিক মিস্টার ওয়েভারলি। আমাদের পিছন পিছন আসছে যেন বডিগার্ড হয়ে। ধমক ছাড়া ওর সঙ্গে কথা বলছে না হিরাম স্কারপিনি। আর বলার সঙ্গে সঙ্গে সেটা পালন করার জন্য পাগল হয়ে উঠছে ওয়েভারলি
‘হ্যাঁ, কী ঘটছে জানার জন্য সামান্য কৌতূহল তো হচ্ছেই,’ কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম।
‘খুব সহজ,’ স্কারপিনি বলল। ‘শপিং মলে আমাকে তুমি কী করতে দেখেছ? মেকানিকের কাজ। ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ। যন্ত্রপাতি তদারকির কাজ। অন্যের কর্মচারী, চাকর। অথচ আগে আমি কারও চাকরি করিনি, আমার নিজের দোকান ছিল, ইলেকট্রিকের দোকান।
‘আপনার নিজের দোকান?’ জিজ্ঞেস করলাম। ‘কী হয়েছে ওটার?’
‘ওটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, জোর করে কেড়ে নেয়া হয়েছে আমার কাছ থেকে। সোজা কথায়, আমাকে আমার জায়গা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, রবিন। সব কিছুই করা হয়েছে উন্নয়নের নামে। মিস্টার ওয়েভারলির মত প্রভাবশালী আর টাকাওয়ালা কিছু মানুষ আমাকে তুলে নিয়ে স্রেফ রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলেছে।’
কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকালাম ওয়েভারলির দিকে। আমাদের ঠিক পিছনেই রয়েছে। যন্ত্রের মত হাঁটছে। ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, মালিক তো দূরের কথা, একেবারে গোলাম বনে গেছে। কোন ক্ষমতাই নেই আর ওর।
‘ওয়েভারলি আর ওর ক্ষমতাশালী চ্যালারা আমাকে আমার জায়গা থেকে তাড়িয়েছে, আমার ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি ও আমার মত আরও কয়েক ডজন ছোট ব্যবসায়ীর ভাত বন্ধ করেছে ওরা, পেটে লাথি মেরেছে। আমাদের জায়গা কেড়ে নিয়ে সেখানে বিশাল শপিং মল বানিয়েছে।’
‘ও, আপনাদের জায়গাতেই শপিং মল বানিয়েছে ওরা,’ সহানুভূতির সঙ্গে বললাম।
‘হ্যাঁ, রবিন, তুমিই একমাত্র আমার দুঃখ বুঝলে!’ আমার দিকে তাকিয়ে হাসল স্কারপিনি। ‘এখন আমি প্রতিশোধ নিয়েছি, সমান সমান হয়ে গেছে। কাজ যে আমি শুরু করেছি, সেটা তো দেখতেই পাচ্ছ।’ ওয়েভারলির দিকে ফিরে ধমকে উঠল, ‘ তাই না, ওয়েভারলি?’
‘হ্যাঁ, মালিক, হ্যাঁ,’ তাড়াতাড়ি মুখ কাঁচুমাচু করে হাত কচলে জবাব দিল ওয়েভারলি। ওর কণ্ঠস্বর, ওর চোখের চাহনি, সব কেমন যেন নিষ্প্রাণ। রোবট বানিয়ে দেয়া হয়েছে যেন লোকটাকে। যেন ওর মগজটাকে দখল করে নিয়েছে স্কারপিনি।
‘আমি যা করেছি, রবিন, সেটা করতে বহু সময় লেগেছে আমার। অনেক ধৈর্য ধরতে হয়েছে। কষ্ট করতে হয়েছে। শপিং মলের সমস্ত ওয়্যারিংকে আমি রি-ওয়্যারিং করেছি। নতুন এক ধরনের কারেন্ট সাপ্লাই করেছি সেই নতুন তারের ভিতর দিয়ে, জানা না থাকলে ধরতেই পারবে না কেউ। একমাত্র আমি পারব, আমার বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে। প্রচণ্ড শক্তিশালী ওই কারেন্টের রশ্মি মগজে ঢুকলে ব্রেইনওয়েভ বদলে যায়। বোধবুদ্ধি লোপ পায়, চিন্তার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়, কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে আমার গোলামে পরিণত হয়।’ ওয়েভারলির দিকে তাকাল স্কারপিনি। ভুরু কুঁচকে ধমকে উঠল, ‘তাই না, ওয়েভারলি, তুমি এখন আমার কুত্তা না?’