‘ডানের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাও!’ ধমকে উঠল সে। ‘অন্য কাস্টোমারদের পথ আটকিয়ো না!’
কোথায় অন্য কাস্টোমার? একটা লোককেও তো দেখতে পাচ্ছি না। শুধু দেহটাই বিকৃত হয়ে যায়নি লোকটার, মনে হলো মগজটাও বিগড়ে গেছে।
এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। দ্রুত ডানের রাস্তাটা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। এঁকেবেঁকে চলে গেছে রাস্তাটা। সামনের একটা পাহাড়ের দিকে।
গাছের দিকে যাচ্ছি, না আরও কোনও ভয়ঙ্কর জায়গায় চলেছি, জানি না। পিঠের ব্যাকপ্যাকটা টেনেটুনে সোজা করলাম।
‘আমার সামনে থেকে সরো!’ হঠাৎ গর্জে উঠল একটা কণ্ঠ। ‘আমি ব্যস্ত মানুষ! আমাকে যেতে দাও!’
রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি, শপিং মলের মালিক মিস্টার ওয়েভারলি। সারা মুখে বড় বড় লোম। অদ্ভুত চেহারার একটা মোটর সাইকেলে বসে রয়েছে। সামনের পাহাড় থেকে নেমে আসা রাস্তা ধরে এসেছে। কখন এসেছে, বলতে পারব না। আসতে শুনিনি মোটর সাইকেলটাকে।
তেরো
ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে মিস্টার ওয়েভারলি। লাফ দিয়ে বাঁয়ে সরে গিয়ে জায়গা করে দিলাম ওকে। আমার প্রায় গা ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল ওর মোটর সাইকেল।
ওর কুৎসিত রোমশ মুখটার দিকে তাকিয়ে গা ঘিঘিন্ করতে লাগল।
‘মনে হয় পথ হারিয়েছ?’ শান্ত, ঠাণ্ডা একটা মহিলাকণ্ঠ কানে এল।
ফিরে তাকালাম। একটা গাছের অন্ধকার, ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে মহিলা।
‘কে আপনি?’ ঢোক গিলে কোনমতে জিজ্ঞেস করলাম। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। থরথর করে কাঁপছে সারা শরীর। কথা বেরোতে চাইছে না গলা দিয়ে।
‘এত তাড়াতাড়িই ভুলে গেলে?’ মহিলা বলল। ‘এই তো, একটু আগেই তো দেখা হলো আমাদের।’
ছায়া থেকে আলোয় বেরোল ও। চিনতে পারলাম। গ্রেগ জনসনের দোকানের সেই মহিলা। একই পোশাক পরা রয়েছে। ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। বড় বড় দাঁত দেখা যাচ্ছে। চোখা চোখা, ধারাল। দোকানে এমন দাঁত দেখিনি। স্বাভাবিক ছিল। আর চুলের জায়গায় চুলও নেই এখন, অসংখ্য সাপ কিলবিল করছে, রূপকথার মেডিউসার মত। লম্বা সরু সরু আঙুলের মাথায় বড় বড় নখ।
একটা গাছের নীচে পার্ক করে রাখা একটা ছাতখোলা ভ্যান গাড়ি দেখিয়ে মহিলা বলল, ‘ওই গাড়িতে করে তোমাকে তোমার আসল গন্তব্যে পৌঁছে দিতে বলা হয়েছে আমাকে। প্লিজ, ভ্যানে উঠে বসো। যাত্রাটা খুব আরামের হবে, কথা দিতে পারি।
ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড় দিতে ইচ্ছে করল। কিন্তু জানি, কোন লাভ নেই। যে আমার পিছে লেগেছে, সে আমাকে খুঁজে বের করবেই।
দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী ঘটে। হয়তো পালানোর সুযোগ পেয়েও যেতে পারি। ভেবে, চুপচাপ ভ্যানের পিছনে উঠে বসলাম। মহিলা বসল ড্রাইভিং সিটে। ইঞ্জিন স্টার্ট দিল। ‘সিটবেল্ট পরো, প্লিজ। এটা এখানকার নিয়ম। কড়াকড়িভাবে নিয়ম মেনে চলি আমরা।’
বাহ্, দারণ কথা শুনলাম! এরা এখানে নিয়ম মেনে চলে! একটা ছেলেকে বাড়ি যেতে না দিয়ে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ধরে নিয়ে আসাটা কোন নিয়মের মধ্যে পড়ে?
বেল্ট পরলাম।
চাকায় গড়িয়ে না চলে আচমকা এক লাফ দিয়ে শূন্যে উঠে পড়ল গাড়িটা। হেলিকপ্টারের মত সোজা ওপরে উঠে যাচ্ছে।
চেঁচিয়ে উঠলাম। পড়ে যাওয়ার ভয়ে গাড়ির কিনার খামচে ধরলাম। এতক্ষণে বুঝলাম, কেন সিটবেল্ট বাঁধার জন্য চাপাচাপি করা হয়েছে।
চোদ্দ
‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’ ইঞ্জিনের গর্জন আর বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দকে ছাপিয়ে চিৎকার করে উঠলাম। এরোপ্লেনের মত উড়ে চলেছে ভ্যান গাড়িটা।
কিন্তু জবাব দিল না মহিলা। হয় আমার কথা শোনেনি, নয়তো ইচ্ছে করেই জবাব দেয়নি। অনেক ওপরে উঠে নাক সোজা হলো গাড়ির। মাটি থেকে হাজার ফুট ওপর দিয়ে সোজাসুজি উড়ে চলল। কীভাবে ঘটছে এই অদ্ভুত কাণ্ডটা, শপিং মলের মাটির নীচে, মাথায় ঢুকছে না আমার। একমাত্র কল্পনাতেই সেটা সম্ভব। কিংবা ভয়ংকর দুঃস্বপ্নে।
নীচে তাকালাম। বড় বড় গাছে ঢাকা ঘন বন। মাঝখান দিয়ে সরু কাঁচা রাস্তা চলে গেছে। সামনে খানিকটা জায়গা দেখলাম, বন কেটে সাফ করা।
‘এক মিনিটের মধ্যেই নামব আমরা, তৈরি হও, প্লিজ, মহিলা বলল। ওকে মহিলা না বলে দানব-মহিলা বলাই ভাল। ওর মাথার দিকে তাকাতে চাইছি না পারতপক্ষে, তবুও চোখ চলে যায়। কিলবিল করেই চলেছে সাপগুলো। হেলান দিয়ে বসলাম। মনটাকে শক্ত করার চেষ্টা করছি। মাথা গরম করে ফেললে কিংবা ভয়কে মগজটা গ্রাস করতে দিলে, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারব না। পালানোর সুযোগ পাব না।
হেলিকপ্টারের মত সরাসরি মাটিতে গাড়ি নামাল দানব-মহিলা। এত আস্তে, আর নিখুঁতভাবে, কোন ঝাঁকুনিই টের পেলাম না।
গাড়ি থেকে নামল ও। সিটবেল্ট খোলার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। আটকে গেছে ওটা
‘নোড়ো না, প্লিজ। তোমার জন্য পরবর্তী আদেশ না আসা পর্যন্ত বসেই থাকতে হবে তোমাকে।’ বলে আমাকে একা রেখে তাড়াহুড়া করে চলে গেল দানব-মহিলা। ভয়ানক অসহায় লাগছে আমার। মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। কেন যে মরতে শপিং মলে এসেছিলাম! মা যতই বলুক, কোনমতেই আসা উচিত হয়নি আমার। তারপর মনে হলো, আচ্ছা স্বপ্ন দেখছি না তো? দুঃস্বপ্নে ঘটছে না তো ঘটনাগুলো?
নিজের হাতে চিমটি কেটে দেখলাম। ব্যথা লাগল। না, বাস্তবেই ঘটছে এসব। কিন্তু কীভাবে ঘটছে—এসব তো কেবল রূপকথার রাজ্যে কিংবা পরীর দেশেই সম্ভব—হাজার ভেবেও বুঝতে পারলাম না।