কিশোর আর মুসাকে কী বলব ভাবতে ভাবতে নীচে নামার এসকেলেটরে পা রাখতে যাব, পিছন থেকে বলে উঠল পরিচিত কণ্ঠ, ‘এসকেলেটর নষ্ট।’
ফিরে তাকালাম। এসকেলেটরের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে হিরাম স্কারপিনি। আমার পিছন পিছন এসেছে।
আমি তাকাতেই আবার বলল, ‘চলে না। অচল হয়ে গেছে।’
‘কাল না দেখলাম ঠিক করলেন?’ আমি বললাম।
‘করেছিলাম, কিন্তু পুরোপুরি ঠিক হয়নি। সমস্যা রয়েই গেছে। এসব একদিনে মেরামত করা যায় না,’ শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে হিরাম স্কারপিনি বলল। ‘এলিভেটরে চড়ে যাও।’
এই একটা কাজই আমি আর করতে চাই না—এলিভেটরে চড়ে নীচে নামা। ‘না, আমি এলিভেটরে চড়ব না, সিঁড়ি দিয়ে নামব।’
‘উঁহুঁ,’ মাথা নাড়ল লোকটা। ‘পারবে না। সিঁড়ির মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মিস্ত্রিরা রঙ করছে ওখানে।’
অসহায় ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম, নীচে নামতে হলে এলিভেটর ব্যবহার করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই আমার।
‘এলিভেটরকে তুমি ভয় পাও, তাই না?’ হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল লোকটা। যেন আমার ভয় দেখে মজা পাচ্ছে।
জবাব না দিয়ে ঘুরে হাঁটতে শুরু করলাম।
এলিভেটরের কাছে এসে দাঁড়ালাম। একমাত্র আমিই আছি। আর কেউ নেই। অথচ আজ শনিবারের ভিড়ের দিন। দুপুরের খাবার সময়। এলিভেটরের সামনে লাইন থাকার কথা। কারণ খাবারের দোকানগুলো সব নীচে
বোতাম টিপলাম। এলিভেটর এল। দরজা খুলল। কেউ নেই ভিতরে। ঢুকব কি না দ্বিধা করছি, কে যেন আমার পিঠে ধাক্কা দিয়ে এলিভেটরের ভিতরে ঠেলে দিল।
লেগে গেল দরজাটা। দরজা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোও নিভে গেল।
গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেছে এলিভেটরের ভিতরটা!
বারো
শান্ত, মসৃণ কণ্ঠের কথা শোনা গেল এলিভেটরের স্পিকারে, ভয় পেয়ো না। বৈদ্যুতিক সিসটেমে গণ্ডগোল হয়েছে। এখুনি ঠিক হয়ে যাবে। প্যানেলে এইচ লেখা বোতামটা টিপে দাও, প্লিজ। তারপর পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় থাকো।’
হালকা, মৃদু আলো জ্বলে উঠল। কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকালাম। ফিরে এসেছে ‘এইচ’ লেখা বোতামটা।
যত খুশি নির্দেশ দিতে থাকুক স্পিকারে, মরে গেলেও আমি ওই বোতাম টিপব না।
কিন্তু কে যেন আমাকে দিয়ে জোর করেই বোতাম টেপাল। সেই অদৃশ্য হাতটাই হবে হয়তো, যেটা আমাকে ধাক্কা দিয়ে এলিভেটরের ভিতর ঠেলে ফেলে দিয়েছিল।
নড়ে উঠল এলিভেটর। নামতে শুরু করল।
মনে হলো যেন অনন্তকাল ধরে নেমেই চলেছি।
নেমে যাচ্ছি শপিং মলের নীচে, পাতালে।
তারপর হঠাৎ ঝাঁকি দিয়ে থেমে গেল এলিভেটর।
সব কিছু স্তব্ধ। নিথর। অখণ্ড নীরবতা।
তারপর সেই মসৃণ কণ্ঠটা আবার বলল স্পিকারে, ‘তোমার শেষ গন্তব্যে পৌঁছে গেছ, রবিন। ভাল থাকো। ‘
দরজা খুলে গেল। আগেরবারের মতই তীব্র আলো পড়ল চোখে।
দুই হাতে চোখ ঢাকলাম।
আলো কমে এলে আবার যখন হাত সরালাম, দেখি সেই আজব বুনো অঞ্চলে দাঁড়িয়ে আছি। এলিভেটরকার থেকে কখন বেরোলাম, কীভাবে বেরোলাম, জানি না। কী ঘটে দেখার জন্য অপেক্ষা করলাম না। ঘুরে দাঁড়ালাম, বট গাছের ফোকর দিয়ে এলিভেটরে ঢোকার জন্য। এখানে থাকতে চাই না আমি।
কিন্তু কোথায় গাছ?
নেই ওখানে!
‘সর্বনাশ!’ বিড়বিড় করলাম। বনের অন্য কোনও অংশে চলে এসেছি হয়তো আমি। এখান থেকে বেরোনোর একটাই উপায়, বট গাছের ফোকর দিয়ে এলিভেটরে ঢোকা। তবে তার আগে গাছটাকে খুঁজে বের করতে হবে।
সরু কাঁচা রাস্তা দেখে সেটা ধরে হেঁটে চললাম। আমার চারপাশে বড় বড় গাছ, কেমন ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। সবগুলোই তো দেখতে এক রকম, এর মাঝে সেই বিশেষ গাছটাকে খুঁজে বের করব কী করে? তারপর মনে পড়ল, যে গাছের ফোকর দিয়ে বেরিয়েছি, সেটার গোড়ায় মস্ত শিকড় রয়েছে। যাতে হোঁচট খেয়েছিলাম।
এগিয়ে চললাম। আমার দুই চোখের দৃষ্টি সেই শিকড় খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর ওই বিশেষ গাছটাকে। এই ভয়ানক বনে কোনও রাক্ষুসে প্রাণী নেই তো, যে আমাকে ধরে খাওয়ার জন্য ওত পেতে রয়েছে? তবে এখন পর্যন্ত কোনও প্রাণী দেখিনি।
‘কী, রাস্তা খুঁজছ, রবিন?’ চিঁ-চিঁ করে ওপর থেকে কথা শোনা গেল।
থমকে দাঁড়ালাম। ওপরে তাকিয়ে দেখি, গাছের ডালে বসে কী যেন খাচ্ছে গ্রেগ জনসনের চেহারার সেই প্রাণীটা।
‘কী-কী চান আপনি?’ কোনমতে তুতলে বললাম। ‘আমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে কেন? এখান থেকে বেরোব কী করে?’
‘হাঁটতে থাকো,’ হেসে বলল ও। ‘ঠিক পথেই এগোচ্ছ। শীঘ্রি তোমার পরবর্তী নির্দেশ পেয়ে যাবে।’ হেসে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিল ভূতুড়ে গ্রেগ জনসন। ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম, কাঁচা মাংস খাচ্ছে ও। ঠোঁটের কোণ বেয়ে লাল রস গড়াচ্ছে। রক্তের মত। শিউরে উঠলাম। তাড়াতাড়ি পা চালালাম ওখান থেকে সরে আসার জন্য।
একটা দোরাস্তার মাথায় পৌছলাম। কোন দিকে যাব এখন? ডানে, না বাঁয়ে?
‘ডানে যাও, ডানে!’ বলে উঠল একটা অদৃশ্য রাগত কণ্ঠ।
অবাক হয়ে চারপাশে তাকালাম, কে কথা বলে দেখার জন্য। যাকে দেখলাম, নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড় হলো আমার।
শপিং মলের সেই দারোয়ান, আমি ঢোকার সময় প্রতিবারেই যে কটমট করে তাকিয়ে থাকে। রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। ভুতুড়ে গ্রেগ জনসনের মত এ-লোকটাকেও ভূতুড়ে লাগছে। হাত, মুখ, আর গায়ের চামড়া ফুলে উঠেছে, বড় বড় ফোঁড়ার মত। চুলগুলো সব জট পাকানো। এমনিতেই চেহারাটা ভাল না ওর, এই আজব ভূতুড়ে জগতে আরও বেশি ভয়ানক, বিকৃত লাগছে।